স্বপ্নের পদ্মা সেতু

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ
 | প্রকাশিত : ২৫ জুন ২০২২, ১৫:২৩

পদ্মা সেতু চালু হলে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের সঙ্গে এ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হবে। পিছিয়ে পড়া এই অঞ্চল ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আরও মনোযোগ কাড়বে, গড়ে উঠবে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা। এ সেতু দিয়ে বাংলাদেশ যুক্ত হতে পারবে এশিয়ান হাইওয়েতে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির চাকা ঘোরার পাশাপাশি বাড়বে কর্মসংস্থান।

পদ্মা সেতু বাংলাদেশের পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত একটি বহুমুখী সড়ক ও রেলসেতু। এর মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের সাথে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলা যুক্ত হবে। ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের ২১টি জেলার সাথে উত্তর-পূর্ব অংশের সংযোগ ঘটবে। ২১টি জেলা হলো- খুলনা বিভাগের খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা। বরিশাল বিভাগের বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ঝালকাঠি এবং ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী। ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য পদ্মা সেতু হতে যাচ্ছে এর ইতিহাসের একটি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং নির্মাণ প্রকল্প। দুই স্তরবিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাস ব্রিজটির ওপরের স্তরে আছে চার লেনের সড়কপথ এবং নিচের স্তরটিতে আছে একটি একক রেলপথ।

২০০৬-০৭ সালে প্রকল্প প্রস্তুতির সাথে যুক্ত কিছু লোকের দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় বিশ্বব্যাংক তার অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে নেয় এবং অন্য দাতারা সেটি অনুসরণ করে। এই ঘটনায় তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় ও সচিব মোশাররফ হোসেন ভূইয়াকে জেলেও যেতে হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এমন কোনো অভিযোগ প্রমাণ না পাওয়ায় কানাডিয়ান আদালত মামলাটি বাতিল করে দেয়। দুর্নীতির অভিযোগ পরবর্তী সময়ে আদালতে খণ্ডিত হয়। প্রকল্পটি বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব স¤পদ থেকে অর্থায়ন করা হয়েছে।

স্বপ্নের বাস্তবায়ন শুধুই শেখ হাসিনার অবদান। ‘পদ্মা আমার মা’ গানটি যিনি লিখেছিলেন তিনি কি জানতেন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পদ্মা নদীর ওপরে নিজ অর্থে নির্মিত পদ্মা সেতু কী অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার একক সাহসী সিদ্ধান্তে নিজের টাকায় পদ্মা সেতু ২৫ জুন উদ্বোধন হচ্ছে। আমাদের নিজের টাকায় পদ্মা সেতু হয়েছে। এটা জাতির জন্য বিরাট গৌরবের, আত্মমর্যাদার, সম্মানেরও বটে।

আরেকটা কথা না বললেই নয়, পদ্মা সেতুর বদান্যতায় একসঙ্গে রেলসেতুও হতে যাচ্ছে। এটা অবশ্যই বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটা বড় কিছু পাওয়া। আমাদের মনে রাখতে হবে, সেতুটি এমন এক নদীর ওপর হয়েছে, যা পৃথিবীর অন্যতম খরস্রোতা নদী। পদ্মা এমন এক নদী, যেটি একেক সময় একেক রূপ ধারণ করে। ফলে নদীশাসন করে পদ্মা সেতু করতে গিয়ে মানের বেলায় কোনো ধরনের আপস করা হয়নি।

পদ্মা সেতু তৈরি হয়েছে মূলত দেশীয় উপকরণ দিয়ে। সেতু তৈরিতে সবচেয়ে বেশি লাগে দুটি উপকরণ। একটি হলো স্টিল, অন্যটি সিমেন্ট। আমাদের দেশে যথেষ্ট ভালো মানের সিমেন্ট ও স্টিল তৈরি হয়। শুধু স্টিল আর সিমেন্টই নয়, রড, বালু, পাথরসহ অন্য যেসব উপকরণ পদ্মা সেতুতে ব্যবহৃত হয়েছে, সব উপকরণই ছিল সর্বোচ্চ মানের। যারা এসব উপকরণ সরবরাহ করেছে, তারা সবাই ছিল সতর্ক। তাই পদ্মা সেতুতে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহারের কোনো সুযোগই ছিল না। এটিও জাতির জন্য একটি বড় গৌরবের বিষয়।

মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা আর মুন্সীগঞ্জের লৌহজং-টঙ্গিবাড়ী উপজেলার মানুষের জীবন-জীবিকায় এক আলোর প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছে এই স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এ সেতু নির্মাণ ছিল সরকারের জন্য এক মর্যাদার লড়াই যা দাতা সংস্থাদের দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ সবকিছুই পারে। তাই এ সেতু নির্মাণের সফলতা আমাদের জন্য বিজয়ের ৫০ বছরের সবচেয়ে বড় পুরস্কার।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই ১৯৯৮ সালে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেই উদ্যোগের পথ ধরে ২০০১ সালে জাপানিদের সহায়তায় সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয় এবং ২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়া পয়েন্টে পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু পরবর্তী সাত বছর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় না থাকায় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় পদ্মা সেতু প্রকল্পের গতি থমকে যায়। তারপর সৃষ্টিকর্তার পরম মহিমায় ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার বিজয়ী হলে প্রকল্পটি ফের গতি পায়। ২০০৯ সালের ১৯ জুন পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নের প্রস্তাব মন্ত্রিসভা অনুমোদন করে এবং তার ১০ দিন পর ২৯ জুন চুক্তি হয় পরামর্শকের সঙ্গে।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য পদ্মা সেতু ইতিহাসের একটি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং নির্মাণ প্রকল্প। দুই স্তরবিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাস ব্রিজটির (ঃৎঁংং নৎরফমব) ওপরের স্তরে থাকবে চার লেনের সড়কপথ এবং নিচের স্তরটিতে থাকবে একটি একক রেলপথ। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে ৪১টি স্প্যান বসেছে, ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ১৮.১০ মিটার প্রস্থ পরিকল্পনায় নির্মিত হয়েছে দেশটির সবচেয়ে বড় সেতু। ২৫ জুন উদ্বোধনের পর ২৬ জুন খুলে দেওয়া হবে যান চলাচলের জন্য।

পদ্মা সেতুর পাইল বা মাটির গভীরে বসানো ভিত্তি এখন পর্যন্ত বিশ্বে গভীরতম। সর্বোচ্চ ১২২ মিটার গভীর পর্যন্ত গেছে সেতুর অবকাঠামো। ১০ ডিসেম্বর বহুল কাক্সিক্ষত এ সেতুর সর্বশেষ স্টিলের কাঠামো স্প্যান বসানো হয়। ৪১তম ¯প্যান বসানোর পর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতুর পুরোটাই দৃশ্যমান হয়। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তে প্রথম ¯প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমানতা শুরু হয় স্বপ্নের পদ্মা সেতুর। বাকি ৪০টি ¯প্যান বসাতে তিন বছর দুই মাস লাগে।

পদ্মা বহুমুখী সেতুর স¤পূর্ণ নকশা এইসিওএমের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরামর্শকদের নিয়ে গঠিত একটি দল তৈরি করে। বাংলাদেশের প্রথম বৃহৎ সেতু প্রকল্প যমুনা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল তৈরি করা হয়। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে ১১ সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সভাপতি নিযুক্ত করা হয়। এ প্যানেল সেতুর নকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন পর্যায়ে প্রকল্প কর্মকর্তা, নকশা পরামর্শক ও উন্নয়ন সহযোগীদের বিশেষজ্ঞ পরামর্শ প্রদান করেন।

প্রথম দিকে পদ্মা নদীর তলদেশের মাটি খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয় সেতু নির্মাণকারী প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞদের। তলদেশে স্বাভাবিক মাটি পাওয়া যায়নি। সেতুর পাইলিং কাজ শুরুর পরে সমস্যা দেখা যায়। প্রকৌশলীরা নদীর তলদেশে কৃত্রিম প্রক্রিয়ায় মাটির বদলে নতুন মাটি তৈরি করে পিলার গাঁথার চেষ্টা করে। স্ক্রিন গ্রাউটিং নামের এই পদ্ধতিতেই বসানো হয় পদ্মা সেতু।

প্রস্তাবিত পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প মাওয়া-জাজিরা পয়েন্ট দিয়ে নির্দিষ্ট পথের মাধ্যমে দেশের কেন্দ্রের সাথে দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সরাসরি সংযোগ তৈরি করবে। এই সেতুটি অপেক্ষাকৃত অনুন্নত অঞ্চলের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিল্প বিকাশে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখবে। প্রকল্পটির ফলে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৪৪ হাজার বর্গ কি.মি. (১৭ হাজার বর্গমাইল) বা বাংলাদেশের মোট এলাকার ২৯ শতাংশ অঞ্চলজুড়ে তিন কোটির অধিক মানুষ প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হবে। ফলে প্রকল্পটি দেশের পরিবহন নেটওয়ার্ক এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে।

সেতুটিতে রেল, গ্যাস, বৈদ্যুতিক লাইন এবং ফাইবার অপটিক কেবল সম্প্রসারণের ব্যবস্থা রয়েছে। রেললাইন বসানোর কাজও শেষ পর্যায়ে। এই সেতুটি নির্মিত হলে দেশের জিডিপি ১.২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে।

পদ্মা বহুমুখী সেতু চালু হলে শিল্পায়ন ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় তিন কোটি মানুষের জীবনে পরিবর্তন আসবে। বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশের মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ বা কমপক্ষে তিন কোটি মানুষ সরাসরি এই সেতুর মাধ্যমে উপকৃত হবে। এতে বলা হয়, এই সেতুর মাধ্যমে আঞ্চলিক বাণিজ্য সমৃদ্ধ হবে, পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন হবে এবং উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির গতি ত্বরান্বিত হবে। দেশের ওই অঞ্চল থেকে রাজধানী ঢাকার দূরত্ব গড়ে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত কমবে।

আরেক সমীক্ষায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলেছে, পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দেশের আঞ্চলিক ও জাতীয় অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে লক্ষণীয় অগ্রগতি হবে। মানুষ ও পণ্য পরিবহনে সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে; যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ, জ্বালানি ও আমদানি ব্যয় হ্রাস পাবে। এডিবির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সেতুর মাধ্যমে শিল্পায়ন ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড প্রসারের লক্ষ্যে পুঁজির প্রবাহ বাড়বে, পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের জন্য অর্থনৈতিক ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এছাড়াও স্থানীয় জনগণ উন্নততর স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য খুব সহজেই রাজধানী ঢাকা যেতে পারবেন। এডিবির মতে, এই সেতুর ফলে দেশের জিডিপি ১ দশমিক ২ শতাংশ এবং আঞ্চলিক জিডিপি ৩ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।

সর্বোপরি পদ্মা বহুমুখী সেতু কেবল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতিই বদলে দেবে। আরও বিশদভাবে বলতে গেলে এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সব মিলিয়ে এই সেতু আসলেই দেশের মানুষের স্বপ্নের সেতু হয়ে বাস্তবে ধরা দিয়েছে।

জাতির জনকের স্বপ্ন পূরণের জন্যই যেন মহান আল্লাহ্তায়ালা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ২১ বার হত্যাচেষ্টা সত্ত্বেও বাঁচিয়ে রেখেছেন। শেখ হাসিনা আমাদের আশার বাতিঘর, বাংলাদেশের রক্ষাকবচ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বিদ্যুৎ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, যোগাযোগ ও সামাজিক অবস্থান সর্বক্ষেত্রে জননেত্রী শেখ হাসিনা সফলতার সঙ্গে বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

লেখক: উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :