আতঙ্কের নাম সালথার খারদিয়া গ্রাম: ৭ মাসে ৩ খুন, ৫০০ বাড়ি ভাঙচুর

নুরুল ইসলাম, সালথা (ফরিদপুর)
 | প্রকাশিত : ২৭ মে ২০২২, ১৯:২০

ফরিদপুরের সালথায় সংঘর্ষে শীর্ষে এখন আলোচিত বড় খারদিয়া গ্রাম। ১৮টি পাড়া নিয়ে গঠিত বিশাল এই গ্রামে জনসংখ্যা ৮ হাজারেরও বেশি। নারী-পুরুষ মিলে ভোটার সংখ্যা অন্তত ৫ হাজার। এখানে একাধিক সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক, সমাজসেবক, রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধিসহ অসংখ্য ধনী বিশিষ্টজনের জন্ম। অর্থনীতিকভাবে এখানকার বেশিরভাগ মানুষ স্বচ্ছল। জমিতেও প্রচুর ফসল ফলে। অথচ গ্রামটি যুগ যুগ ধরে অশান্ত।

গত ৭ মাসে এ গ্রামে একাধিক সংঘর্ষে ৩ যুবক নিহতসহ আহত হয়েছে শতশত মানুষ। এসব হত্যার ঘটনায় কয়েক মাসে ভাঙচুর করা হয়েছে অন্তত ৫ শতাধিক বসতবাড়ি। একজন সচিবের বাড়িও দেয়া হয় আগুন। ফলে গ্রামটি রীতিমতো ভয়ঙ্কর আতঙ্কের আরেক নামে পরিনত হয়েছে। এখানে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পুলিশ সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও কে শুনে কার কথা। অভিযান চালিয়ে দেশীয় অস্ত্রসহ দাঙ্গাবাজদের গ্রেপ্তার করেও কোন কাজ হচ্ছে না। তারা তাদের মত সহিংতার সংস্কৃতি ধরে রাখতে মরিয়া। এমন পরিস্থিতিতে এখানে বসবাস অযোগ্য বলে মনে করেন সুধিজনেরা। ইতিমধ্যে গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়ে বসবাস শুরু করেছেন অনেকে।

জানা গেছে- খারদিয়া গ্রামে যদুনন্দী ইউনিয়ন আ.লীগ সাধারন সম্পাদক আলমগীর মিয়া ও ইউপি চেয়ারম্যান রফিক মোল্যার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে গত বছরের ২৩ অক্টোবর নিহত হয় মারিজ শিকদার। গত ৫ মে এই দুই দলের মধ্যে ফের সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলে নিহত হন সিরাজুল ইসলাম। এ ঘটনায় আহত আসাদ মোল্যা নামে আরেক যুবক বুধবার রাতে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

বৃস্পতিবার সকালে সরেজমিনে খারদিয়া গ্রামে গেলে গা শিউড়ে উঠে। উল্লেখিত হত্যার ঘটনায় উভয় দলের জনসাধারণের কষ্টে অর্জিত সম্পদ শতশত টিনের ঘর ভেঙে চুড়মার করার চিত্র চোখে পড়ে। এমনকি ইটের তৈরি বাড়ি ও বিল্ডিংয়ের দেয়াল ভেঙে ফেলা হয়েছে। মুজিবর রহমান নামে এক উপ-সচিবের ঘরের ভিতর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে আসবাবপত্র। এসব ঘরে থাকা নামি-দামি ব্রান্ডের মালমাল লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এমন ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র দেখে হতাশ হওয়া ছাড়া কিছু যেন করার নেই।

খোজ নিয়ে জানা যায়- নিহতরা সবাই ছিলেন পেশায় শ্রমিক। এদের মধ্যে কেউ ছিলেন সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী। তাদের বাড়িতে চলছিল শুনশান নীরবতা। স্বজন হারানোর বেদনায় কারো চোখ বেয়ে পানি পড়ছে, কেউ দাবি করছেন বিচারের। আবার কেউ প্রশ্ন তুলে বলছেন কিভাবে চলবে তাদের সংসার। কে নিবে তাদের সন্তানদের লেখা-পড়ার দায়িত্ব। যাদের জন্য তারা জীবন দিয়েছেন, তারা এখন কোথায়!

সংঘর্ষে ক্ষতিগ্রস্ত রাবেয়া বেগম, তাসলিমা আক্তার ও আমেনা খাতুন নামে তিন নারী বলেন- মারামারি হলেই সারাজীবেনর কষ্টে অর্জিত সম্পদ বাড়ি ভেঙ্গে লুট করা হয়। যা মেরামত করার পর আবারও ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে। কিভাবে বসবাস করবো এ গ্রামে। আমাদের স্বামীরা সকলে দিনমুজুর। তারা তো আর শহরে গিয়ে বাড়ি বানিয়ে থাকতে পারবে না। এমন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চাই। ডাল-ভাত খেয়ে শান্তিতে বসবাস করতে চাই। আমরা সহিংসতা চাই না।

একাধিক কৃষক বলেন- নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতে গ্রামটাকে যুগ যুগ ধরে অশান্ত করে রেখেছে মোড়লরা। তারা আমাদের জোর করে দল করতে বাধ্য করে। দল না করলে আমাদের উপর হামলা করা হয়। মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়।

খারদিয়ার বাসিন্দা কয়েকজন সরকারি চাকরীজীবি, শিক্ষক ও সমাজ সেবক বলেন- আমাদের গ্রামটা অর্থনীতিকভাবে স্বাবলম্বী। গ্রামে ঢুকে বাড়িগুলো দেখলে মনে হবে এটা কোন মিনি শহর। মোড়লদের সহিংস কর্মকাণ্ডের ফলে সেই মিনি শহরটা এখন ধ্বংসের স্তুপে পরিনত হয়েছে। গ্রামে বসবাসে অযোগ্য হিসেবে গড়ে[ তুলেছে। আমরা এখন ভয়ে গ্রামে যেতে পারি না। শহরে ভাড়া বাসায় নইলে বাড়ি তৈরি করে থাকছি। কি বলবো- ওই গ্রামের বাসিন্দা আমরা এটা পরিচয় দিতেও আমাদের লজ্জা লাগে। কোন সভ্য সমাজের মানুষ ওখানে বসবাস করতে চাইবে না।

সরকারি পুলিশ সুপার (নগরকান্দা-সালথা সার্কেল) মো. সুমিনুর রহমান বলেন- খারদিয়া গ্রামে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত আছে। ফরিদপুর পুলিশ সুপার আলিমুজ্জান স্যারও গ্রামটি পরিদর্শন করেছেন। তার নির্দেশে ওই গ্রামের মাতবর ও জনপ্রতিনিধিদের কয়েক দফা বৈঠক করা হয়েছে। একাধিকবার অভিযান চালিয়ে সহিংতায় জড়িতদের দেশীয় অস্ত্রসহ ধরে এনে মামলা দিয়ে আদালতের মাধ্যমে জেলে পাঠানো হয়েছে। ওসি সাহেবও সর্বাক্ষণিক ওই এলাকার খোজখবর রাখছেন। গ্রামটি অনেক বড় হওয়ায় একটু সমস্যা হচ্ছে। তারপরেও গ্রামের পরিবেশ ভাল রাখতে পুলিশের ক্যাম্প বসানো হয়েছে। আশা করি দ্রুতই গ্রামটির পরিবেশ ভাল হবে।

(ঢাকাটাইমস/২৭মে/এআর)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :