মৌলভীবাজারে আরও ২৫ ইউনিয়ন প্লাবিত, খাদ্য ও সুপেয় পানির সংকট

আব্দুল বাছিত বাচ্চু, মৌলভীবাজার
| আপডেট : ২৩ জুন ২০২২, ১৮:০১ | প্রকাশিত : ২৩ জুন ২০২২, ১৮:০০

মৌলভীবাজারে মহাসড়ক ভেঙে কুশিয়ারার পানি লোকালয়ে প্রবেশ করছে। বাড়ছে হাকালুকি, কাউয়া দিঘী ও হাইল হাওরের পানি। প্রধান প্রধান হাওরের পানি বেড়ে কুলাউড়া জুড়ী, বড়লেখা, রাজনগর, মৌলভীবাজার সদর ও শ্রীমঙ্গল উপজেলায় অন্তত ২৫টি ইউনিয়নে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। পুরো জেলায় পানিবন্দি লোকের সংখ্যা এখন ৩ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। পাশাপাশি বন্যা কবলিত এলাকায় সরকারি ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত থাকলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল বলে জানান স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। ফলে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে ৩ লক্ষাধিক পানিবন্দি মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। গোচারণ ভূমি তলিয়ে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে গোখাদ্যের সংকট।

মৌলভীবাজার সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়নের স্থানীয় জনসাধারণ জানায়, বুধবার বিকালে ইউনিয়নের হামরকোনা নামক স্থানে ঢাকা সিলেট পুরাতন মহাসড়কে বিশাল ভাঙন দেখা যায়। এই ভাঙন দিয়ে প্রবল বেগে কুশিয়ারা নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করছে। স্থানটি সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার মিলনস্থল হওয়ায় কুশিয়ারা নদীর পানি খলিলপুর ইউনিয়ন হয়ে আবার হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলায় যাচ্ছে।

মৌলভীবাজার সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জিয়া উদ্দিন ঢাকা টাইমসকে জানান, শেরপুর এলাকায় অনেক স্থানে কুশিয়ারা নদীর বাঁধ ভেঙে এবং ওভার ফ্লো করে খলিলপুর ইউনিয়নে ঢাকা সিলেট পুরাতন সড়কের ভেতরে পানি জমে ছিলো। এই পানির বেগে বুধবার বিকেলে খলিলপুর ইউনিয়নের হামরকোনা নামক স্থানে ঢাকা সিলেট পুরাতন মহাসড়কে ভাঙন দেখা দেয়। পরে পানির প্রবল তোড়ে তা বেড়ে এখন অন্তত ৬০ ফুট বিস্তৃত হয়েছে।

তিনি আরও জানান, ভাঙন বেড়ে না যাওয়ার জন্য সড়ক বিভাগের লোকজন চটের বস্তায় মাটি ভরে ভাঙনের দুই পাশে দিচ্ছেন।

মৌলভীবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবরিনা রহমান বাঁধন ঢাকা টাইমসকে জানান, শেরপুর এলাকায় সড়ক বিভাগের পুরাতন রাস্তা ভেঙে কুশিয়ারা নদীর পানি হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার দিকে যাচ্ছে। তবে হাইল হাওরের পানি বেড়ে আমতৈল, কনকপুর, খলিলপুর ইউনিয়নের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।

তিনি জানান, বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত সদর উপজেলায় ৯টি আশ্রয়কেন্দ্র চালু করা হয়েছে।

কামালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আপ্পান আলী ঢাকা টাইমসকে জানান, মৌলভীবাজারে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আরও ৩২টি ঘরে কোমর পর্যন্ত পানি উঠেছে। তিনি বলেন, এসব ঘরের লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়া হয়েছে।

এ নিয়ে সদর উপজেলায় মুজিব বর্ষের আশ্রয়ণ প্রকল্পের শতাধিক ঘরে পানি উঠলো।

খলিলপুর ইউনিয়নের স্থানীয় লোকজন জানান, ইউনিয়নের ব্রাহ্মণগ্রাম, শেরপুর মুক্তিনগর (নতুনবস্তি), হামরকোণা এই ৪টি গ্রামের অন্তঃত হাজার খানেক পরিবার পানিবন্দি রয়েছেন। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন স্থানে নির্মাণাধীন ঘরবাড়িতেও পানি উঠেছে। হাওরের পানি বেড়ে বহু পরিবার শেরপুর আজাদ বখত উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, শামসুন্নাহার বিদ্যাপীঠসহ বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে নিরাপদ আশ্রয়ে আছে।

কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান মনির ঢাকা টাইমসকে জানান, হাকালুকি হাওরের মধ্যবর্তী এই ইউনিয়নের সবকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানি এখনো বাড়ছে।এখন নলকূপগুলো তলিয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানীয় জলের সংকট দেখা দিয়েছে।

তিনি আরও জানান, তার ইউনিয়নের বন্যা কবলিত মানুষের মাঝে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হলেও অনেক অসচেতন লোক এগুলো দিয়ে পানি খেতে চায় না। তারা দূষিত পানি পান করে পানি বাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

এদিকে হাকালুকি হাওরের পানি বেড়ে কুলাউড়া - বরমচাল রেলওয়ে সেকশনে অন্তঃত ৫টি স্থানে রেল লাইনে পানি ওঠায় ট্রেন চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। রেল বিভাগ এসব স্থানে ট্রেনের গতি নিয়ন্ত্রণ করে এখনো ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রেখেছে বলে জানান সহকারী স্টেশন মাস্টার বাবু নামে সরকার।

বড়লেখা উওপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার মুদাচ্ছির ঢাকা টাইমসেরকে জানান, বড়লেখার ১০টির মধ্যে ৯ টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। বড়লেখা উওপজেলার সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ৭ নম্বর তালিমপুর ইউনিয়ন। সেখানের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা এখলাছুর রহমান জানান, তার ইউনিয়নের পুরো ৪০ হাজার মানুষ বন্যা কবলিত। তারা খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানীয় জলের সংকটে রয়েছে। এখন পর্যন্ত ৩০০ প্যাকেট শুকনো খাবার ছাড়া আর কিছু দেওয়া হয়নি। সরকারিভাবে ৩ টন চাল বরাদ্দ করা হলেও পুরো ইউনিয়নের জন্য অন্তত ৫০ টন চালের প্রয়োজন রয়েছে ।

কুলাউড়া রেলওয়ে জংশন স্টেশনের সহকারী স্টেশন মাস্টার বাবু হরিপদ সরকার ঢাকা টাইমসকে জানান, গত কয়েকদিন ধরে হাকালুকি হাওরে পানি বাড়ছিলো। সোমবার কুলাউড়া বরমচাল সেকশনে পিলার নম্বর তিনশত বত্রিশের ৭ থেকে তিনশত পঁয়ত্রিশের ৫, তিনশো ছত্রিশের ৩ থেকে তিনশো ছয়ত্রিশের ৮,দুইশো ঊনত্রিশের ৫ থেকে দুইশো পয়ত্রিশের ৭, দুইশো তেত্রিশের ৫ থেকে দুইশো ছত্রিশের ২,তিনশো ছয়ত্রিশের ৮ থেকে তিনশো উনচল্লিশের শুন্য পর্যন্ত এলাকায় পানি রেল লাইনের উপরে উঠেছে।ফলে এসব স্থানে ট্রেন চলাচল ঝুকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।

তিনি ঢাকা টাইমসকে আরও জানান, রেলওয়ে প্রকৌশল বিভাগ সেখানে অস্থায়ী নিরাপত্তা চৌকি বসিয়ে ১০ কিলোমিটার থেকে সর্বোচ্চ সর্বো ৩০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রেখেছে। আর পানি বাড়লে হয়তো ট্রেন চালানো সম্ভব নাও হতে পারে।

এদিকে গত কদিনের বন্যায় মৌলভীবাজার জেলার ৭ উপজেলার ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মৌলভীবাজার জেলার ভারপ্রাপ্ত উপ পরিচালক মুহাম্মদ সামছুদ্দিন ঢাকা টাইমসকে জানান, মৌলভীবাজার জেলার ৭ উপজেলায় ১১ হাজার ১ শ' ৭১ হেক্টর জমির নতুন আউশ ধান,৩ শ' ৬২ হেক্টর জমির বোনা আমন এবং ৮ শ' হেক্টর জমির সবজি নষ্ট হয়েছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ দেড় কোটি টাকার কম হবে না।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার দপ্তরের ভেটেনারি অফিসার ডা. এ জেড এম ওয়াহিদুজ্জামান ঢাকা টাইমসকে জানান, ৭ উপজেলার প্রাপ্ত রিপোর্ট অনুযায়ী এই বিভাগের ক্ষয়ক্ষতি ১ কোটি ১ লাখ ৩১ হাজার ৫০০ টাকা।

তিনি আরও জানান, ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে পারে।

কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা ফেরদৌস ঢাকা টাইমসকে জানান, কুলাউড়া উপজেলার হাকালুকি হাওর এলাকায় ভুকশিমইল, বরমচাল, ব্রাহ্মণবাজার, ভাটেরা, জয়চন্ডী কাদিপুর, কুলাউড়া পৌরসভা ও সদর ইউনিয়নের বন্যা কবলিত এলাকায় শিশুসহ বিভিন্ন বয়সী লোকজন জর সর্দি কাশি ও পেটের সমস্যায় ভুগছেন। আমরা তাদের স্বাস্থ্যসেবা ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিচ্ছি।

মৌলভীবাজার জেলার সিভিল সার্জন চৌধুরী জালাল উদ্দীন মুর্শেদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, বন্যাত্তোর স্বাস্থ্য সমস্যা মোকাবেলায় আমাদের ৭৫ টি মেডিকেল টিম মাঠে কাজে নেমেছে। তারা স্বাস্থ্য শিক্ষা ও সেবা দিয়ে যাচ্ছে।

জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের বন্যা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জানায়, ৭ উপজেলার ৪২ ইউনিয়নের ৪০ হাজার পরিবার বন্যা কবলিত হয়েছে। বন্যায় ৩ জনের মৃত্যুর পাশাপাশি ১ হাজার ৩০ টি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান ঢাকা টাইমসকে জানান, মৌলভীবাজারে বন্যা কবলিত মানুষের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ৪৪০ মেট্রিকটন চাল ও নগদ ১৮ লাখ ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে । পাশাপাশি ১৭০০ প্যাকেট শুকনো খাবার এবং ১০ হাজার পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে। ত্রাণ বিতরণে কারো কোনো গাফিলতি পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

(ঢাকাটাইমস/২৩জুন/এআর)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :