পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক বিভীষণ এবং স্বপ্নচারিণীর স্বপ্নপূরণ

মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু
 | প্রকাশিত : ২৫ জুন ২০২২, ০৮:২৭

গর্বের পদ্মা সেতু জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের স্বাক্ষর বহন করে। অযথা ও কাল্পনিক দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করে বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দাতাগোষ্ঠী ঋণচুক্তি বাতিল করে নিলে একক নেতৃত্বে নিজস্ব অর্থায়নে সবচেয়ে বড় এই অবকাঠামো নির্মাণ করে রীতিমতো অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। এর মধ্য দিয়েই তিনি উন্নত বিশ্বকে নিজেদের সামর্থ্যরে বার্তা দিয়ে বোঝালেন এটা বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ।

শেখ হাসিনার দৃঢ় প্রত্যয়, সততা, একাগ্রতা এবং জনগণের ওপর অগাধ আস্থা স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণে তাঁকে প্রতিটি স্তরে সাহস জুুগিয়েছে। তিনি জানেন কীভাবে শুদ্ধাচারের পথ অনুসরণ করে বড় বড় প্রজেক্টের কাজ ত্বরান্বিত করা যায়। তাই তো বিশ্বদরবারে পদ্মা সেতু আজ বাংলাদেশের মর্যাদার প্রতীক। নামকরণে ‘পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক বিভীষণ’-এর যথার্থতা এ কারণেই যে, এই বিভীষণের মাস্টারমাইন্ড ও সেতুর অর্থায়ন বাতিলের মূল হোতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতিবাচক নানা ভূমিকার কথা এই নিবন্ধে তুলে ধরা হয়েছে।

এখানে উল্লেখ্য যে, ২৮-০৪-২০১১ থেকে ০৬-০৬-২০১১ তারিখের মধ্যে বিশ্বব্যাংক, জাইকা, আইডিবি ও এডিবির সঙ্গে পদ্মা সেতু ইস্যুতে ঋণচুক্তিসমূহ সম্পাদিত হয়। পরবর্তী সময়ে ২৯-০৬-২০১২ তারিখে কাল্পনিক, অমূলক ও ভিত্তিহীন দুর্নীতির ভুয়া অভিযোগ এনে এই ঋণচুক্তিসমূহ বাতিল করা হয়। ঠিক এর ১০ দিনের মাথায় অর্থাৎ ৯ জুলাই ২০১২ তারিখে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। দুর্নীতির অভিযোগ এনে যখন অশুভ শক্তি জননেত্রী শেখ হাসিনা ও সরকারের মর্যাদা মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে উদ্যত হয়েছিল, ঠিক তখন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের তর্জনী অরেকবার কন্যা শেখ হাসিনার তর্জনীতে ভর করে রুখে দিয়েছিল সেই উদ্ধত ষড়যন্ত্রের কালো হাত। সেই তর্জনীর দেখানো পথেই শেখ হাসিনা তাঁর সততা, আত্মবিশ্বাস, নিষ্ঠা, দেশপ্রেম দিয়ে দৃঢ়প্রত্যয়ী হয়ে গড়লেন স্বপ্নের পদ্মা সেতু।

ব্রিটেনের স্বনামধন্য লেখক ডগলাস এভ্রেট তার এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, “There are some people who live in a dream world, and there are some who face reality; and then there are those who turn one into the other.” যার বাংলা অর্থ এমন “কিছু মানুষ স্বপ্নের জগতে বাস করে। কিছু মানুষ বাস্তবে বাস করে। আর কিছু মানুষ আছে, যারা স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করে।” আমাদের সেই বিজয়ের স্বপ্ন দেখানো মানুষটিই হলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা।

পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ^ব্যাংকসহ স্থানীয় কোনো কোনো সুশীল ব্যক্তির অর্বাচীন মতামত ও কতেক দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত কথিত দুর্নীতির অভিযোগের ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়। তৎসময়ে দুদকের কমিশনার থাকার সুবাদে আমিও এই অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হই। এ কারণেই বর্তমান বাস্তবতায় তৎসময়ে প্রাপ্ত তথ্য ও বস্তুনিষ্ঠ ঘটনাপ্রবাহ জনসম্মুখে প্রকাশের তাগিদ অনুভব করেছি। এজন্যই আজকের এই অবতারণা। পদ্মা সেতু প্রকল্পে মোট ৫টি প্যাকেজ ছিল। যথা মূল সেতুর অবকাঠামো নির্মাণ, জমি অধিগ্রহণ, অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণ, নদীশাসন এবং পরামর্শক নিয়োগ। খ্যাতিমান প্রকৌশলী প্রয়াত প্রফেসর ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী এবং অপর পানিবিশেষজ্ঞ প্রফেসর আইনুন নিশাতসহ স্বনামধন্য ব্যক্তিরাই মূল্যায়ন কমিটির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। মূল সেতু প্রাকযোগ্যতা নির্ধারণ প্রক্রিয়া ১১টি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করেছিল। এর মধ্য থেকে বিশ^ব্যাংকের নির্ধারিত মানদ- অনুসরণপূর্বক মূল্যায়ন শেষে ৫টি প্রতিষ্ঠানকে যোগ্য ও ৬টি প্রতিষ্ঠানকে অযোগ্য বিবেচনা করে বিশ্বব্যাংকের কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। ইতোমধ্যে ডিজাইনের আংশিক পরিবর্তন হওয়ায় বিশ^ব্যাংক পুনরায় দরপত্র আহ্বানের পরামর্শ দেয়। সে অনুযায়ী কার্যক্রম শেষে দেখা যায়, পূর্বের ৫টি প্রতিষ্ঠানই পুনরায় দরপত্রের জন্য যোগ্য বিবেচিত হয়েছে।

এই প্রক্রিয়া চলাকালীন অযোগ্য বিবেচিত প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানির প্রাকযোগ্যতা দরপত্র বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পুনর্বিবেচনার পরামর্শ থাকায় মূল্যায়ন কমিটি অনুরোধটি আমলে নিয়ে পরপর দুবার প্রতিষ্ঠানটিকে সুযোগ দেয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি সক্ষমতা নির্ধারণে প্রকৌশলীদের যে অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতার বিবরণ দিয়েছিল, তা যাচাইকালে ভুল ও প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে বলে অনুমিত হয়। সেতু নির্মাণে অভিজ্ঞতার কথা বলে তারা যে দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার ও যন্ত্রপাতির বর্ণনা দিয়েছিল, তার প্রমাণ আদতে তাদের কাছে ছিলই না। সেতু নির্মাণে মূল্যবান উপাদান হ্যামারের যে বর্ণনা তারা দিয়েছিল, তা অন্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সানফ্রান্সিসকোতে ব্যবহার করা হয়েছে মর্মে যাচাইকালে ধরা পড়ে। এই অসামঞ্জস্য সম্পর্কে তারা সদুত্তরও দিতে পারেনি; বিধায় তাদের প্রস্তাব বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। অবশেষে তারা প্রাকযোগ্যতার আবেদন প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেয় এবং তাদের স্থানীয় এজেন্ট ভেঞ্চার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের এজেন্সিশিপ বাতিল করে দেয়। এতে রাগান্বিত হয়ে উক্ত কোম্পানির স্থানীয় এজেন্ট জনৈক ক্যাপ্টেন রেজা সেতু কর্তৃপক্ষকে ‘ভবিষ্যতে খারাপ পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে’ এই হুমকি দিয়ে আত্মগোপনে চলে যায়।

এই প্রক্রিয়া চলাকালীন পুনরায় টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী চায়না রেলওয়ে ফিফটিন গ্রুপ কর্পোরেশনের বরাত দিয়ে এর স্থানীয় এজেন্ট জনৈক হেলাল উদ্দিন দাবি করেন, তাদের মূল প্রতিষ্ঠানে একটি চিঠি প্রেরণ করা হয়েছে। ওই চিঠিতে সাকো ইন্টারন্যাশনাল নামে বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠান তাদের সঙ্গে যোগাযোগ সাপেক্ষে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ^াস দিয়েছে এবং বলেছে, তাদের ‘সাইলেন্ট এজেন্ট’ নিয়োগ করা হলে তারা উক্ত প্রতিষ্ঠানকে সব ধরনের সহায়তা প্রদান করবে। হেলাল উদ্দিনের দাবিকৃত পত্রটি বিশ^ব্যাংকের হেড অফিস ও স্থানীয় অফিস থেকে সরকারি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে প্রেরণপূর্বক অনুসন্ধানের জন্য অনুরোধ করা হয়। এ বিষয়ে বিশ^ব্যাংক সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পত্রটি পাঠায় এবং অনুসন্ধানের জন্য অনুরোধ করে। বিশ্বব্যাংকের রেফারেল রিপোর্টের একটি কপি দুর্নীতি দমন কমিশন প্রাপ্ত হলে কমিশন তা যথারীতি অনুসন্ধান করে। অনুসন্ধানকালে কথিত চিঠির যথার্থতা যাচায়ের জন্য চায়না রেলওয়ে ফিফটিন ব্যুরো গ্রুপ কর্পোরেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, এ ধরনের কোনো পত্র তারা পাননি এবং স্থানীয় প্রতিনিধি হেলাল উদ্দিনের কাছে এ সংক্রান্ত কোনো পত্রও প্রেরণ করেননি। হেলাল উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, তার কাছে মূল কপি নেই; পত্রটি তিনি মেইলযোগে পেয়েছেন। তবুও তিনি কথিত প্রাপ্ত কপি জমা দেননি। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হলে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। পরে বারবার তল্লাশি চালিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।

প্রিন্সিপাল অর্থাৎ চায়না রেলওয়ে ফিফটিন ব্যুরো গ্রুপ করপোরেশন পত্রের বিষয়টি সম্পূর্র্ণ অস্বীকার করে এবং তারা বিস্মিত হয়। পত্রের কপি পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সৃজিত প্যাডে স্বাক্ষর সুপার ইম্পোজ করে পত্রটি তৈরি করা হয়েছে। স্বচ্ছতার জন্য প্রাপ্ত অভিযোগের বিষয়ে প্রাকযোগ্য ৫টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও ই-মেইল ও ডাকযোগে যোগাযোগ করা হলে তারা সবাই এক ও অভিন্ন ভাষায় জানায়, বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ‘সাইলেন্ট এজেন্ট’ নিয়োগের শর্তে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেওয়া হয়নি এবং প্রাক-যোগ্যতা নিধারণী কার্যক্রমে তাদের কোনো অনিয়মের অভিযোগ নেই। এখান থেকেই অনুমিত হয় যে, উক্ত হেলাল উদ্দিনকে বিশ্বব্যাংক বা দেশবিরোধী কোনো শক্তি ব্যবহার করেছে। অভিযোগের সমর্থনে কোনো দালিলিক বা মৌখিক সাক্ষ্য না থাকায় বিশ্বব্যাংকের আনীত প্রথম অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হয়নি।

উল্লেখ্য, তৎসময়ে কোনো কার্যাদেশও প্রদান করা হয়নি এবং কোনো দাতা সংস্থা অর্থ ছাড়ও করেনি। অন্যদিকে বিতর্কিত পত্রখানাও ষড়যন্ত্রমূলক ও অশুভ উদ্দেশ্যে সৃজনকৃত তথা ভুয়া। এই অধ্যায় শেষ হতে না হতেই বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে। এই অভিযোগের অনুসন্ধান করতে হবে। আমার দৃষ্টিতে এটি একটি অভিনব অভিযোগ। কেননা দুর্নীতির জন্য ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিতে হয় এমন কোনো মামলার অস্তিত্ব এই উপমহাদেশে ছিল বা আছে বলে আমার ৩০ বছরের আইন ও বিচারিক জীবনে দৃষ্টিগোচর হয়নি। এখানে বলে রাখা দরকার, পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়ার টেন্ডারে যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন, সেসব প্রতিষ্ঠানের কেউ-ই মূল্যায়ন কমিটির কার্যক্রমের বিষয়ে কখনো কোনো আপত্তি তোলেনি। কারণ, মূল্যায়ন কমিটি প্রতিটি পর্যায়ে বিশ্বব্যাংকের গাইডলাইন অনুসরণ করেছিল। বিশ্বব্যাংকও টেন্ডার মূল্যায়নের কোনো পর্যায়ে আপত্তির কথা উল্লেখ করেনি।

এখানে প্রণিধানযোগ্য বিষয় হলো মূল্যায়ন কমিটিতে বিশ্বব্যাংকের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ড. দাউদ নামীয় ওই ব্যক্তিটি ছিলেন প্রকিউরমেন্ট স্পেশালিস্ট। তাকে দুদকের তদন্ত দল জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি জানান, পরামর্শক হিসেবে এসএনসি-লাভালিন, কানাডাকে নির্বাচন বিশ্বব্যাংকের বিদ্যমান নীতিমালার আলোকেই করা হয়েছে। টেন্ডারে অংশগ্রহণকারী অন্য সব প্রতিষ্ঠানকে জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনলে তারাও জানায়, তাদের কাছে মূল্যায়ন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ স্বচ্ছ অনুমিত হয়েছে। তাদের কোনো অভিযোগ নেই।

বিশ্বব্যাংকের সন্তুষ্টির স্বার্থে দুদক যখন এটা অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়, ঠিক তখনই বিশ্বব্যাংকের বরাত দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় দুদকের কাছে একটি পত্র প্রেরণ করে জানায়, বিশ্বব্যাংকের একটি তদন্ত দল দুদক তদন্ত দলের সঙ্গে একীভূত হয়ে বিষয়টি তদন্ত করতে চায় এবং এ বিষয়ে কমিশনের সিদ্ধান্ত তারা জানতে চায়। এখানে উল্লেখ্য যে, বিদেশস্থ কোনো তদন্ত সংস্থার সঙ্গে দুদকের তদন্ত সংস্থা একীভূত হয়ে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে এ ধরনের কোনো সুযোগ আইনত নেই। স্বভাবতই আমরা অপারগতা প্রকাশ করে তাদের কাছে পত্র প্রেরণ করি।

এরপর বিশ্বব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানায়, তাদের একটি দক্ষ টিম দুদকের অনুসন্ধানী তদন্ত দলকে লজিস্টিক, প্রযুক্তিগত সহায়তা, প্রশিক্ষণ এবং সাক্ষপ্রমাণ দিয়ে সহায়তা করতে ইচ্ছুক। দুদক এ প্রস্তাবে সম্মতি প্রদান করে। দুদকের সম্মতির প্রেক্ষিতেই বিশ্বব্যাংক একটি এক্সপার্ট প্যানেল তৈরি করে, যার প্রধান ছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর লুইস মোরেনো ওকাম্পো। অপর দুজন সদস্য ছিলেন যুক্তরাজ্যের সিরিয়াস ফ্রড কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক রিচার্ড অল্ডারম্যান ও হংকংয়ের দুর্নীতিবিরোধী স্বাধীন কমিশনের সাবেক কমিশনার টিমোথি টং।

বিশ্বব্যাংকের উক্ত তদন্ত দল ঢাকায় আসার প্রাক্কালেই তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের পক্ষ থেকে আমাকে একদিন সকালে তার বাসায় সৌজন্য সাক্ষাতের কথা বলা হয়। আমি বিষয়বস্তু সম্পর্কে অজ্ঞাত থেকেই সময়মতো সেখানে পৌঁছালে মাননীয় অর্থমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা গওহর রিজভী আমাকে স্বাগত জানান। আলোচনাকালে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়। মাননীয় মন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের বিষয়ে তার নেতিবাচক ধারণার কথা উল্লেখ করে বলেন, বিশ্বব্যাংক ও দাতা সংস্থার অর্থ ছাড়া এই সেতু বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তিনি এ-ও বলেন, দুদক বিশেষত আমি সহায়তা করলে বিশ্বব্যাংক ও দাতাগোষ্ঠীদের কাছ থেকে পুনঃঅর্থ পাওয়া সম্ভব সংস্থাগুলো তাকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

উপদেষ্টা মহোদয় বলেন, তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বৈরী শক্তিকে পুনঃঅর্থায়নের জন্য রাজি করাতে সক্ষম হয়েছেন। এক্ষেত্রে দুদককে দৃশ্যমান কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

আমি উক্ত কার্যক্রম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে মন্ত্রী মহোদয় স্পষ্টতই বলেন, বিশ্বব্যাংকের টিম আসার আগেই সদ্যবিদায়ী মন্ত্রী আবুল হোসেনকে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নিয়ে কঠোর জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন করাতে হবে। এ সময় আরও দুই-একজনকে গ্রেফতারের কথা বলে তিনি উল্লেখ করেন, ইতোমধ্যেই মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মন্ত্রী মহোদয় আরও বলেন, বিশ্ববাংক চায় আবুল হোসেনের ব্যবসায়িক অ্যাকাউন্ট জব্দ করার পাশাপাশি তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসমূহে অভিযান চালাতে হবে এবং পরস্পর আইনগত সহায়তা চুক্তির (এমএলএআর) ভিত্তিতে তার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা স্থানান্তরের গতিবিধি জানা প্রয়োজন। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকে চার মাসের ছুটিতে পাঠানোর জন্য সরকারকে অনুরোধ করতে হবে। কেননা তিনি দায়িত্ব পালনরত থাকলে তদন্তে তা প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ থাকবে।

আমি বিস্মিত হয়ে বলি ‘দুদকের সামনে এই মুহূর্তে এমন কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই, আইনেরও কোনো ভিত্তি নেই, যার ওপর নির্ভর করে এই কার্যক্রম চালাতে পারি।’ তখন তারা আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, ‘সহজেই পুনঃঅর্থায়নের পথ বন্ধ হোক কিংবা পদ্মা সেতু নির্মাণ বাধাগ্রস্ত হোক, আপনি কি সেটা চান?’ আমি উত্তরে বলি ‘বেআইনি কোনো কাজে শুধু বিশ্বব্যাংকের অযাচিত অনুরোধের প্রেক্ষিতে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া আমার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আমার আরও দুজন সহকর্মী আছেন, তাদের সঙ্গে আপনারা পরামর্শ করতে পারেন।

তারা জানান, ‘আমরা তাদের সঙ্গে ইতোধ্যেই পরামর্শ করেছি।’ আমি উত্তরে বলি ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের যে ঘোষণা দিয়েছেন; আমি তার সঙ্গে একমত। অপমানিত হয়ে কোনো দাতাসংস্থার কাছে অর্থ পাওয়ার প্রক্রিয়ায় আমি অংশীদার হতে পারি না।’ এ সময় তারা জানান, প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আমাকে জানাবেন। আমি কোনো উত্তর না দিয়ে নীরব থাকি এবং বিদায় নিয়ে চলে আসি। এরই মধ্যে আমরা তথা দুর্নীতি দমন কমিশন কথিত দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ অনুসন্ধানের পথে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছি। পরামর্শক নিয়োগের প্রশ্নে ১৩টি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে। তন্মধ্যে ৫টি প্রতিষ্ঠানকে ‘গুড গ্রেড’ রেটিং করা হয়। মূল্যায়ন কমিটি কর্তৃক কারিগরি ও আর্থিক মূল্যায়নের ক্রমানুসারে এসএনসি-লাভালিন, কানাডা প্রথম; হেলকো গ্রুপ, ইউকে দ্বিতীয়; হাইপয়েন্ট রেন্ডার, ইউকে তৃতীয়; একোমনিউজিল্যান্ড চতুর্থ এবং ওরিয়েন্ডেট কনসালটেন্ট ৫ম স্থানে নির্ধারিত হয়। কারিগরি ও আর্থিক মূল্যায়নে ১০০ নম্বরের মধ্যে ০.০২৫ নম্বর বেশি পেয়ে কানাডার কোম্পানি এসএনসি লাভালিন প্রথম থাকায় মূল্যায়ন কমিটি তাদের কার্যাদেশের সুপারিশ করে। কিন্তু দুদক অনুসন্ধান টিম জানতে পারে, বিশ্বব্যাংক এই কোম্পানিকে কাজের বিষয়ে সম্মতি দেয়নি।

এরই মধ্যে তথ্য পাওয়া যায়, এসএনসি-লাভালিনের বিরুদ্ধে কানাডার ওন্টারিও কোর্ট অব জাস্টিসে বিশ^ব্যাংকের তথ্যের ভিত্তিতে ঘুষ প্রদানের ইচ্ছে-পোষণ ও কার্যাদেশ পাওয়ার জন্য পৃথক অর্থ বরাদ্দ রাখার অভিযোগে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সেখানে এসএনসি-লাভালিনের দুই কর্মকর্তা যথাক্রমে বাংলাদেশের বংশোদ্ভূত ইসমাইল ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত রমেশের ঘুষ গ্রহণের ইচ্ছেপোষণমূলক অনৈতিক কাজের সাক্ষ্য পাওয়া গেছে। তথ্যে আরও বলা হয়, রমেশ সাহার কাছে একটি ডায়েরি পাওয়া গেছে, যেখানে বাংলাদেশের যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও পদ্মা সেতু প্রজেক্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত বেশ কয়েকজনসহ আরও কিছু ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে তাদের প্রভাবিত করতে অর্থ খরচের অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয়। এ বিষয়টি বিশ্বব্যাংকও উল্লেখ করে দুদকের কাছে পত্র প্রেরণ করায় আমরা তাদের কাছে রমেশ সাহা এবং তার ডায়েরি ও সংশ্লিষ্ট সাক্ষীগণের সাক্ষ্য প্রেরণের জন্য অনুরোধ করি। কিন্তু বিশ্বব্যাংক আমাদের পত্রের উত্তর না দিয়ে তারা একটি রেফারেল রিপোর্ট পাঠায়, যেখানে বর্ণিত বক্তব্যসমূহের সমর্থনে সাক্ষ্যের অভাব ছিল। তবুও আমরা বিশ্বব্যাংক প্রেরিত এক্সপার্ট টিমের কাছে এ বিষয়ে বক্তব্য পাওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকি।

ইতোমধ্যেই আমরা মিউচুয়াল লিগ্যাল এসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট তথা এমএলএআর পদ্ধতিতে কানাডা সরকারের মাধ্যমে রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ ও কানাডিয়ান ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের কাছে তথ্য চাই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তারা কোনো তথ্যই আমাদের কাছে পাঠায়নি। এমন অবস্থায় লুইস ওকাম্পোর নেতৃত্বে বিশ্বব্যাংকের একটি এক্সপার্ট টিম বাংলাদেশে আসে এবং আমাদের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হন।

আলোচনাকালে তারা বারবার পরবর্তীতে তথ্য দেবে মর্মে উল্লেখ করে একই ভাষায় গ্রেফতার, রিমান্ড ও কঠোর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকে। তারা বলেন, সাকো কোম্পানির অ্যাকাউন্ট জব্দ করে এমএলএআর-এর মাধ্যমে তথ্য জানতে চাইলে ওই অ্যাকাউন্ট থেকে বিদেশের বিভিন্ন স্থানে যথা লন্ডন, কানাডা, আমেরিকাসহ আরও অন্যান্য দেশে অর্থ স্থানান্তরের প্রমাণ পাওয়া যাবে। কেননা তাদের বিশ্বাস এই অর্থ বিদেশে লেনদেন হয়েছে।

লুইস ওকাম্পো ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বঙ্গবন্ধু পরিবারের দুই-একজন সদস্যের বিষয়ে পরোক্ষ ইঙ্গিত দেয়ার চেষ্টা করলে আমি বিষয়বস্তু ব্যতীত অন্য কোনো প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে তাকে নিবৃত করি।

বিষয়টি আইনের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় আমরা সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়া এসব বিষয়ে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয় বলে জানালে বিশ্বব্যাংকের এক্সপার্ট টিম ক্ষিপ্ত হয়ে সভাস্থল ত্যাগ করতে উদ্যত হয়। পরে অনুরোধ করে তাদের নিবৃত করা হয়। এ সময় তারা আমাদের কথা দেন, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তারা রমেশ সাহার ডায়েরিসহ পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ নিয়ে আমাদের সঙ্গে মিলিত হবেন।

আমরা স্ব-উদ্যোগে আইনগতভাবে যে প্রচেষ্টা নেওয়া যায়, সেসব উদ্যোগ নিয়ে কানাডিয়ান রয়েল মাউন্টেড পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ডকুমেন্টারি কোনো প্রমাণ/নোটপ্যাড সংগ্রহ করতে না পারায় তৎকালীন মুখ্য আইন উপদেষ্টা জনাব আনিসুল হক ও তদন্তকারী কর্মকর্তাকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য কানাডায় প্রেরণ করি। প্রথমবার কোনো তথ্য না পেলেও দ্বিতীয়বারে অন্টারিও কোর্ট অব জাস্টিসে বিচার প্রক্রিয়ায় সাক্ষীদের প্রদত্ত সাক্ষ্যের ট্রান্সক্রিপ্ট সংগ্রহ করতে সক্ষম হই। উক্ত ট্রান্সক্রিপ্ট পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করে এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি; যাতে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়া দুর্নীতি বা ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্র হয়েছিল।

দুদকের অনুসন্ধান দলের প্রাপ্ত তথ্য গোপনে রাখা অবস্থায় বিশ্বব্যাংকের এক্সপার্ট টিম পুনরায় বাংলাদেশে আসে এবং দুদকের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হয়। দুই দিনব্যাপী আলোচনার প্রথম দিনে নৈশভোজ চলাকালীন দলের প্রধান লুইস ওকাম্পো আমাকে উদ্দেশ করে ড. ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে সরে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার বৈরী সম্পর্ক কেন, তাও জিজ্ঞেস করেন ওকাম্পো। এ কথাও বলেন, এই বৈরিতা নিরসন হলে সব জটিলতার অবসান হবে বলে তার বিশ্বাস। আমি তাকে জানাই যে, নির্ধারিত বয়স উত্তীর্ণ হওয়ায় এবং আইনের বিধানমতো যোগ্য না হওয়ায় তাকে পদ ছাড়তে হয়েছে। ড. ইউনূস উচ্চ আদালতে প্রতিকার চেয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। উপরন্তু তিনি বয়স পার হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘকাল এমডি পদে বহাল ছিলেন। এ কথা বলার পর ওকাম্পো স্তম্ভিত হন এবং এ বিষয়ে আর কথা বাড়াননি।

তার সঙ্গে কথোপকথনে বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিলে ও কথিত দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপনে ড. ইউনূসের ভূমিকা রয়েছে বলে অনুমিত হয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশ থেকে বিশ^ব্যাংকের কাছে প্রেরিত কয়েকটি ই-মেইল, যা পরবর্তীতে বিশ^ব্যাংক বিষয়বস্তু প্রকাশ না করার শর্ত দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে পাঠায়। সেই ই-মেইলের সেন্ডার নামটি ঘষামাজা করে দেয় বিশ্বব্যাংক। ‘পদ্মা সেতু প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত আছে এবং এখানে অর্থায়ন করা সঙ্গত হবে না’ ই-মেইল পর্যালোচনা করে এমন তথ্যই পাওয়া যায়। বিশ্বব্যাংকের কাছে ই-মেইলসমূহ যে ড. ইউনূসই পাঠিয়েছেন, ওকাম্পের কথা ও উপরোক্ত ঘটনাসমূহ সেটাই সমর্থন করে।

দ্বিতীয় দিনের আলোচনার প্রারম্ভেই বিশ্বব্যাংকর এক্সপার্ট টিমের মধ্যে কিছুটা আগ্রাসী মনোভাব লক্ষ করা যায়। তারা সরাসরি আমাকে ও আমাদের মুখ্য আইন উপদেষ্টা জনাব আনিসুল হকের প্রতি বাক্যবাণ ছুড়ে দেন। আমি এতে বিব্রত হই এবং তাদের চ্যালেঞ্জ করে বলিÑ কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়া খালি হাতে আমাদের কাছে এলে সে বিষয়ে আমরা কোনো সহযোগিতা করতে পারব না।

এর আগে অবশ্য দুদকের গোয়েন্দা কাজে নিয়োজিত দুজন কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে আমরা জানতে পারি যে, আমাদের সঙ্গে দ্বিতীয় দিনে মিলিত হওয়ার আগে তারা স্থানীয় প্রতিনিধি গোল্ড স্ট্যানের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের কতিপয় ব্যক্তির সঙ্গে হোটেল ওয়েস্টিনে বসেছিলেন। সেখানে সুশীল সমাজের কয়েকজন প্রতিনিধি তথা আইনজীবী ড. কামাল হোসেন, ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, প্রথম আলোর মতিউর রহমান, আইনজীবী ব্যারিস্টার মঞ্জুর হোসেনসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন এবং তারা এক্সপার্ট টিমকে ব্রিফ করেছিলেন বলে জানা যায়।

যাই হোক, দ্বিতীয় দিনের আলোচনা শেষে বিশ^ব্যাংকের টিম ভবিষ্যতে পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেয়ার কথা জানিয়ে সভা ত্যাগ করে এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ ছাড়ে। তারপরও আমরা দীর্ঘসময় তাদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করি। অবশেষে আমরা প্রাপ্ত তথ্যসমূহ পর্যালোচনাপূর্বক তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনায় আর কোনো উপাদান না পাওয়ায় বিষয়টি নিষ্পত্তি করে আদালতে প্রতিবেদন প্রেরণ করি। স্বচ্ছতার সাথে তদন্ত কার্যক্রম শেষে ৪-০৯-২০১৪ তারিখে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়; যা আদালত কর্তৃক গৃহীত হয়।

দুদকের তদন্তে বিশ্বব্যাংকের সব অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার প্রতিবেদন দাখিলের প্রায় এক বছর পর দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তের ফলাফলের সাথে একমত হয়ে কানাডার অন্টারিও কোর্ট অব জাস্টিজ একই বিষয়ে তাদের কাছে প্রেরিত অভিযোগে রায় প্রদান করে। রায়ে তারা সুস্পষ্টভাবে জানায় যে, বিশ^ব্যাংকের অভিযোগটি ছিল অসত্য এবং নেয়াহেত গালগল্প ভিন্ন অন্য কিছু নয়। উক্ত আদালতও মামলাটি খারিজ করে দেয়।

পূর্বাপর ঘটনাপ্রবাহের বিচার-বিশ্লেষণে এবং বিশ্বব্যাংকের সাক্ষ্যপ্রমাণ দাখিলে ব্যর্থতার কারণে এটা সহজেই অনুমিত হয় যে, তথাকথিত ঘুষ লেনদেনে অভিপ্রায় সম্বলিত অদৃশ্য নোটপ্যাড, সাইলেন্ট এজেন্ট নিয়োগের পত্র প্রেরণসহ সবকিছুই ছিল সৃজিত, মনগড়া ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত; যা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে করা হয়েছে। দুর্নীতি দমশন কমিশন গুরুত্ব ও নিষ্ঠার সঙ্গে দুর্নীতির জন্য ষড়যন্ত্র নামক অভিনব এই অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রমসমূহ পরিচালনা করেছে। এক্ষেত্রে স্বচ্ছতার কোনো ঘাটতি ছিল না। তদন্তকালীন দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে প্রতিশ্রুত ঋণ সহায়তা পাওয়ার শর্তে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ নিষ্পত্তিতে পূর্বে উল্লেখিত মহল থেকে দুদককে কৌশলী অবস্থান গ্রহণ করার পরামর্শ দেয়া হলেও দুদক বিবেকের তাড়নায় সত্য ঘটনা প্রকাশের দায়িত্ব থেকে বিচ্যুত হয়নি। অনেকেই তখন আমাদের সমালোচনা করেছেন, অহেতুক অনেক মন্তব্য করেছেন; কিন্তু তারপরও বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করতে দেয়া হয়নি কখনো।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস গয়েবলসীয় কায়দায় পদ্মা সেতু নিয়ে অপপ্রচার হয়েছে; যেখানে একটি মিথ্যাকে বারবার বললে সেটাকে সত্যের মতো শোনায়। পদ্মা সেতুর বেলায়ও বারবার বলা হয়েছে- দুর্নীতি হয়েছে, দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে, আরও কত কী! গব মিলিয়ে এই ষড়যন্ত্রের বিষয়টি জনগণের মগজে ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এ অপপ্রচার বারবার চালিয়ে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে বছরের পর বছর। যদিও এসব ষড়যন্ত্রের সাথে বাংলাদেশের মাত্র কয়েকজন সুশীল সমাজের তথাকথিত স্বনামখ্যাত ব্যক্তি জড়িত। অবশেষে দুদকের তদন্তে এসব অপ্রপচার ভিত্তিহীন হিসেবে প্রমাণ হয়েছে। আজ সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং দৃঢ়প্রত্যয়ী সৎ, সাহসী ও দেশপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী তাঁর অঙ্গীকার ও ঘোষণা অনুযায়ী দাতাগোষ্ঠীর সহায়তা ব্যতীত সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বিশে^ বাংলাদেশকে মর্যাদার উচ্চতর আসনে আসীন করেছেন।

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা। সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং চেয়ারম্যান, প্রচার ও প্রকাশনা উপকমিটি। সাবেক কমিশনার, দুদক।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :