‘আপনার আচরণ সভ্য রাষ্ট্রের জন্য কলঙ্ক’: ইউএনওকে হাইকোর্ট

প্রকাশ | ২১ জুন ২০২২, ১৯:৫৮

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

আদালতের সমন নিয়ে নোটিশ জারিকারকরা যাওয়ার পর তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে বিচারের হুমকি দেওয়ায় ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ইউএনও মো. রেজাউল করিমকে ভর্ৎসনা করেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, ‘আপনি একটি পক্ষ নিয়ে যে আচরণ করেছেন তা সভ্য রাষ্ট্রের জন্য একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে।’
মঙ্গলবার বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।
আজ শুনানির শুরুতে ওই ঘটনার জন্য ইউএনও মো. রেজাউল করিম ও নাজির উকিল মিয়া নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আদালতে ইউএনও-নাজিরের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ও ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়।
আদালত তখন বলেন, ‘আপনাকে ক্ষমা করলে আমরা আটকে যাব। আদালত সবার ওপরে। আদালতের আদেশ সবার মানতে হয়। আপনি আদালতের আদেশ মানেননি। আদালতের সমন নিয়ে নোটিশ জারিকারকরা আপনাদের কাছে গিয়েছিল। আপনার উচিত ছিল তাকে ধন্যবাদ দেওয়া। অথচ কী দুর্ব্যবহার না করলেন! কত অজুহাত দেখালেন! আপনি যে আচরণ করলেন তা সভ্য রাষ্ট্রে কলঙ্ক লেগে গেল। আপনি একটা ছোট বিষয় হ্যান্ডেল করতে পারেন না। কীভাবে জনসেবা করবেন? একটি কথা মনে রাখবেন, আইন আদালত আছে বলেই আপনি সম্মান পান। আপনি যদি আইন না মানেন আপনাকে কেউ মানবে না।’
ইউএনওকে উদ্দেশ্য করে হাইকোর্ট আরও বলেন, ‘আপনি নিজের ভবিষ্যৎ নিজে নষ্ট করেছেন। আদালত অবমাননার ঘটনায় আদালতে আসতে হয়েছে আপনাকে। আপনার ক্যারিয়ারে একটি স্পট পড়ে গেল। আমরা যদি একটি লাইন লেখে দিই আপনার ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যাবে। ভবিষ্যতে এ ধরনের আচরণ করবেন না। আপনার দায়িত্ব-কর্তব্যের প্রতি নজর রাখবেন। আদালতকে সম্মান না করলে আপনি কখনও সম্মান পাবেন না।’
আদালত বলেন, ‘আদালতের জারিকারকের সঙ্গে আপনাদের দুর্ব্যবহারের ঘটনা পত্রিকায় এসেছে। সাধারণ মানুষ কী ভাবছে জানেন? মানুষ ভাবছে বিচার বিভাগ আর নির্বাহী বিভাগের মধ্যে মারামারি লেগে গেছে। এটা শোভনীয় নয়। বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকতে হবে।’
নাজির উকিল মিয়াকে উদ্দেশ করে আদালত বলেন, ‘আপনি মূল অপরাধী। আপনি সিনক্রিয়েট করেছেন। খুব খারাপভাবে মিসগাইড করেছেন।’
ইউএনওর আইনজীবী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদকে আদালত বলেন, ‘আপনি আইনমন্ত্রী ছিলেন। একজন সম্মানিত ব্যক্তি। দুর্ভাগ্যবশত আজ এই মামলায় আপনি এসেছেন।’
শুনানির শেষে আদালত ইউএনও ও নাজির উকিল মিয়াকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দেন। একইসঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে জারি করা আদালত অবমাননার রুলের আদেশের জন্য আগামী রবিবার দিন ধার্য করেন।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, ‘ছরোয়ার শেখ বনাম নির্বাহী প্রকৌশলী, সওজ’ মামলাটি ফরিদপুরের বোয়ালমারী সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে বিচারাধীন। এ মামলার নোটিশ জারির জন্য ফরিদপুর জেলা জজ আদালতের নেজারত শাখার জারিকারক কামাল হোসেন ও মেহেদী হাসান গত ২৭ এপ্রিল দুপুর আড়াইটার দিকে বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে যান। ওই কার্যালয়ের নাজির উকিল মিয়াকে নোটিশ গ্রহণের অনুরোধ করেন তারা।
কিন্তু নোটিশ গ্রহণ না করে ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে অপেক্ষায় রাখেন। বিকাল ৪টায় পুনরায় নাজিরের কাছে গেলে তাদেরকে ওপর তলায় গিয়ে বসতে বলেন। এ সময় নোটিশ জারিকারকরা বলেন, তাদের অন্যত্র নোটিশ জারি করতে হবে। তখন উকিল মিয়া বলেন, তাতে তার কী, জজ কোর্টের নোটিশ না রাখলে তার কী হবে? তিনি এর চেয়ে বড় কাজে ব্যস্ত আছেন। তিনি নোটিশটি পাশের টেবিলে দিতে বলেন। কিন্তু পাশের টেবিলের দায়িত্বরত কর্মচারী নোটিশ বুঝে নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এ সময় জারিকারক মেহেদী হাসান নোটিশ জারি না করে চলে আসার জন্য কামাল হোসেনকে বলেন। এছাড়া বিষয়টি কোর্টকে অবহিত করবেন মর্মে বলেন।
তখন উকিল মিয়া বলেন, জজের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। আমরা নির্বাহী বিভাগের লোক। নোটিশ না রাখলে আমাদের কিছু হবে না। তখন জারিকারক মেহেদী হাসান ঘটনাস্থল ত্যাগ করার জন্য পুনরায় কামাল হোসেনকে বললে ওই সময় নাজির উকিল মিয়া নোটিশ বুঝে নেন। ইতোমধ্যে উক্ত অফিসের একজন কর্মচারী বিষয়টি ইউএনওকে অবহিত করলে তিনি জারিকারকদের তার কক্ষে ডেকে নিয়ে দরজা আটকে জেরা করতে থাকেন। একইসঙ্গে ইউএনও অফিসের স্টাফদের সঙ্গে বাজে ব্যবহারের অভিযোগ তুলে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে তাদের সাজা প্রদানের হুমকি দেন ইউএনও।
পরে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ সংশ্লিষ্ট জেলার বিচার প্রশাসনকে লিখিতভাবে জানান জারিকারকদ্বয়। এ অভিযোগের অনুলিপি আইন ও বিচার বিভাগের সচিব ও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্টার জেনারেল বরাবর পাঠান ফরিদপুরের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মো. আকবর আলী শেখ। এরপর বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আসলে আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে উপরোক্ত আদেশ দেন।
এরপর গত ৭ জুন আদালতের নোটিশ জারিকারকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে বিচারের হুমকি দেওয়ার অভিযোগে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ইউএনও মো. রেজাউল করিম ও নাজির উকিল মিয়াকে তলব করেন হাইকোর্ট। বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে এ আদেশ দেন। একইসঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না তা জানতে চেয়েও রুল জারি করেন আদালত। ওই দিন আদালতে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায় উপস্থিত ছিলেন।
(ঢাকাটাইমস/২১জুন/আরকেএইচ)