জনবল সংকটে বিপর্যস্ত রেলওয়ে কারখানার উৎপাদন সচল রেখেছে টিএলআর ব্যবস্থা

প্রকাশ | ১৫ জুন ২০২২, ১৬:১৫

মো. জাকির হোসেন, সৈয়দপুর (নীলফামারী)

চরম জনবল সংকটে বিপর্যস্ত দেশের বৃহত্তম সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা। তবে এর উৎপাদন কার্যক্রম সচল রাখতে মূল ভূমিকায় রয়েছে টেম্পোরারি লেবার রিক্রুটমেন্ট (টিএলআর) ব্যবস্থা। দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়োগের এই উদ্যোগের ফলে যথাসময়ে কার্য সম্পাদনসহ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষমতা অব্যাহত রাখতে পেরেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি। আর এটি সম্ভব হয়েছে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় শতভাগ আন্তরিকতা ও সততার মাধ্যমে দক্ষ শ্রমিক নিযুক্ত করার ফলে। 

বর্তমানে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার মঞ্জুরীকৃত ২৮৫৯ জন শ্রমিকের মধ্যে কর্মরত আছে মাত্র ৭২৮ জন। ২০১২-১৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৪৭৯ জনের মধ্যে ১৩৬৮, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৭৯১ এর মধ্যে ১০৪৩ জন। যা পর্যায়ক্রমে হ্রাস পেয়ে শূন্যপদ দাঁড়িয়েছে ২১৩১ জনে। চলতি ২০২২ সালেই পদশূন্যতা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৯০ শতাংশে। 

কারখানার ২৯টি সপের (সাব ওয়ার্ককসপ) প্রায় প্রতিটিতেই মঞ্জুরিকৃত শ্রমিক রয়েছে মাত্র ২০-২৫ ভাগ। প্রতিনিয়ত এই শ্রমিকরাও অবসরে যাচ্ছেন। যেমন ওয়াগন শপে ১৬৮ জনের মধ্যে আছেন মাত্র ২৪ জন। এই বছরই এর মধ্যে আরও ২০ জন অবসর নেবেন। অন্য সপগুলোরও একই অবস্থা। 

দীর্ঘ দিন থেকে নতুন নিয়োগ না দেওয়ায় এবং এভাবে দিনদিন শ্রমিক চলে যাওয়ায় চরম জনবল সংকট সৃষ্টি হয়। ফলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে উৎপাদনসহ সার্বিক কার্যক্রম। ক্যারেজ ও ওয়াগনের নিয়মিত ব্যবস্থাপনায় দেখা দেয় সিডিউল বিপর্যয়। বন্ধ হয়ে যায় বিশেষ ট্রেন রেক মেরামত ও বিদেশ থেকে আনা নতুন ট্রেনের এসেম্বলিং। 

এমন দুরবস্থায় নতুন জনবল নেয়ার মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার ক্ষেত্রে নিয়োগ প্রক্রিয়া সময় সাপেক্ষ ব্যাপার হওয়ায় এবং দক্ষ শ্রমিক পাওয়ার অনিশ্চয়তার পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে রেলওয়ে মন্ত্রণালয়। এই ব্যবস্থার আলোকে কাজ আছে মজুরি আছে ভিত্তিতে ইতোপূর্বে কারখানার অবসরপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ ও দক্ষ শ্রমিকদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। 

সে অনুযায়ী অর্থ বরাদ্দ সাপেক্ষে গত বছর ২০০ জন এবং চলতি বছর ৩০০ জন শ্রমিককে দৈনিক মজুরির চুক্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়। এক্ষেত্রে অবসর রেলওয়ে কর্মচারীদের প্রাধান্য দিয়ে তাদের মধ্যে শারীরিকভাবে এখনও কাজ করতে সামর্থ্যবান এবং বিগত কর্মজীবনে যারা কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন এমন ব্যক্তিকে নেয়া হয়েছে। 

এতে শতকরা ৮০ ভাগই দক্ষ ও অভিজ্ঞ শ্রমিক কাজ পেয়েছে। আর বাকি ২০ ভাগ নেয়া হয়েছে রেলওয়ে পরিবারের বাইরের কিন্তু কাজে পারদর্শী এবং নিয়োগকালীন হাতে কলমে নেয়া ব্যবহারিক (প্রাকটিক্যালী) পরীক্ষায় সঠিকভাবে উত্তীর্ণ। যারা মূলত যুব বয়সী এবং কর্ম উদ্যোমী। 

এই নবীনরা প্রবীণ দক্ষদের সঙ্গে থেকে সহযোগিতা করার পাশাপাশি নিজেরা আরও দক্ষ হয়ে উঠছে এবং লক্ষ্য পূরণে যথাযথ ভূমিকা রাখছে। যার ফলে এখন সৃষ্ট অচলাবস্থা দূরীভূত হয়েছে অনেকাংশে। সপে সপে ফিরে এসেছে কর্মচাঞ্চল্য। আবারও আগের মতই সরগরম রেলওয়ে কারখানা অঙ্গনের প্রতিটি কার্যালয়। 

এ প্রসঙ্গে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার সিডিউল দপ্তরের ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী (ইনচার্জ) মো. রুহুল আমিন বলেন, অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে পূর্ণ আন্তরিকতা ও পেশাদারিত্ব নিয়ে দুর্নীতি ও অনিয়মমুক্তভাবে টিএলআর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করায় এই কার্যক্রম বাস্তবায়নের সুফল পাওয়া যাচ্ছে। এজন্য কারখানার সাবেক ও বর্তমান বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক (ডিএস) স্যারদ্বয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। 

কারণ তাদের সততা, কঠোর নীতিবোধ আর পেশাগত একনিষ্ঠতার ফলে সব ধরনের চাপ ও ঝুঁকি উপেক্ষা করে ন্যায়সঙ্গতভাবে নিয়োগ কার্যক্রম সুষ্ঠু, সুন্দর ও সফলতার সাথে শেষ করা সম্ভব হয়েছে। তারা প্রত্যক্ষ তদারকি ও ব্যাপক যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে প্রকৃত দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবলকে প্রোডাকশন ও মেইনটেনেন্স কাজে নিয়োজিত করায় স্বল্প সময়েই গতি ফিরেছে কারখানার সার্বিক কর্মকাণ্ডে। 

এক প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা আরও বলেন, খণ্ডকালীন এই শ্রমিক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোনো প্রকার আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ একেবারেই বনোয়াট ও ভিত্তিহীন। কারণ এমনিতেই দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবল পাওয়া খুবই দুষ্কর। রেলওয়ে কারখানার মত উচ্চমাত্রার  টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কাজের ক্ষেত্রে এই অভাব আরও প্রকট।

তাই পারফেক্ট স্কিলহ্যান্ড পার্সন কর্তৃক কখনই দৈনিক মাত্র ৪ শত টাকা মজুরির স্বল্প মেয়াদের (৪৫ দিনের) এই কাজ অবৈধভাবে অর্থ দিয়ে নেয়ার প্রশ্নই আসে না। টাকা নিলে দক্ষ শ্রমিক নেওয়া সম্ভব হতো না বা পাওয়া যেতো না। আর এক্ষেত্রে যদি আর্থিক সুবিধা নিয়ে অদক্ষ শ্রমিককে নিয়োগ দেয়া হতো তাহলে কাঙ্ক্ষিত আউটটার্ন পাওয়াও কোনোভাবে সম্ভব হতো না।

কারখানার বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক (ডিএস) এর কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, টিএলআর-এ নিয়োগপ্রাপ্ত দুইধাপের ৫শ' শ্রমিকদের মধ্যে ওয়েল্ডিং সপে ৫০ জন, সিএইচআর সপে ৪০ জন, পেইন্ট সপে ৫০, বগি সপে ৪০, ওয়াগন সপে ৫০, ক্যারেজ সপে ৮০সহ বাকিরা অন্যান্য সপে নিয়োজিত। 

ক্যারেজ সপের ইনচার্জ মো. মোমিনুল ইসলাম বলেন, আমার সপে ৩৯৫ মজুরীকৃত পদের বিপরীতে মাত্র ৮৬ জন শ্রমিক আছেন। আমরা কর্মকর্তা পর্যায়ে ৬ জনের স্থলে ২ জন কর্মরত। এত কম সংখ্যক জনবল নিয়ে স্বাভাবিক কর্মপরিচালনায় অত্যন্ত বেগ পেতে হতো। এই সংকটকালে টিএলআর এর মাধ্যমে আমাদের কারখানার সাবেক দক্ষ কর্মচারীদের পেয়ে নব উদ্যোমে কাজ করছি। যে দুই একজন নতুন এসেছে তারাও বেশ পারদর্শী। 

তিনি বলেন, নবীন-প্রবীণের সম্মিলিত প্রয়াসে এখন সব কাজ যথাসময়ে সম্পাদন করতে পারছি। ফলে আমাদের নিয়মিত টার্গেট পূরণসহ বিশেষ কাজগুলোও করা সম্ভব হচ্ছে। যে কারণে গত বছরের দুই ঈদে ৬৫টি এবং এ বছরের গত ঈদুল ফিতরে অতিরিক্ত ৫০টি কোচ মেরামত নির্দিষ্ট সময়ের আগেই শেষ করে কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছি। এই কোচগুলো দিয়ে ২টি বিশেষ ট্রেন চালুসহ নিয়মিত ট্রেনে বাড়তি বগি সংযোজন করা হয়েছে। 

মেশিন টুলস্ সপে খণ্ডকালীন শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ইতোপূর্বে একই সপে মঞ্জুরীকৃত পদে চাকরি জীবন সমাপ্ত করে অবসর নেয়া মেশিনিস্ট আবু বকর জানান, টিএলআর প্রক্রিয়ায় দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ করছি। নতুন করে এ কাজে যোগদানে কোনো বেগ পেতে হয়নি। বরং দক্ষতা থাকায় কর্তৃপক্ষ আমাদের মতো অভিজ্ঞ শ্রমিকদের খুঁজে খুঁজে ডেকে এনেছেন। এই নিয়োগ নিয়ে বাণিজ্যের বিষয় বিভ্রান্তিকর প্রোপাগান্ডা মাত্র। 

একইভাবে অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন ওয়াগন সপের কর্মচারী মো. সালেহ। তিনি বলেন, টিএলআর সিস্টেমে শ্রমিক নেয়ায় আমরা যেমন বিনা পয়সায় কাজ পেয়েছি তেমনি কারখানার দক্ষ জনবলের অভাব পূরণ হয়েছে। এতে ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানের হারানো গৌরব ফিরে এসেছে। আগের মতো আবারও মেশিনের ঝনঝনানি আর শ্রমিকের আনন্দ উচ্ছ্বলতায় মুকরিত হয়ে উঠেছে সৈয়দপুর রেলওয়ে অঙ্গন।

ফজলে রাব্বী নামের সিএইচআর সপের নবীন শ্রমিক বলেন, আগামী অর্থবছরের টিএলআর কার্যক্রম অব্যাহত রাখা উচিত। বিশেষ করে নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মঞ্জুরীকৃত পদে নতুন জনবল আসার পর তারা আমাদের মতো এই দক্ষ শ্রমিকদের কাছ থেকে হাতে কলমে কাজ শিখে ওঠা পর্যন্ত থাকলে ভালো হবে। নয়তো কারখানার স্বাভাবিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়বে। যা কারও কাম্য নয়।

(ঢাকাটাইমস/১৫জুন/এআর)