পদ্মা সেতু কেবল সেতু নয় এটি বড় মানবিক অর্জন

নাহিদ ইমরান শাওন
| আপডেট : ২৫ জুন ২০২২, ১০:১৪ | প্রকাশিত : ২৫ জুন ২০২২, ১০:০৭

৩৮ তম বিসিএস প্রিলির আগের রাতে ঝিনাইদহ থেকে একটি বাসে করে জাহাঙ্গীরনগর যাচ্ছিলাম। বাসের প্রায় পুরোটায় পরীক্ষার্থীদের দখলে ছিল। চলতি পথে তাদের আলোচনায় অনেক ধরনের কথা শুনছিলাম। নিজেদেরে মধ্যে তারা এমসিকিউ ধরাধরি করছিলো, কেউ বা নতুন একটা তথ্য দিয়ে সবাইকে সতর্ক করে দিচ্ছিলো যেন সেটা মনে রাখে।

আমার খুব ভালোভাবে মনে আছে সেই রাতের কথা। একজন আপু ছিলেন তাদের মধ্যে যিনি নিজের বিয়ে আটকিয়ে রেখেছিলেন বিসিএস এর জন্য। আরেকজন ভাইয়া ছিলেন, যিনি জীবনের শেষ বিসিএস দিতে যাচ্ছিলেন। দৌলতদিয়া ঘাট পর্যন্ত রাস্তা শেষ হলেও তাদের এধরনের আলাপচারিতা চলছিলই।

একটা বিসিএস এর জন্য নিজেকে কতটা সময় দিতে হয় আর কতটা প্রস্তুত করতে হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যাহোক দৌলতদিয়া ঘাটে যখন বাস থামলো তখন ঘন কুয়াশা চারিদিকে, রাত সবেমাত্র দশ বা এগারোটা বাজে। ফেরি চলাচল বন্ধ, রাস্তায় দীর্ঘ বাসের সারি।

ঘন্টা দুয়েক বাদেই সবার আশঙ্কা হলো ঠিক সময়ে পদ্মা পার হতে না পারার। একটা একটা করে ঘন্টা পার হয়ে ভোর হয়ে আসলো তখনও কুয়াশার আবডালে কতটা মন্দভাগ্য ছিল তা জানা যায়নি।

ফজরের আজানের পর সবার সিদ্ধন্ত হলো লঞ্চে নদী পার হওয়া। আমিও তাদের সহযাত্রী হলাম। হেঁটে হেঁটে লঞ্চ ঘাট পর্যন্ত গিয়ে সেখানে আরো সাত-আট জন পরীক্ষার্থীর দেখা, যারা লঞ্চ কর্তৃপক্ষকে নদী পার করে দেয়ার বিষয়ে অনুরোধ করছিল। তবুও লঞ্চ ছাড়লো না।

কিছু জেলে খুব সকালে মাছ ধরার জন্য বের হয়েছিল। তাদের ট্রলারে পার করে দেওয়ার অনুরোধ করা হলো। মেশিনে চালিত ছাউনিবিহীন নৌকাই ট্রলার। সতর্ক হয়ে সবাই উঠলো, সর্বশেষ সদস্য হিসেবে আমি উঠলাম তাদের সাথে। জন প্রতি ভাড়া ২০০ টাকা। ট্রলার কিচ্ছুক্ষণ যাওয়ার পরেই চারিদিকে সমান ও সাদা হয়ে গেল, যেন বিশাল বড় একটা ডিম আর তাতে আমরা দৌঁড়ে সীমানা খুঁজছি।

মাঝির ওপর আস্থা রাখা হলো, যেহেতেু সে এই ঘাটের মাঝি তার অনুমান ঠিক হবে। প্রায় ত্রিশ মিনিটি পর নৌকা যেখান থেকে ছেড়েছিল, সেখানে ফিরে এসেছে। এতটা সময় নৌকার ওপর কেউ দাঁড়ানো কেউবা বসা কিন্তু সবাই ভেজা। একদম চুপ হয়ে গেলাম। মাঝি সবাইকে নেমে যেতে বলল এবং কারো কাছ থেকে টাকা নেবে না সেটাও জানালো। কেউ কোনো উত্তর করল না।

একজন ভাই মোবাইলের জিপিএস দেখে পথ ঠিক করার শর্তে মাঝিকে আবার ট্রলার চালানোর জন্য রাজি করালেন। সবাই এবার কিছুটা আশাবাদী হলো। এখনো যদি নদী পার হওয়া যায় তাহলে পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব। মাঝি বোধকরি এই অসহায় মুখগুলোর ভরসা। যাত্রা শুরু হলো, চলতে চলতে হঠাৎ নদীর মাঝে কোনো এক চরে ট্রলার আটকে গেল। নামতে হলো সবার, ঠেলতে হলো মাঝির সাথে। অবস্থান বুঝে উঠতে না পারায় সবার মনে একধরনের ভয় অনুভূত হলো। চরে লুকিয়ে থাকা ভয়, সর্বনাশা নদীর ভয়, লাগামহীন হয়রানির ভয়। কয়েকজন আল্লাহ্ আল্লাহ্ বলে চোখ মুছলো তখন। ট্রলার আবারও চলতে শুরু করেছে, সকলেই চুপ। কারোর মুখে আর পরীক্ষা দেওয়ার নাম নেই। আরো এক ঘন্টা নদীতে ঘুরে ঘুরে কুয়াশায় তীর খুঁজে হয়রান হয়ে গেলাম।

পাটুরিয়া ঘাটে যখন নামবো তখন সকাল সাতটা বাজে। পরীক্ষর্থীরা এপারে এসে হাতমুখ ধুয়ে আবার ঝিনাইদহের বাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো, আর আমি জাহাঙ্গীরনগরগামী বাসে উঠে পড়লাম ।

প্রকৃতই পদ্মসেতু কেবল সেতু নয়। অর্থনৈতিক, সামাজিক বা রাজনৈতিক অর্জনের চেয়েও বড় এর মানবিক অর্জন। জাতির এই সক্ষমতাকে স্বাগত জানাই। ধন্যবাদ জানাই স্বপ্নবাজ সেই রূপকার আর নির্মাণে সহযোগী প্রতিটি সদস্যকে।

লেখক: উপ-সহকারী পরিচালক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মুক্তমত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :