পদ্মা সেতুর বলি সৈয়দ আবুল হোসেন, সবাই আছেন তিনি কোথায়?

প্রকাশ | ০৯ জুন ২০২২, ০৮:৫১ | আপডেট: ০৯ জুন ২০২২, ১৭:৫৭

কৌশিক রায়, ঢাকাটাইমস

সৈয়দ আবুল হোসেন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দায়িত্ব পান যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের। পদ্মা সেতু প্রকল্পের শুরুর কাজটি তার হাত দিয়েই হয়। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ঋণদাতা গোষ্ঠী বিশ্বব্যাংকের অমূলক অভিযোগে শেষ পর্যন্ত পরিবর্তন আসে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। ঋণ দেওয়া থেকে বিরত থাকে বিশ্বব্যাংক। তবে বিশ্বব্যাংক সরে গেলেও থেমে থাকেনি সেতু নির্মাণ প্রকল্প।

জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক বিতর্ক ও সমালোচনার মুখে ২০১২ সালে প্রথমে মন্ত্রিত্ব থেকে সরে দাঁড়ান আবুল হোসেন। তবে বরাবরই তার দাবি ছিল—তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। একটা সময় কানাডার আদালতেও প্রমাণ হয় সৈয়দ আবুল হোসেনসহ অন্যদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছিল সেগুলো সত্য নয়।

এগারো বছর আাগে দেশের মানুষের ‘স্বপ্ন সেতুটি’ ঘিরে বিশ্বব্যাংক যে বাধার দেয়াল তৈরি করতে চেয়েছিল তা টেকেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় সিদ্ধান্তের ফলে নিজস্ব অর্থায়নে রচিত হয়েছে পদ্মা সেতু। আগামী ২৫ জুন এই সেতুর উদ্বোধন হতে যাচ্ছে।

স্বপ্নের সেতুটি এখন বাস্তব হলেও গত ১০ বছর ধরে সৈয়দ আবুল হোসেন প্রায় দৃশ্যপটের বাইরে। বর্তমানে দলের কোনো পদেও নেই এক সময়ের দাপুটে এই মন্ত্রী। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আবুল হোসেনকে নিয়েও নতুন করে আলোচনা হচ্ছে।

অনেকেরই কৌতূহল, কোথায় আছেন সৈয়দ আবুল হোসেন? ঢাকাটাইমস তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে কদিন ধরে যোগাযোগের চেষ্টা করে। তবে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

সাবেক এই মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ একাধিক মাধ্যমে ঢাকাটাইমস জানতে পেরেছে, সৈয়দ আবুল হোসেন দেশে-বিদেশে বাইরে নিজস্ব ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বর্তমানেও তিনি ব্যাবসায়িক কাজে দেশের বাইরে রয়েছেন। তবে খুব শিগগিরই দেশে ফিরবেন।

বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ ছিল, তখনকার যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সেতু বিভাগের সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা এবং পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলাম পরামর্শকের কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে এসএনসি-লাভালিনের কাছে ১০ শতাংশ কমিশন চেয়েছিলেন। প্রকল্পে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ ছিল চার কোটি ৭০ লাখ ডলার।

একপর্যায়ে বিশ্বব্যাংক পদ্মাসেতু প্রকল্পে অর্থায়নের চুক্তিও বাতিল করে। সংস্থাটি সেসময় এক বিবৃতিতে বলেছিল, পদ্মা সেতু নির্মাণে পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে বাংলাদেশ সরকার সহযোগিতা না করায় তারা এ পদক্ষেপ নিয়েছে।

সেসময় দুর্নীতি দমন কমিশন—দুদকের কমিশনার ছিলেন সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। তার ভাষ্য, বিশ্বব্যাংকের টিম দুদকে এসে কোনো তথ্য প্রমাণ না দিয়েই তখনকার যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মশিউর রহমানসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করতে চাপ দিতে থাকে।

সাহাবুদ্দিন চুপ্পু ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সেসময় বিশ্বব্যাংকের টিমটি দুই বার দুদকে আসে। তারা আমাদের বলে, আবুল হোসেনকে গ্রেপ্তার করতে হবে। তারা আরও দাবি করে, সেতু প্রকল্পের পরিচালকসহ অন্যদের গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিতে হবে এবং ফোর্সফুল ইন্টারোগেশন করতে হবে।’

দুদকের সাবেক এই কমিশনার বলেন, ‘আমাদের গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে যেটা পেলাম সে অনুযায়ী বিশ্বব্যাংক টিমকে জানানো হলো। দুদকের সকল প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আমাদের তদন্ত কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু আমরা কোনো দুর্নীতির চিত্র পেলাম না।’

২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারি দুদক এক প্রজ্ঞাপনে জানায়, পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের প্রমাণ মেলেনি। অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য ও রেকর্ডপত্রের আলোকে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় অভিযোগটি পরিসমাপ্তির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়েছে।

এছাড়া কানাডার একটি আদালতও পদ্মা সেতু দুর্নীতির মামলায় কোনো সত্যতা না পাওয়ায় সবাইকে নির্দোষ ঘোষণা দেয়।

প্রসঙ্গত, ব্যবসায়ী সৈয়দ আবুল হোসেন ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালে পর পর চারটি সাধারণ নির্বাচনে মাদারীপুর-৩ থেকে বাংলাদেশ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকারে তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।

২০০১ সালের নির্বাচনেও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সৈয়দ আবুল হোসেন। ২০০২ সালে সম্মেলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান।

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে মাদারীপুর থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে মহাজোট সরকারে যোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের ১৮তম জাতীয় সম্মেলনে আবারও তাকে দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগের মুখে ২০১২ সালের ২৩ জুলাই মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। ২০১৩ সাল পর্যন্ত সংসদ সদস্য থাকলেও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পাননি তিনি।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও দলের মনোনয়ন থেকে বাদ পড়েন সাবেক এই যোগাযোগমন্ত্রী।

(ঢাকাটাইমস/০৯জুন/ডিএম)