স্বয়ংক্রিয়ভাবে কালো টাকা তৈরি হয় এমন আইন থাকা উচিত নয়

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ
| আপডেট : ১৯ জুন ২০২২, ১৮:৩০ | প্রকাশিত : ১৯ জুন ২০২২, ১৮:২৭

[বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বেশ সক্রিয়। তিনি প্রায়ই দেশের ও বিদেশের অর্থনীতি নিয়ে নানা ধরনের পোস্ট দেন। রবিবার আইনের কারণে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কালো টাকা তৈরির বিষয়ে একটি পোস্ট দেন এই অর্থনীতিবিদ।

পোস্টে তিনি যে আইনের কারণে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কালো টাকা তৈরি হয় এবং সৎ করদাতাদের কালো টাকার মালিক হতে বাধ্য করা হয় তেমন আইন থাকা উচিত নয় বলে মন্তব্য করেছেন। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সেই পোস্ট এখানে তুলে ধরা হলো]—

পত্রিকার সংবাদ অনুযায়ী মাননীয় অর্থমন্ত্রী সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন যে যাদের ঢাকা শহরে জমি বা ফ্ল্যাট আছে তারা সবাই কালো টাকার মালিক। কালো টাকা বলতে তিনি আয়কর রিটার্ন-এর “অপ্রদর্শিত” আয়কে বুঝিয়েছেন এবং বিশেষ করে গুলশান-বনানীর মতো অভিজাত এলাকার উদাহরণ দিয়েছেন। আশ্চর্যের বিষয় যে এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্তব্য নিয়ে কোনো আলোচনা চোখে পড়েনি। ডেভলপার কোম্পানিগুলোর সংগঠন (রিহ্যাব) বাজেটের প্রতিক্রিয়ায় ফ্ল্যাট বিক্রয়ের রেজিস্ট্রেশন ফি কমানোর দাবি করলেও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।

দেশে ব্যাপক হারে কর ফাঁকির প্রবণতা জানা কথা। কিন্তু অর্থমন্ত্রী জমি বা ফ্ল্যাট কেনা-বেচার বিদ্যমান আইনি প্রক্রিয়ায় একটি অসঙ্গতি উল্লেখ করে উক্ত মন্তব্যটি করেছেন। সরকার বিভিন্ন অঞ্চলের জমি বা ফ্ল্যাট হস্তান্তরের রেজিস্ট্রেশনের জন্য একটা দাম বেঁধে দিয়েছেন (জমি বা ফ্ল্যাটের আয়তন অনুযায়ী)।

অর্থমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন যে, গুলশান এলাকার জন্য এই বেঁধে দেয়া মূল্যের থেকে প্রকৃত মূল্য পাঁচ-ছয় গুণ বেশি। কাজেই যিনি ওই দাম দেখিয়ে বিক্রি করছেন তাঁর বিক্রয় থেকে পাওয়া আয়ের অধিকাংশের জন্য বৈধ উৎস আয়কর কর্তৃপক্ষকে দেখাতে পারবেন না এবং অপ্রদর্শিত থেকে যাবে। অর্থমন্ত্রীর মতে এভাবে আইনের অসঙ্গতি থেকে এমনিতেই কালো টাকা তৈরি হচ্ছে।

তবে অর্থমন্ত্রী সম্ভবত অসাবধানতাবশত একটি ভুল তথ্য দিয়ে সবাইকে ঢালাওভাবে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। বিক্রির রেজিস্ট্রেশনের জন্য যে দাম বেঁধে দেয়া আছে সেটি সর্বোচ্চ নয়, বরং নূন্যতম, যাতে অন্ততঃ এই মূল্যের ওপর উৎসে আয়করসহ রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত যাবতীয় ফি আদায় হয়। কিন্তু এর চেয়ে অনেক গুন বেশি প্রকৃত মূল্য দেখিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে তো কোনো বাধা নেই। ওইসব অভিজাত এলাকায় প্রকৃত মূল্যে বিক্রির রেজিস্ট্রেশন করে বিক্রয় থেকে পাওয়া পুরো অর্থ আয়কর রিটার্ন-এ প্রদর্শন করার নজির আমার কাছে আছে। আর অনেকেই যাঁরা এসব এলাকায় সরকারের কাছ থেকে জমি বরাদ্দ পেয়ে ডেভেলপার কোম্পানির মাধ্যমে এপার্টমেন্ট বিল্ডিং বানিয়ে ভাড়া দিচ্ছেন, তাঁরাও এপার্টমেন্ট বিক্রি না করে থাকলে এ ভাবে কালো টাকার মালিক হবার কথা নয়।তেবে অর্থমন্ত্রী সমস্যাটি ঠিকই চিহ্নিত করেছেন।

নীতিবান কোনো করদাতা প্রকৃত মুল্য দেখিয়ে ফ্ল্যাট বিক্রির রেজিস্ট্রেশন করতে চাইলেও ওই মূল্য দেখিয়ে কিনতে আগ্রহী ক্রেতা খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়। রেজিস্ট্রেশন করার বেশি ফী তো আছেই, তার ওপর ওই দাম পরিশোধ করার মতো বৈধ বা “প্রদর্শিত” আয় আছে এমন ক্রেতা অনেক সময় খুঁজে পাওয়া যায় না। সেটাও অর্থমন্ত্রীর সঠিক অনুমান।

অথচ সমস্যাটির সমাধান কঠিন কিছু নয়। জরিপের মাধ্যমে পাওয়া তথ্য থেকে এলাকা ভেদে জমি ও ফ্ল্যাটের কাঠা বা বর্গফুট প্রতি প্রকৃত বাজার দাম কত তার ভিত্তিতে কিছু সময় অন্তর অন্তর রেজিস্ট্রেশন এর জন্য নূন্যতম দাম অন্তত আর একটু বাস্তবসম্মত অঙ্কে নির্ধারণ করা যায়।

এবং যদি রাজস্ব আয়ের ক্ষতি করেও ডেভেলপার কোম্পানিগুলোর দাবি মানতেই হয়, সে ক্ষেত্রে বিক্রয় দামের অনুপাতে রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত ফীসমূহের হার কমিয়ে দিলেই হয় (কয়েক বছর আগে এই ফি দাবির মুখে অনেকটা কমানো হয়েছিলো)। কিন্তু এমন আইন নিশ্চয়ই থাকা উচিত নয় যার মাধ্যমে অনেকটা স্বয়ংক্রিয় ভাবেই কালো টাকা তৈরি হয় এবং সৎ করদাতাদের কালো টাকার মালিক হতে অনেকটা বাধ্য করা হয়।

তবে ক্রেতা ও বিক্রেতা দুপক্ষই প্রকৃত মূল্য প্রদর্শন করতে আগ্রহী হবেন এরকম নৈতিক আচরণ তৈরি হওয়াই সবচেয়ে কাম্য। সবকিছুই আইন দিয়ে হয় না, এগুলো সামাজিক মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :