পদ্মা সেতুর সাফল্য বিশ্বব্যাংকের বিশ্বাসযোগ্যতা ধ্বংস করেছে

প্রকাশ | ২৫ জুন ২০২২, ১১:০৫

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত পৃথিবীর অর্থনৈতিক চাকাকে সক্রিয় করার জন্য ১৯৪৪ সালে ‘ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক ফর রি-কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ নামে যে অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে সেটিই নাম পরিবর্তন করে বিশ্বব্যাংক গ্রুপ নামে পরিচিতি পায়। ১৯৪৪ সালেই ওয়াশিংটনের ব্রেটন উড এলাকায় সম্মেলনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মনিটারি ফান্ড (আইএমএফ) এবং বিশ্বব্যাংকের পূর্বসূরির জন্ম হয়। এর কাজ শুরু হয় ১৯৪৬ সালে। এটি জাতিসংঘের অংশ নয়, তবে এর সাথে সম্পৃক্ত, যার মূল দায়িত্ব সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে ঋণ এবং পরামর্শ দিয়ে তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে সহায়তা প্রদান। বর্তমানে ১৮০টি দেশ এই ব্যাংকের সদস্য, যারাই বলতে গেলে ব্যাংকটির মালিক। এটি  ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের সাথেও পরামর্শক্রম করে থাকে। বিশ্বব্যাংক গ্রুপে রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক ফর রি-কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স ডেভেলপমেন্ট এসোসিয়েশন, ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন, মাল্টিলেন্টারেল ইনভেস্টমেন্ট গ্যারান্টি এজেন্সি এবং ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর সেটেলমেন্ট অব ইনভেস্টমেন্ট ডিসপ্যুট। এই ৬টি গ্রুপের কার্যপ্রণালী বিভিন্ন ধরনের।
১৯৬৮ থেকে ’৮১ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটির সভাপতিত্বে ছিলেন সাবেক মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবার্ট মাকনেমারা। ব্যাংকটি জাতিসংঘের কাছে দায়বদ্ধ নয়। এর গভর্নিং বোর্ডে ১৮০টি সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিটিরই প্রতিনিধিত্ব রয়েছে, তবে ব্যাংকটির ২৫ জন পরিচালকই মূল ক্ষমতার অধিকারী এবং যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানি, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্স এই ৫টি দেশ ২৫ জন এক্সিকিউটিভ পদে সরাসরি নিয়োগ দিয়ে থাকেন আর বাকি ২০টি দেশ মিলিতভাবে ২০ জনকে নিয়োগ প্রদান করেন। জন্মলগ্ন থেকেই মার্কিনিরাই এই ব্যাংকের সভাপতির পদ দখলে রেখেছেন, যিনি ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ বোর্ডেরও সভাপতি, আর তার হাতেই রয়েছে ব্যাংকের সিদ্ধান্তের আসল ক্ষমতা। ব্যাংকে এক সদস্য এক ভোট ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হয় না। যে রাষ্ট্র যত বেশি বিত্তশালী, সে রাষ্ট্রের অংশ এবং ভোট বেশি। ২১ শতক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে রয়েছে গোটা ভোটের ছয় ভাগের এক ভাগ, যে কারণে এক কথায় বলা যায় যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছাই ব্যাংকের ইচ্ছা, আর তাকে মিত্র দেশগুলো যথা যুক্তরাজ্য, জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স সমর্থন দিলে তো কথাই নেই। তাই অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো ঋণ সুবিধার মুখ্য দাবিদার হলেও ব্যাংকের নীতি নির্ধারণে বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে এসব দেশের তেমন প্রভাব নেই।
মুন্সীগঞ্জ জেলার মাওয়া থেকে পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে একটি সেতু নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা ধীরে ধীরে প্রকট থেকে প্রকটতর হতে থাকে। ২০০১ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালেই সেই সেতু নির্মাণের ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু সেতুটির অবস্থান তখনও স্থির করা যায়নি। জাপানি সংস্থা জাইকাকে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে দায়িত্ব দিলে, জাইকা বর্তমান অবস্থানের পক্ষে মত দেয়। অতঃপর আওয়ামী সরকারের পতন হলে সব থেমে যায়।
২০০৯ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের সরকার পুনরায় বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয় এবং সেতু নির্মাণের জন্য স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। জাপান আন্তর্জাতিক কো-অপারেশন এজেন্সিকে (জাইকা) এ মর্মে সিদ্ধান্ত দেয় যে, এক সময় ওই সেতু দিয়ে প্রতিদিন ২১ হাজারের বেশি যান চলাচল করবে, যা ২০২৫ সালে বর্ধিত হয়ে দিনে ৪১ হাজারে পৌঁছুবে। তদনুযায়ী ২০১০ সালে বাংলাদেশ সেতু নির্মাণ কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বান করে, পরে সেতুর ডিজাইন প্রণয়নের দায়িত্ব প্রদান করে নিউজিল্যান্ডভিত্তিক অঊঈঙগ নামক সংস্থাকে। তাদের তৈরি ডিজাইনকে ২০১০ সালে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ‘বেস্ট সেফগার্ড প্ল্যানিং’ পদক প্রদান করে সম্মানিত করে। জাপানি সংস্থা মত দেয় যে সেতুটির পুরো এলাকায় ৭ লাখের ওপর কর্মসংস্থান ঘটাবে। বিশ্বব্যাংক সেতুটির প্রয়োজনীয়তা এবং সম্ভাব্যতা এবং এর মঙ্গলকর দিকসমূহ বিবেচনা করে সেতু প্রকল্পের জন্য ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সহজ শর্তে ঋণ দিতে রাজি হয়।
বিশ্বব্যাংক ছাড়াও আরও কটি আন্তর্জাতিক সংস্থা ঋণ দিতে আগ্রহী হয়। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে এগুনোর চেষ্টা শুরু করলে ঠিক তখনই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো শোনা গেল বিশ্বব্যাংকের ভিন্ন সুর। তারা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে বলতে শুরু করলো এ ধরনের একটি মেগা প্রকল্প এখন গ্রহণ করা ঠিক হবে না, পরবর্তী সময়ে হতে পারে। তবে একই সাথে তারা প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতি হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন। এভাবে কালক্ষেপণ করতে করতে এক সময় তারা প্রকল্পে ঋণদান বন্ধেরই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন দুর্নীতির অজুহাত দেখিয়ে। কিন্তু সেই সময় পর্যন্ত প্রকল্পের কাজও শুরু হয়নি। বিশ্বব্যাংক বলল যে সব পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, সেখানেই নাকি তারা দুর্নীতির গন্ধ পেয়েছে। তখন এমনকি পরামর্শ প্রতিষ্ঠানগুলোকেও কোনো টাকা-পয়সা দেওয়া হয়নি, সে অর্থে এই অভিযোগটি ছিল নেহায়েতই মনগড়া কল্পকাহিনির মতো এবং গুজবভিত্তিক, যে কথা পরবর্তীকালে কানাডার আদালত তাদের রায়ে উল্লেখ করেছেন। সে সময়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ছিলেন বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ ড. ইউনূসের সহপাঠী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
শোনা যায়, ড. ইউনূসের শান্তির জন্য (অর্থনীতির জন্য নয়) নোবেল পেতেও এই মহিলার বিশেষ ভূমিকা ছিল। ড. ইউনূস তখন বাংলাদেশ সরকারের ওপর ছিলেন মারাত্মকভাবে ক্ষিপ্ত, কেননা আইন দ্বারা নির্ধারিত অবসরের বয়স পার হয়ে যাবার পরও তিনি সরকারের কাছে অদ্ভুত আর্জি করলেন তাকে যেন গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি হিসেবে কাজ করতে দেওয়া হয়। সরকার স্বাভাবিকভাবেই জানিয়ে দেন যে আইনত সেটি সম্ভব নয়। ইউনূস সাহেব এমনকি হিলারি ক্লিনটনকে দিয়েও তদবির করিয়েছিলেন। সব ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি বাংলাদেশকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য বিশ্বব্যাংককে প্রভাবিত করেন পদ্মা সেতুর জন্য ঋণ না দিতে। সময় অতিক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে এটিও পরিষ্কার হতে শুরু করল যে  ইউনূস সাহেবের প্রভাবেই বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করেছিল। ইউনূস সাহেবের সেই ষড়যন্ত্রে সম্পৃক্ত হয়েছিল তারা, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এই সরকারকে সহ্য করতে পারছে না।
এ সরকারের আমলে পদ্মা সেতু চালু হলে সেটি পরবর্তী নির্বাচনে তাদের জয় নিশ্চিত হবে,  এটা ছিল কারও কারও কাছে, বিশেষত ষড়যন্ত্রকারীদের কাছে আতঙ্ক। তাই ষড়যন্ত্রকারীরা পদ্মা সেতুর প্রস্তুতির শেষপর্বে নানা অজুহাত ও কল্পনাপ্রসূত অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংককে বিভ্রান্ত করে পদ্মা সেতু নির্মাণকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য ইউনূস সাহেবের সাথে হাত মেলায়। এ সময় একটি অশুভ চক্রের আঁতাত পরিলক্ষিত হয়। পদ্মা সেতুর মূল কাজের প্রাকযোগ্য ঠিকাদার নিয়োগে বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানির কাছে অর্থনৈতিক দাবি করেছে, হঠাৎ করে তথাকথিত এ অভিযোগ তোলা হয়। পরবর্তী সময়ে দুদক ঠিকাদার প্রাক-নির্বাচনের উত্থাপিত অভিযোগ তদন্ত করে। প্রত্যেক ঠিকাদার কোম্পানির সাথে কথা বলে। দুদকের তদন্তে অভিযোগের সত্যতা মিলেনি। বিশ্বব্যাংক দুদকের রিপোর্ট গ্রহণ করে। পরবর্তী সময়ে ষড়যন্ত্রকারীরা পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির আশঙ্কার অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতুর নির্মাণকে বিলম্বিত করতে নতুন কৌশল অবলম্বন করে। কতকগুলো বেনামি চিঠি ও কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহলের অভিযোগের ভিত্তিতে পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগে বিশ্বব্যাংকের ইন্টিগ্রিটি বিভাগ দুর্নীতির আশঙ্কা আবিষ্কার করলো। একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করে পদ্মা সেতুর নির্মাণ বন্ধে পেরেক ঠুকে দিলেন। ইন্টিগ্রিটি বিভাগের প্রতিবেদন, অসত্য তথ্য-উপাত্ত গ্রহণ করে বিশ্বব্যাংক প্যানেল একটি চূড়ান্ত রিপোর্ট দিয়ে বাংলাদেশের একটি বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্পের আশু বাস্তবায়ন কার্যক্রমের মৃত্যু ঘটালেন।
ঠিক এক সময়েই বাংলাদেশের একটি বিশেষ মহল বিশ্বব্যাংকে নামে-বেনামে চিঠি দিয়ে, ই-মেইল, ফ্যাক্স দিয়ে বোঝাতে শুরু করলেনÑ এ সরকারের আমলে পদ্মা সেতু করা ঠিক হবে না। পদ্মা সেতু এ সরকারের আমলে বাস্তবায়ন হলে এখানে বড় ধরনের আর্থিক দুর্নীতি হবে, দুর্নীতির চেষ্টা হচ্ছে। আর এ দুর্নীতির অর্থ আওয়ামী লীগ পরবর্তী নির্বাচনে জয়লাভ করার কাজে ব্যয় করবে। রাজনৈতিক কাজে বিশ্বব্যাংকের অর্থ ব্যয় হবে এবং এর মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে সরকার লাভবান হবে। এ বিষয় নিয়ে মহলটি শুধু বাংলাদেশেই অপপ্রচার করে ক্ষান্ত হয়নি, এ অপপ্রচারের উপাদান নিয়ে বিশ্বব্যাংকে লবিংও করে। বিশ্বব্যাংক অশুভ মহলের লবিংয়ে প্রভাবিত হয়। এর কিছুটা সত্যতা পাওয়া যায় বাংলাদেশস্থ বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি গোল্ড স্টেইনের কথায়। বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি অনানুষ্ঠানিক এবং মৌখিকভাবে একাধিকবার বলেছিলেন, পদ্মা সেতুর কাজ এত দ্রুত না করে আস্তে-ধীরে এগুবার জন্য। পদ্মা সেতু একটি বড় প্রকল্পÑ একে ধীরে-সুস্থে এগিয়ে নেওয়া ভালো। প্রয়োজনে পরবর্তী সরকারের সময় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। অভিযোগ উত্থাপনের আগে বা পরে বিশ্বব্যাংকের এই স্থানীয় আবাসিক প্রতিনিধি বা বিশ্বব্যাংকের অন্য কোনো কর্মকর্তা এ বিষয়ে কথা বলেননি। আবাসিক প্রতিনিধি গোল্ড স্টেইনের এ ধরনের কথা বা আচরণ থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়, শুরু থেকেই পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি সরকার বিরোধী সংঘবদ্ধ মহল গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থেকে কাজ করছিল। এ সময়ে বাংলাদেশের মিডিয়ার একটি বৈশিষ্ট্যও লক্ষণীয়। ডেইলি স্টারসহ কতিপয় পত্র-পত্রিকা জিঘাংসামূলকভাবে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে নানা কল্পকাহিনি তৈরি করে এবং বিশ্বব্যাংকের পক্ষ নিয়ে অপপ্রচার শুরু করে। কিছু তথাকথিত সুধীজন বিশ্বব্যাংকের সাথে ঐকমত্য পোষণ করে পদ্মা সেতু নিয়ে একই সুরে, সত্য-মিথ্যার বিচার না করে, দেশের স্বার্থের কথা বিবেচনা না করে একতরফাভাবে কথা বলে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে ষড়যন্ত্রকে জোরদার করেন।  
বিশ্বব্যাংকের ইন্টিগ্রিটি বিভাগ যেসব উড়ো চিঠি ও অভিযোগের ভিত্তিতে বাংলাদেশের পদ্মা সেতুর আশু বাস্তবায়নে পেরেক ঠুকলো বিশ্বব্যাংকের ইতিহাসে এটা নজিরবিহীন ঘটনা। এটি নিশ্চিতভাবে একটি পরিকল্পিত ঘটনা। শুধু দুর্নীতির আশঙ্কায় এ ধরনের প্রকল্প বন্ধ করা যায় না। এক্ষেত্রে কঠোর নজরদারি, তত্ত্বাবধায়ন ও আইনের প্রয়োগ করে পদ্মা সেতুর কাজ এগিয়ে নেওয়াই ছিল বিশ্বব্যাংকের দায়িত্ব। বাংলাদেশের জনকল্যাণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা ছিল বিশ্বব্যাংকের জন্য একটি বিরাট সুযোগ। পৃথিবীর কোনো দেশে জনকল্যাণমূলক প্রকল্পে অর্থায়নের এ ধরনের বড় সুযোগ বিশ্বব্যাংক আর কখনো পাবে বলে মনে হয় না। সামগ্রিক বিবেচনায়, ঠুনকো অজুহাতে বিশ্বব্যাংকের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হয়নি। এক্ষেত্রে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য কাজ না করলে অর্থায়ন বন্ধে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যায় না। ইন্টিগ্রিটি বিভাগ সেসব উড়ো চিঠি ও স্বার্থান্বেষী ব্যক্তির অভিযোগে প্রভাবিত হয়ে এ নজিরবিহীন খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করল, তাদের নাম ও অভিযোগ জনসম্মুখে প্রকাশ করা জরুরি ছিল। ২০১৩ সালে জাইকা বাংলাদেশের যে প্রখ্যাত সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীকে দেশে বড় উন্নয়ন কার্যক্রমে অবদানের জন্য সম্মাননা প্রদান করেন, তিনিই পদ্মা সেতু নিয়ে পর্যালোচনা কমিটির প্রধান ছিলেন।
বিশ্বব্যাংকের চাপে অবশেষে বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশন সড়ক ও যোগাযোগ বিষয়ক মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এবং আবুল হাসান চৌধুরী নামক একজন, যিনি তিন দশক আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন ও মন্ত্রণালয়ের সচিব  মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়ার বিরুদ্ধে বিস্তারিত তদন্তে নামে। কমিশন অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পায়নি, যদিও ভুঁইয়া সাহেবকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং সৈয়দ আবুল হোসেন সাহেবকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল। বিশ্বব্যাংকের উদ্যোগে তাদের এবং লাভালিন নামক সংস্থা, যেটিকে পরামর্শক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, বিরুদ্ধে কানাডায় মামলা করলে সে দেশের আদালত মামলা খারিজ করে পরিষ্কার বলে দেন অভিযোগ ভিত্তিহীন, মনগড়া রূপকথাসম এবং গুজব।
বিশ্বব্যাংক লুইস মোরেনো ওকাম্পো নামক একজন আইনজ্ঞকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল দুর্নীতির তদন্ত করতে, আর সেই ওকাম্পোই দুর্নীতি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন। আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের এক সময়কার প্রসিকিউটর এই ওকাম্পোর বিরুদ্ধেই সম্প্রতি দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। বিশ্বব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে বহু বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সংশ্লিষ্ট সময়ের আমাদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাহেব বিশ্বব্যাংকের সততা বিভাগকে ‘অপদার্থ’ আখ্যায়িত করে সেটি বন্ধের দাবি তুলেছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন বিশ্বব্যাংকের মতো একটি প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের অপদার্থ বিভাগ থাকার কোনো অধিকার নেই। এই বিভাগকে তিনি ‘রাবিশ’ বলে তিরস্কার করে বলেছিলেন, ‘এটি নিয়ে আমি সারা জীবনই কথা বলবো।’
এরই মধ্যে বাংলাদেশ সরকার কারও মুখাপেক্ষী না থেকে নিজ অর্থেই সেতু তৈরির সিদ্ধান্ত নিলে একে অনেকেই অবান্তর, অসম্ভব, অতি উচ্চাভিলাষী  সিদ্ধান্ত বলে উড়িয়ে দিয়ে বলেন যে বাংলাদেশের পক্ষে এটি সম্ভব হবে না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা এবং সাহস তার পিতার মতোই বিধায় তিনি কারও কথায় ভেঙে পড়েননি, আর তার এই অপ্রতিরোধ্য সিদ্ধান্তের ফলেই আজ পদ্মা সেতু বাস্তবতা পেলো। পদ্মা নদীর মতো কঠিন স্রোতের নদী, বিভিন্ন জায়গায় যার গভীরতা, পানির নিচে বালু এবং পলিমাটির অবস্থান বিপজ্জনক, সেখানে সেতুর জন্য খুঁটি গাথা ছিল দুরূহ এক কাজ, যার জন্য ব্যবহার করতে হয় অত্যন্ত শক্ত লোহার তৈরি বিম। ভূমিকম্পের সম্ভাব্য ক্ষতি রোধে নেওয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা, বিমগুলো যে গভীরে গাথা হয়েছে, পৃথিবীর কোনো সেতুতেই তা হয়নি। আসাম রাজ্যে ভূপেন হাজারিকা সেতু নির্মাণের জন্য বিম যত গভীরে গাথা হয়েছে, পদ্মার বিম তার থেকে বহুগুণ গভীর। কীর্তিনাশা নামে পরিচিত পদ্মা বারবার গতি পরিবর্তন করার কারণে এবং জমি ভাঙা রোধকল্পে যেসব বিশেষ কারিগরি এবং সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়, তা আগে কোথাও হয়নি। বিমগুলো গাঁথার জন্য চীন থেকে আনা হয় এক বিশেষ যন্ত্র, যা আগেও কোথাও ব্যবহৃত হয়নি।
সেতু তৈরি সম্পন্ন হওয়ার আগে দেশের মঙ্গল চায় না হেন লোকরা বলে বেড়াতো, এ সেতু হবার নয়। এ সব শত্রুরাই বিশ্বব্যাংককে প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু এরা যখন দেখলো সেতুর কাজ প্রায় শেষ, তখন এদের মাথা খারাপ হয়ে গেল, উন্মাদের মতো বলতে লাগলো অনেক অবান্তর কথা, যেমন এই সেতুর ভিত্তি নাকি খালেদা জিয়া স্থাপন করেছিল, যা কি না বিশ্ব দরবারে প্রকাশিত অন্যতম মিথ্যাচার। আগে বলা হয়েছে সেতুতে তারা উঠবে না, কেননা এটি ভেঙে যাবে, এমন কথাও বলা হয়েছে যে এই সেতুর জন্য শিশু হত্যা করার জন্য ছেলে ধরা লাগানো হয়েছে, যে কারণে কিছু লোক এক নিরপরাধ মহিলাকে হত্যা করেছে। তাদের অন্তরজ্বালার কারণ স্পষ্ট। এই সেতু চালু হবার পর বাংলাদেশের শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক অবস্থায় আসবে বিপ্লবী পরিবর্তন, জিডিপি বেড়ে যাবে আড়াই শতাংশ। দক্ষিণ অঞ্চলে মালামাল চলাচলে ঘটবে অভাবনীয় পরিবর্তন, ফেরির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হবে না। দ্রব্যমূল্যে এর ইতিবাচক প্রভাব হবে দৃশ্যমান, জনদুর্ভোগ বহুলাংশে কমে যাবে, মোংলা বন্দরে বাণিজ্য বহুগুণ বেড়ে যাবে, বঙ্গোপসাগরে মৎস্য এবং সাগরের তলদেশে থাকা সম্পদ আহরণ অনেক সহজ হবে, বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যেও বাংলাদেশের ঘাটতি কমে আসবে। এর ফলাফল এতই বহুমুখী হবে যে একে এক অবিশ্বাস্য অর্থনৈতিক বিপ্লব বলা যাবে। সেতুটির কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থায় হবে বিস্ময়কর উন্নতি যার থেকে বাংলাদেশসহ সে দেশগুলোও লাভবান হবে। এ সেতুর মঙ্গলময় দিকগুলোর ফিরিস্তি এতই দীর্ঘ যে তা প্রকাশ করা অসম্ভব বিধায় শত্রুরা ভাবছে এর ফলে বর্তমান সরকারকে সুদূর ভবিষ্যতেও সরানো যাবে না, আর তাই তাদের গাত্রদাহ। ২০০৯-২০১৩ মেয়াদে পদ্মা সেতু নির্মাণ ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের অঙ্গীকার।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর যখন ‘পদ্মা সেতু’ প্রকল্পের মতো একটি মেগা প্রজেক্ট হাতে নেওয়া হয়, তখন পদ্মা সেতু প্রকল্পের কোনো প্লান ছিল না। চূড়ান্ত ডিজাইন ছিল না। অর্থের সংস্থান ছিল না। ছিল না কোনো দাতা সংস্থার কমিটমেন্ট। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পর দ্রুত একে একে সব পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়। এ সময় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার স্বার্থে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর সকল সিদ্ধান্ত, টেন্ডার কার্যক্রমের সকল নথিপত্র টিআইবিতে পাঠানো হতো।
গোটা পৃথিবীতে চমক লাগিয়ে অবশেষে পদ্মা সেতু নির্মিত হলো। দেশের মানুষ আজ কত খুশি হয়েছে তার একটি বড় প্রমাণ তারা মান্না দের কফি হাউজের আড্ডা গানটির অনুকরণে গাইতে শুরু করেছে, ‘পদ্মা সেতুর শত্রুরা আজ আর নেই।’ এটি একদিকে যেমন বাংলাদেশের, বিশেষ করে অসীম সাহসী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাফল্য নিরঙ্কুশভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের মর্যাদা এবং বিশ্বাসযোগ্যতাকে ভূলুণ্ঠিত করে দিয়েছে। এই সংস্থার গঠন প্রণালী এবং ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন বলে বিশ্বব্যাপী অনেক অভিজ্ঞজনই মনে করছেন। তারা নিশ্চিত হয়েছেন যে পদ্মা সেতুর ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে বিপ্লব ঘটবে তা শিগগিরই দেশটিকে উন্নয়নের এক অধরা শৃঙ্গে পৌঁছে দেবে।

লেখক: আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি