বিশ্বে সোনার চেয়েও দামি যেসব চা

প্রকাশ | ২৬ মে ২০২২, ১২:৫২ | আপডেট: ২৬ মে ২০২২, ১৪:৩৪

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস

সুস্বাদু এক কাপ চা সারাদিনের কর্মব্যস্ততার মাঝে শরীর চাঙ্গা করে তুলতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মনে উৎফুল্লতা আনতে এক কাপ চায়ের কোনো জুড়ি হয় না।

গবেষণায় দেখা গেছে, চা আমাদের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়। চা পান করলে আমাদের দাঁত ও হৃদপিণ্ড সুস্থ থাকে, এমনকি এটি ক্যানসারের বিরুদ্ধেও বেশ কার্যকরী। চা ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বাড়ানোর পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং হৃদ্‌যন্ত্র ভালো রাখে।

তবে চায়ের আদি জন্মভূমি চীন দেশে। ১৬৫০ সালে চীনে চায়ের আবিষ্কারের পর ১৮০০ সালে বৃটিশদের হাত ধরে যে চা এই উপমহাদেশে এসেছিল, সেখানেই এখন চায়ের বিশাল একটি অংশ চাষ হয়। বাংলাদেশের সিলেটে মালনীছড়া চা বাগান হলো উপমহাদেশের প্রথম প্রতিষ্ঠিত চা বাগান।

বিজ্ঞানীরা চা উদ্ভিদের নাম দিয়েছেন ক্যামেলিয়া সিনেনসিস। যত ধরনের চা আছে সবই তৈরি হয় ক্যামেলিয়া সিনেনসিস থেকে। চা মৌসুমী অঞ্চলের পার্বত্য ও উচ্চভূমির ফসল। এই চির-হরিৎ গুল্ম বা ছোট গাছ থেকে পাতা এবং পাতার কুঁড়ি সংগ্রহ করে তা চা উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়।

বিভিন্ন ধরনের চায়ের মধ্যকার পার্থক্যগুলো উদ্ভিদের চাষের ধরন, পরিস্থিতি এবং উৎপাদন প্রক্রিয়াতে ভিন্নতা রয়েছে। সর্ববৃহৎ চা উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে চীন, ভারত, কেনিয়া, শ্রীলঙ্কা, তুরস্ক, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, আর্জেন্টিনা, বাংলাদেশ, জাপান, উগান্ডা, নেপাল, ইরান, মিয়ানমার অন্যতম। চায়ের নানা রকমফের। গুণে মানে দামেও বিস্তর তারতম্য। এই পানীয় সুলভ হলেও এমন অনেক চা আছে যার দাম সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। চায়ের দাম অনেক বেশি হলেও বিশ্বজুড়ে এসব দামি চায়ের চাহিদাও অনেক। জেনে নিন সোনার চেয়েও দামি যেসব চা-

দ্য গোল্ডেন বেঙ্গল

বিশ্বের সবচেয়ে দামি চায়ের নাম ‘দ্য গোল্ডেন বেঙ্গল’। যার প্রতি পাতায় ২৪ ক্যারেট সোনার প্রলেপ যার দাম প্রতি কেজিতে ১৪ লাখ পাউন্ড। বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৬ কোটি টাকা। লন্ডনের ১০৩ ব্রিক লেনে অবস্থিত লন্ডন টি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে এই চায়ের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ‘দ্য গোল্ডেন বেঙ্গল’ বা সোনার বাংলা চা এসেছে বাংলাদেশের সিলেট জেলা থেকে। প্রকারে ব্ল্যাক টি, কিন্তু স্বচ্ছ পেয়ালায় তার সোনালি উপস্থিতি। ‘দ্য গোল্ডেন বেঙ্গল’ চা প্রস্তুতের প্রক্রিয়াটিও বেশ সময়সাপেক্ষ। এর জন্য সময় লেগেছে প্রায় সাড়ে চার বছর। ৯০০ কেজি উৎপাদিত চা থেকে মাত্র এক কেজি চা পাতা বাছাই করা হয়। বিশ্বের ৭৮টি রাজপরিবারকে চা পাতা সরবরাহ করে লন্ডন টি এক্সচেঞ্জ। এমনকি, ইংল্যান্ডের রানির পছন্দের চা-ও এখান থেকেই পৌঁছে যায় বার্কিমহাম প্যালেসে।

দা হং পাও

বিশ্বের অন্যতম দামি চা ‘দা হোং পাও’ চা। যার এক কাপ চায়ের দাম সাড়ে আট লাখ টাকা! একে বলা হয় সোনার চেয়েও দামি চা। কারণ এর এক গ্রামের দাম সোনার এক গ্রামের দামের থেকে ৩০ গুণ বেশি! চীনের ফুজিয়ান প্রদেশের উয়ি পর্বতে খুব বিরল জাতের এই চা উৎপন্ন হয়। তবে এই চায়ের এতো দামের পেছনে অন্যতম কারণ হলো সারা বিশ্বের মধ্যে একমাত্র চীনেই এই চায়ের ছয়টি গাছ রয়েছে। বিরল ও উৎকৃষ্ট মানের জন্য দা হোং পাও’কে চায়ের রাজা বলা হয়।  ২০০৬ সালে এই ছয়টি চা গাছের প্রায় ১১৭ কোটি টাকার বিমা করিয়েছে চীন সরকার। এক কেজি এই চায়ের দাম প্রায় ৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। তিনশো বছর ধরে চীনে এই চায়ের চাষ হচ্ছে। এই চায়ে রয়েছে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী ক্যাফেইন, থিওফিলিন, পলিফেনলস এবং ফ্ল্যাবোনয়েড। প্রতিদিন এই চা খেলে ত্বক ভাল থাকে। মাটির পাত্রে বিশুদ্ধ পানিতে এই চা বানাতে হয়। সুগন্ধের জন্যও এই চায়ের রয়েছে আলাদা কদর। 

'স্বর্ণ পানাম' বা 'গ্লোডেন টি'

গোল্ডেন ড্রিংকস ‘স্বর্ণ পানাম’  একটি সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ চা। ২৪ ক্যারেট ভোজ্য সোনার সূক্ষ্ম পাপড়ি দিয়ে এই বিশেষ চা-টি তৈরি করা হয়েছে। মধু চা ক্লোনের সঙ্গে অসমান কালো চায়ের সেরা কোমল পাতা থেকে তৈরি করা হয়েছে। এই বিশেষ চা তৈরি করেছেন অসমের মাস্টার চা নির্মাতা রঞ্জিত বড়ুয়া। অসমে চা ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্যতম ও জনপ্রিয়ও বটে। ইউরোপে চা বিক্রি করে যিনি লাইমলাইটে চলে আসেন। অসমের বিখ্যাত ও বিরল কালো চায়ে মধু, গুড় ও কোকো মিশিয়ে যিনি চা জগতে বেশ শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন। অসাধারণ স্বাদের এই চা সাধারণত চায়ের কোমল পাতা থেকে প্রস্তুত করা হয়েছে। মাত্র ১০০ গ্রাম স্বর্ণ পানাম চা একটি সাদা সোনার সিরামিক বোয়ামে পাওয়া যায়। তাতে কালো বাক্সে প্যাকেট করা, তাতে থাকে একটি ব্রোঞ্চের চামচ ও ডবল ওয়াল গ্লাস কাপ। বাক্সটির দাম প্রায় ২৫ হাজার টাকা। প্রতি কেজি এর দাম প্রায় আড়াই লাখ টাকা।

পিজি টিপস ডায়মন্ড-টি ব্যাগ

পিজি টিপস নামে ব্রিটিশ কোম্পানিটির নাম অনেকেই জানেন তাদের চায়ের স্বাদের ভিন্নতার জন্য। ২০০৫ সালে পিজি টিপসের দার্জিলিং চায়ের ডায়মন্ড-টি ব্যাগটি বাজারে আনা হয়। এই চায়ের প্যাকেট পেতে হলে আপনাকে খরচ করতে হবে ১৫ হাজার মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যার মূল্য প্রায় ১২ লাখ টাকা। দুটো কারণে এই চায়ের এত বেশি দাম। প্রথমত, এটি এক ধরনের বিরল প্রজাতির সিলভার টিপস ইম্পেরিয়াল চা। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি টি ব্যাগে রয়েছে ২৮০ টুকরো ২.৫৬ ক্যারেটের হীরে। যার পুরো কারুকার্য করেছে বিখ্যাত বুডলেস জুয়েলার্স।

ভিন্টেজ নার্সিসাস চা

ভিন্টেজ নার্সিসাস চায়ের সন্ধান পাওয়া যায় চীনের উয়ি পাহাড়ে। এই চা সংগ্রহ করা হয় গাছের হলুদ রঙের কুঁড়ি থেকে। এর স্বাদ স্তরে স্তরে পরিবর্তিত হয়। মূলত গ্রিক দেবী নার্সিসাসের নামানুসারে এই চায়ের নামকরণ করা হয়েছে। এর বিশেষত্ব হলো, চায়ের ৬০ শতাংশ জারণ করা হয়। যত বেশি পুরনো হয় নার্সিসাস চা, ততই সুপেয় হয়। বছরের পর বছর এটা সংরক্ষণ করা হয়। প্রতি দুই বছর পরপর তাপ দিয়ে পোড়ানো হয়। এই চায়ের স্বাদ বৃদ্ধির জন্য প্রতিবার পোড়ানোর সময় এর সঙ্গে কাঠ, ফুল কিংবা চকলেটের ফ্লেভার দেওয়া হয়। প্রতি কেজি ভিন্টেজ নার্সিসাস চায়ের মূল্য সাড়ে ৬ হাজার মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মূল্যে প্রায় ৫ লাখ টাকা।

ইয়েলো গোল্ড-টি বাডস

স্বর্ণের প্রলেপ দেওয়া ইয়েলো গোল্ড-টি বাডস। ইয়েলো গোল্ড-টি বাডসের প্রতি কেজি ৩ হাজার মার্কিন ডলার অর্থাৎ ২৫ লাখ টাকা। এটি এত মূল্যবান হওয়ার কারণ হচ্ছে এই চায়ের গাছ থেকে যখন পাতা গজায় তখনই পুরো পাতায় ২৪ ক্যারেট স্বর্ণের প্রলেপ দেওয়া হয়। স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষ উপকারী এই চা বাগান থেকে বছরে কেবল এক দিনই সংগ্রহ করা হয়। শুধু পাতায় লাগানোর জন্যই নয়, চায়ের পাতা সংগ্রহ করতেও ব্যবহার করা হয় স্বর্ণের কাঁচি। সাতবার প্রক্রিয়াজাতকরণের পর বাজারজাত করা হয় এই দুর্লভ প্রজাতির ইয়েলো গোল্ড-টি বাডস। বিশ্বের অন্যতম দামি এই চায়ের প্রস্তুতকারক দেশ চীন।

ব্রোকেন লিফ ব্ল্যাক-টি

সবচেয়ে পুরনো চা হিসেবে ইউরোপে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ব্রোকেন লিফ ব্ল্যাক-টি। এই চায়ের চাষ কেবল ইউরোপেই হয়। এই চায়ের মূল বিশেষত্ব হলো, শুধু চা গাছের তিন নম্বর পাতা থেকেই এই চা উৎপাদন করা হয়। যে কারণে চায়ের স্বতন্ত্র ধরনের তামাটে রং হয়। পাশাপাশি চা পানে ফলের সুবাস পাওয়া যায়। প্রতি কেজি ব্রোকেন ব্ল্যাক-টির মূল্য ৪০৫ মার্কিন ডলার কিংবা প্রায় সাড়ে ৩৪ হাজার টাকা।

সিলভার টিপস ইম্পেরিয়াল চা

রং আর কড়া স্বাদ তো বটেই, দামের জন্যও সিলভার টিপস ইম্পেরিয়াল চায়ের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। এ মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে দামি দশ ধরনের চায়ের তালিকা করলে তাতে স্থান পাবে সিলভার টিপস ইম্পেরিয়াল। এই চায়ের চাষ হয় ভূপৃষ্ঠ থেকে ৮ হাজার ফুট ওপরে হিমালয়ের কোলে। চা বাগান থেকে পাতা তোলার পর তা পাঠানো হয় ভারতের দার্জিলিংয়ে অবস্থিত মাকাইবাড়ি টি স্টেটে, যেটি পৃথিবীর প্রথম কয়েকটি চা প্রক্রিয়াজাতকারী ফ্যাক্টরির একটি। প্রতি কিলোগ্রাম সিলভার টিপস ইম্পেরিয়াল চায়ের মূল্য ৪০০ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মানে প্রায় ৩৪ হাজার টাকার কাছাকাছি। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে এটি সবচেয়ে দামি চা।

তিয়েগুয়ানিন চা

তিয়েগুয়ানিন চা বা ওলং চা নামেও পরিচিত। এই চা সেমি-অক্সিডাইজড। এর প্রস্তুতকরণের কারণে এই চায়ের স্বাদের মধ্যেও বেশ ভিন্নতা কাজ করে। ওলং শব্দের অর্থ কালো ড্রাগন, যার কারণে এর আরেক নাম কালোনাগ চা। এই চায়ের নামকরণ করা হয়েছে চীনের দেবী মার্সি গুয়ানিনের নামে। এতে চায়ের পাতার অক্সিডেশন বা ফার্মেন্টেশনের ওপর চায়ের রং বা গন্ধ পরিবর্তন হয়। পুরোপুরি ফারমেন্ট ও অক্সিডাইজড করা হয় ব্ল্যাক-টি। গ্রিন-টি একেবারেই ফারমেন্ট করা হয় না কিন্তু এই কালো ড্রাগনকে মাঝামাঝি অক্সিডাইজড বা ফার্মেন্ট করা হয়। এতে চা পাতার ফার্মেন্টেশনের রং পরিবর্তনের আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর তাই গ্রিন-টির চেয়ে কড়া স্বাদ থাকে কিন্তু ব্ল্যাক-টির চেয়ে কম ক্যাফেইন থাকে। মূলত চাটি মেদ কমাতে সাহায্য করে। এই চা প্রথম উৎপাদিত হয় ১৯ শতকের শুরুর দিকে চীনের ফুজিয়াং প্রদেশে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তিয়েগুয়ানিন চা সবচেয়ে দামি চায়ের খেতাব ধরে রেখেছে। এই চায়ের প্রতি কেজির মূল্য তিন হাজার ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা।

(ঢাকাটাইমস/২৬ মে/আরজেড)