একটি অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন এবং একটি স্বপ্নপূরণ

কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ
| আপডেট : ২৫ জুন ২০২২, ০০:৫৪ | প্রকাশিত : ২৫ জুন ২০২২, ০০:৪৩

সেই কোন অতীত থেকে পদ্মা নদী বাংলার বুক চিরে বয়ে চলেছে নিরবধি। পদ্মা নদী বাংলাদেশের ভৌগোলিক বাস্তবতার অংশ। আর অবশ্য নদীটি আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজ, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতির অনিবার্য অনুষঙ্গ।

আমরা জানি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পদ্মাভক্ত ছিলেন। পদ্মা তাঁকে দিয়েছিল লেখার অনেক প্রেরণা ও বিষয়বস্তু। তিনি পদ্মাকে ঘিরে একসময় ‘ঘর’ বেঁধেছিলেন বলা যায়। এই নদীর বৈচিত্র্যময়তা উৎসারিত বিভিন্ন চিন্তা-ভাবনাসংবলিত তাঁর কত লেখা আছে আমার জানা নেই। সে বিষয় আমার এই লেখার উপজীব্যও নয়। তবে তাঁর একটি কবিতার কথা উল্লেখ করতে চাই। কবিতাটির শিরোনাম ‘পদ্মায়’। নদীটির বহমানতা ও এর পানির স্বচ্ছতা এবং নদীটিকে ঘিরে মানুষ, পাখি, ইলিশ মাছ এবং অন্যান্য জীবের প্রাণচঞ্চল বসবাস বা আনাগোনা, নৌকা চলাচল, পদ্মাপারের হাটবাজার এবং পদ্মার ওপর মেঘের গুরু গুরু ডাকসহ অন্যান্য অনেক বিষয় তাঁর এই কবিতায় অসাধারণভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে। তাঁর নিজের পদ্মাপ্রীতির বিষয়ও উঠে এসেছে কবিতাটির প্রথম লাইনেই: ‘আমার নৌকো বাঁধা ছিল পদ্মা নদীর পারে।’

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম পদ্মার ঢেউয়ের কাছে ‘বঁধূয়ার’ সঙ্গে প্রেম-বিরহের কথা জানিয়েছেন তাঁর কালজয়ী গানে:

“পদ্মার ঢেউ রে ̶

মোর শূন্য হৃদয়-পদ্ম নিয়ে যা, যা রে

এই পদ্মে ছিল রে যার রাঙা পা

আমি হারায়েছি তারে॥

........

যদি দেখিস তারে, দিস এই পদ্ম তার পায় বলিস, কেন বুকে আশার দেয়ালি জ্বালিয়ে

ফেলে গেল চির-অন্ধকারে।”

পদ্মা নদীর মাঝির কথা নানাভাবে বিভিন্ন জন বর্ণনা করেছেন। এখানে স্মরণে আনতে চাই, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’। এই উপন্যাসের উপজীব্য জেলে ও মাঝিদের জীবনচিত্র। তাদের জীবনের বাস্তবতা, সুখ-দুঃখসহ বিভিন্ন দিক পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে তাঁর বর্ণনায়।

অন্নদাশংকর রায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধুর অবিসংবাদিত নেতৃত্ব ও কৃতিত্বের স্থায়িত্ব পদ্মার বহমানতার নিরিখে দেখেছেন। তিনি লিখেছেন:

‘যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরি যমুনা বহমান ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’

কাজেই পদ্মা নদী বাংলার ভৌগোলিক-প্রাকৃতিক গঠনে ও বাঙালির জীবনে ও মননে স্থায়ী আসন দখল করে আছে সেকাল-একাল সব কালে। এই নদী পারাপারের মাধ্যম এ যাবৎ ছিল নৌকা, ট্রলার, স্পিডবোট, ফেরি ইত্যাদি। এসব যানে এক পাড়ে ওঠা এবং অপর পাড়ে নামা অনেক সময় অসহনীয় সময়সাপেক্ষ এবং কষ্টদায়ক। বিশেষ করে উল্লেখ্য, নৌকা ও স্পিডবোট পদ্মার ঢেউ-এ ভীতিকরভাবে আছাড় খেতে থাকে। আমি ব্যক্তিগতভাবে স্পিডবোটে পদ্মা পার হতে এ রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। ভয়ও পেয়েছি। আর ফেরিতে মোটরগাড়ি, বাস, ট্রাক ও অন্যান্য যানের পারাপারে নানা হাঙ্গামা ও দীর্ঘ সময় ব্যয় হয়। পণ্য পরিবহনে অধিক সময় ব্যয় হওয়া বাজার ব্যবস্থায় একটি বড় রকমের অসংলগ্নতা সৃষ্টি করে। শাক-সবজি পচে যেতে পারে অথবা মানসম্পন্ন থাকে না।

পদ্মার কারণে ভৌগোলিকভাবে বিভক্ত বাংলাদেশের মানুষ এ রকম নানা সমস্যায় জর্জরিত থেকেছে এতকাল। সহজ যোগাযোগের মাধ্যমে সারাদেশকে যাতে সংযুক্ত করা যায় সেজন্য পদ্মার ওপর সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। নিঃসন্দেহে এই সেতু দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করবে। মোংলা সমুদ্রবন্দরের ব্যবহার বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।

বস্তুত, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে সুসংহত ও ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে এই সেতু উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে। পাশাপাশি সেতুটি নদীটির উপর্যুক্ত এবং অন্যান্য উপযোগিতায় কোনো ঘাটতির কারণ হবে না, বরং নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং ফলে সেই উপযোগিতাগুলো আরো সমুন্নত হবে বলে ধারণা করা যায়।

বাংলাদেশ একটি খুবই ঘন বসতিপূর্ণ দেশ। ২০১৯ সালের তথ্যমতে এদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১,১২৫ জনের বাস। এর গভীরতা অনুধাবন করার জন্য অন্য কয়েকটি দেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব উল্লেখ করা যায়। প্রায় একই সময়ে এই সংখ্যা ভারতে ৪৬৪ জন, পাকিস্তানে ২৮৭ জন, চীনে ১৫০ জন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৩৬ জন, রাশিয়ায় ৯ জন।

নিশ্চয়ই উন্নয়ন অর্জনের পথে জনসংখ্যার বিশালত্ব একটি প্রতিবন্ধকতা। তবে বাংলাদেশের সামনে জনমিতিক সুযোগও রয়েছে, যেহেতু তরুণ প্রজন্ম দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এদের শক্তিকে যথাযথভাবে ব্যবহার করা গেলে দেশের অগ্রগতিতে আরো গতি আসবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আবার পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে বৃহৎ জনসংখ্যা ও উঁচু মাত্রার ঘনবসতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি।

জনসংখ্যার আধিক্য থাকায় এবং যেহেতু পদ্মা সেতু দেশের সব অঞ্চলের মধ্যে সহজ-যোগাযোগের সুযোগ সৃষ্টি করবে, তাই এই সেতুর ব্যবহার উঁচু মাত্রায় ঘটবে। অসংখ্য মোটরগাড়ি, বাস, ট্রাক এবং অন্যান্য যান উভয় অভিমুখে চলাচল করবে। এর একটা দিক হচ্ছে যে, পদ্মা সেতু নির্মাণের খরচ যৌক্তিক সময়ের মধ্যে উঠে আসবে বলে ধরে নেয়া যায়। বস্তুত উন্নয়ন উপকরণ ও উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর পরিবহন পদ্মার দুই পারের সংলগ্ন অঞ্চলের মধ্যেই নয়, বরং এগুলো দেশের যেকোনো স্থান থেকে যেকোনো স্থানে আনা-নেয়া সহজতর এবং অপেক্ষাকৃত কম খরচ ও সময়সাপেক্ষ হবে। তাই এই সেতু দেশের আঞ্চলিক এবং সার্বিক উন্নয়নে প্রভুত ভূমিকা রাখবে।

পদ্মা সেতুর সুফল যথাযথভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাতে পৌঁছাতে পারে সেজন্য দেশের সর্বত্র নির্বিঘ্নে মালামাল পরিবহনের অবকাঠামো ও আবহ তৈরি করতে হবে। এছাড়া এই সেতুর কারণে দেশের যেকোনো স্থান থেকে প্রতিবেশী এবং অন্যান্য দেশে যাতায়াত এবং তাদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করা সহজতর হবে। এসবই দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে অবদান রাখবে। অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন ঘটেছে, পদ্মা সেতুর দুই দিকেই সংলগ্ন এলাকায় অনেক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গড়ে উঠবে বলে ধরে নেয়া যায়। প্রাথমিক অবস্থায় এগুলো অতিক্ষুদ্র বা ক্ষুদ্র হতে পারে; সেবাধর্মী এবং উৎপাদনমুখী হতে পরে। যেমন হোটেল, রেস্টুরেন্ট, গাড়ি মেরামত, মোবাইল মেরামত, আকর্ষণীয় পোশাক এবং ঘর বা অফিস সাজানোর পণ্য সামগ্রীর কারখানা ও দোকানপাট গড়ে উঠতে পারে।

হোটেল, রেস্টুরেন্ট কিছু কিছু ব্যবসা ইতোমধ্যে গড়ে উঠতে শুরু করেছে। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে অনেক দর্শনার্থীর ব্যাপক আনাগোনা নিশ্চয়ই ঘটবে। তাই পর্যটন শিল্পের এক ব্যাপক সম্ভাবনার ঠিকানা উন্মোচিত হবে বলে ধারণা করা যায়। আগে থেকে কোথায় কীভাবে কোন পণ্য বা সেবার জন্য উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে তা নির্ধারণ করে দিলে আগ্রহী উদ্যোক্তারা পরিকল্পিতভাবে উদ্যোগগুলো গ্রহণ করতে পারবে। আর অবশ্য তাদের যে ধরনের সেবা (বিদ্যুৎ, পানি ও অন্যান্য সেবা, অবকাঠামো) লাগবে সেগুলোর প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে আশপাশের এলাকাগুলোর দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষদের উৎসাহিত করা হলে তা উন্নয়নে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে ইতিবাচক অবদান রাখবে।

কি উন্নত, কি উন্নয়নশীল সব দেশেই যোগাযোগ এবং অন্যান্য অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বাংলাদেশের পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে যে বিশ্লেষণ আমি উপরে দেয়ার চেষ্টা করেছি, তার ভিত্তিতে বলা যায় যে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এই সেতুর কারণে জাতীয় উৎপাদে (GDP) বৃদ্ধি প্রাক্কলিত এক শতাংশ থেকে অনেক বেশি হবে, দুই শতাংশ বা ততোধিক হতে পারে। এ ছাড়া পদ্মা সেতু দেশের সংস্কৃতি বিকাশেও যোগাযোগ সম্প্রসারণের মাধ্যমে অবদান রাখতে পারে। অবশ্যই বাঙালির চিরায়ত বৈশিষ্ট্যসমূহ বজায় রেখেই আর্থ-সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বিকাশ কাম্য।

পদ্মা সেতুর জন্য প্রথমে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করার সিদ্ধান্ত নেয়। সঙ্গে ছিল এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির কথিত অভিযোগ এনে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করবে না বলে ২০১২ সালের জুন মাসে জানায়। সহযোগী অন্যান্য সংস্থাও এই প্রকল্পে অর্থায়ন থেকে সরে যায়। কানাডার একটি আদালত বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে ঘোষণা করে ২০১৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশ বিজয়ী হয়ে মাথা আরো উঁচু করে দাঁড়ায়।

বিশ^ব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে যাবার ঘোষণার স্বল্প সময় পরই ২০১২ সালের জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেন বাংলাদেশ নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি করবে। আজ সেই সেতু বাস্তব সত্য। যেদিন শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করার ঘোষণা দেন, সেদিন সারা বিশ্বে এই বার্তা চলে যায় যে, বাংলাদেশকে আর খেয়াল-খুশিমতো খেলানো যাবে না। আর বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে কানাডার কোর্টের রায়ের পর বাংলাদেশের অবস্থান আরো দৃঢ় হয়।

বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে স্বকীয়ভাবে, নিজেদের চিন্তা-ভাবনায়, বাস্তবতার নিজস্ব মূল্যায়নে এবং নিজস্ব পরিকল্পনা ও কর্মসূচি অনুযায়ী। সেই আঙ্গিকে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতেই পারে প্রয়োজনে, তবে চাপিয়ে দেয়া কোনো চিন্তাভাবনা ও শর্ত গ্রহণ করে নয়। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের অবস্থান এখন অনেক মর্যাদার এবং সম্মানের। তা আরো উচ্চতায় নিয়ে যেতে বাংলাদেশকে আগামী দিনে সচেষ্ট থাকতে হবে।

এই লেখার শুরুর দিকে উদ্ধৃতিগুলো বিভিন্ন বিষয় থেকে দেখা যায় যে, নিজেদের মতো করে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল তাঁদের কবিসত্তার অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে পদ্মাকে দেখেছেন এবং তাঁদের অভিব্যক্তি ও বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই নদীকে কেন্দ্র করে যাদের জীবন-যাপন, তাদের জীবনগাথা তুলে এনেছেন ঔপন্যাসিকের দৃষ্টিকোণ থেকে। অন্নদাশংকর রায় এই নদী ও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে ঘিরে একটি অসাধারণ উক্তি করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান সময়ে তার জননেতৃত্বের দূরদর্শিতায় পদ্মার ওপর সেতু নির্মাণের ব্যবস্থা করে, এই নদী যোগাযোগের ক্ষেত্রে দেশকে যে বিভক্ত করে রেখেছিল, তা দূর করে দেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতির সুযোগের অভূতপূর্ব সম্প্রসারণ ঘটিয়েছেন। সব মিলিয়ে বাংলার পদ্মা আর পদ্মার বাংলা আরো ঘনিষ্ঠভাবে মূর্ত হলো।

এই বৃহৎ প্রকল্প অর্থাৎ পদ্মা সেতু নির্মাণে নিজস্ব অর্থায়ন এবং বাস্তবায়ন করার পথে কারিগরি, অর্থায়ন এবং ব্যবস্থাপনাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কার্যক্রমের সমন্বয় ইত্যাদি বিষয়ে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে। এ রকম অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে অধিকতর দক্ষতার সঙ্গে প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই কাজে লাগবে। বিশেষ করে, প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ও অর্থায়নের প্রাক্কলন সঠিকভাবে করার ক্ষেত্রে।

সেতুটি বাংলাদেশের শুধু এক গৌরবোজ্জ্বল অর্জনই নয়, বিশ্বপরিমণ্ডলে বাঙালির মর্যাদারও প্রতীক এবং একই সাথে এটি দেশের উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখবে। সাড়া জাগানো পদ্মা সেতু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৫ জুন ২০২২ উদ্বোধন করছেন। নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণের তিনি স্বপ্নদ্রষ্টা এবং তারই নেতৃত্বে এটি বাস্তবে রূপ লাভ করেছে। জাতি তার কাছে কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। আমার প্রত্যাশা এই যে, বর্তমান দশক শেষে অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়ন এবং উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে আগামী বছরগুলোতে দেশটি দৃপ্তপদে এগিয়ে যাবে।

এই লেখা শেষ করার আগে পদ্মাকে ঘিরে অন্য একটি বিষয়ে কিছু কথা বলতে চাই। সারা বছর ধরে প্রমত্তা পদ্মার অতীতের সেই রূপ এখন আর নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হিমালয়ে বরফ কমে যাওয়ায় (যা শুষ্ক মৌসুমে এই নদীর পানি প্রবাহের মূল উৎস) এবং উজানে পদ্মার উপনদীগুলো থেকে ব্যাপক পানি উত্তোলনের কারণে শুষ্ক মৌসুমে পদ্মা বাংলাদেশে একটি সাধারণ নদীতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। অনেক স্থানে একটি খালের পর্যায়ে নেমে যায়। ফলে বাংলাদেশে, বিশেষত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল তীব্র পানি সংকটে পড়ে। বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে চিহ্নিত সুন্দরবন মিঠা পানির সংকটে ক্রমান্বয়ে অধিকতর ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে।

এই নদীর পানি বণ্টনে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে চুক্তি আছে তাও ২০২৬ সালে শেষ হবে। তদুপরি বণ্টন করার মতো পানির পরিমাণ কমেই চলেছে, উপর্যুক্ত দুটি কারণে। ঐতিহ্যবাহী এই নদীনির্ভর বাংলাদেশের ব্যাপক এলাকা ও জনপদকে রক্ষা করার লক্ষ্যে মানবতার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভারত ও বাংলাদেশকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ সব সময়ই সচেষ্ট, কিন্তু ভারত উজানের দেশ হওয়ায় সেখানে আগ্রহের বিশদ ঘাটতি সব সময়ই পরিলক্ষিত হয়ে আসছে। তারপরও বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে আরো প্রকট হতে থাকা এই সমস্যা সমাধানে আমাদের আরো সচেষ্ট হতে হবে। বিশেষ করে ২০২৬ সালের পরবর্তী সময়ে ফারাক্কায় পদ্মার পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি এবং প্রাপ্ত পানির ন্যায্য বণ্টনের বিষয়ে এখন থেকে আরো জোরদার প্রচেষ্টা চালানো খুবই জরুরি।

শেষ করি এই বলে, আমাদের গৌরবের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন শুভ হোক। বিশ্বপরিমণ্ডলে বাংলাদেশের এবং বাংলার মানুষের মর্যাদা উত্তরোত্তর আরো সমুন্নত হোক।

পাদটিকা

  1. The world Bank/Data-Population Density per sq.km of land area (FAO and World Bank population estimates) 2020, <http://data.worldbank.org/indicator/EN.POP.DHST?locations=CN>
  2. World Bank Statement on Padma Bridge, Press Release, June 29,2012 <https://www.worldbank.org/en/news/press-release/2012/06/29/world-bank-statement-padma-bridge>
  3. Canada Court finds no proof of Padma Bridge bribery conspiracy, The Daily Star, Dhaka, 11 February 2017.
  4. PM lays out plan in JS: ‘Padma bridge with own funds’, The Daily Star, Dhaka, 9 July 2012.
  5. লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, অর্থনীতিবিদ, সমাজচিন্তক এবং পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ। স্বাধীনতা পুরস্কার ও একুশে পদকপ্রাপ্ত।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :