পদ্মা সেতু বাঙালির জীবনে দ্বিতীয় সর্বোত্তম ঘটনা

প্রকাশ | ২৫ জুন ২০২২, ১৭:০৩

আকরাম-আল-হোসেন

পদ্মা সেতু একসময় স্বপ্ন ছিল। শুধু আমাদের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন ছিল তা কিন্তু নয়, এটা সারা জাতির স্বপ্ন ছিল। আমাদের বড় দুটি নদী যুমনা ও পদ্মা। এই দুই নদীর ওপারের মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় এগিয়ে। সেই হিসাবে যমুনা সেতু হয়ে যাওয়ার পর পদ্মা সেতু হওয়াটা খুবই অনিবার্য বিষয় ছিল। কারণ পদ্মা সেতু কেবল দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নই ঘটাবে না, সারা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

 
আমি মনে করি যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। এই স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন সেই ১৯৪৮ সালে, ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার সময়। সেই সময় তার যে রাজনৈতিক অনুসারীরা ছিলেন, তাদের তিনি গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। যে কারণে ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত ছয় দফা সারা দেশের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। ছয় দফা ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ।

পরবর্তীকালে এই ছয় দফাই ১৯৬৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধুতে রূপান্তরিত করেছিল। ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৬ সাল অর্থাৎ ১৯ বছর তিনি যোগ্য অনুসারী ও সহকর্মী তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তারাই পরে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফাকে সাড়ে সাত কোটি মানুষের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন।

ছয় দফা ছিল বাঙালির মুক্তির একমাত্র কর্মসূচি, যার ভিত্তিতে বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালের নির্বাচন, মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশ আমরা পেলাম। এই দীর্ঘ ২৩ বছরের প্রক্রিয়ার মধ্যে ১৯ বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ওই সময় যদি বঙ্গবন্ধু সঠিক কর্মী তৈরি করতে না পারতেন, তাহলে ইতিহাস কোথায় গিয়ে দাঁড়াত বলা কঠিন।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। একইভাবে বঙ্গবন্ধু-কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছেন। পদ্মা সেতু সারা দেশে অর্থনীতিকে ত্বরান্বিত করতে হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বপ্ন দেখেছেন, যে করেই হোক পদ্মা নদীতে তিনি সেতু গড়বেন। সেই স্বপ্ন তিনি বাস্তবায়ন করেছেন। বঙ্গবন্ধু যেভাবে বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছেন, ঠিক একইভাবে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করেছেন তারই সুযোগ্য কন্যা। কারণ এই সেতু বাস্তবায়ন ঠেকাতে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। বিশ্বের বড় বড় শক্তি বিরোধিতা করেছে পদ্মা সেতুর। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি ‘বাংলাদেশের টাকায় পদ্মা সেতু হবে’- এমন সঠিক সিদ্ধান্ত, দৃঢ় সিদ্ধান্ত এবং সাহসী পদক্ষেপ না নিতেন, তাহলে এটি কোনোদিনই বাস্তবায়ন হতো না।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।’ এই আহ্বানের পর গ্রামের মানুষ কিন্তু বাঁশের লাঠি নিয়ে প্রশিক্ষণে নেমে গেছে। অসীম সাহস নিয়ে পৃথিবীর অন্যতম সুসজ্জিত সেনাবাহিনী পাকিস্তান আর্মির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ঠিক বঙ্গবন্ধু কন্যাও একই কাজ করেছেন। বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, জাইকাসহ সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা করার পরও তিনি বলেছেন, আমাদের দেশের সম্পদেই পদ্মা সেতু হবে। সেটা যে বাস্তবায়ন করা সম্ভব, তা তিনি করে দেখিয়েছেন। এটা কেবল বঙ্গবন্ধু-কন্যার জন্য সম্ভব হয়েছে।

অনেক অর্থনীতিবিদ কিন্তু বলেছেন, নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু সম্ভব নয়। সবাই বিরোধিতা করেছিলেন। বলেছিলেন, দেশীয় সম্পদে পদ্মা সেতু করতে গেলে আমাদের অর্থনীতিতে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে। এত দিনে আমরা দেখেছি, ওই আশঙ্কার কিছুই তো হয়নি। এটাই হলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় সাহসের পদক্ষেপের পরিচয়। এই পদ্মা সেতু সারা পৃথিবীর জন্য গেটওয়ে হয়ে যাবে।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ গোটা জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ঠিক একইভাবে যখন সবাই বিরোধিতা করল, মুখ ফিরিয়ে নিল, তখন কিন্তু বঙ্গবন্ধু-কন্যা সাহস হারাননি। তিনি জাতির পিতার কন্যা বলেই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তিনি বলেছেন, পদ্মা সেতু তিনি জাতিকে উপহার দেবেন। এটা দেশীয় সম্পদেই হবে।
আরেকটি কথা, এই পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির যে অভিযোগ করা হয়েছে, শুরু থেকেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এর বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করে আসছেন। ইতিপূর্বে কোনো রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান এভাবে বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার নজির নেই।
বিশ্বব্যাংকের পেছনেও অনেক ক্ষমতাধর রাষ্ট্র ছিল। তাদের চ্যালেঞ্জ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘তোমরা প্রমাণ করে দেখাও।’ শেষ পর্যন্ত তারা কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। কানাডার একটি আদালতে সুস্পষ্ট রায় এসেছে যে, বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ মিথ্যা। তাই একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, মুক্তিযুদ্ধের পরে পদ্মা সেতু নির্মাণই বাঙালির জীবনে দ্বিতীয় সর্বোত্তম ঘটনা।

লেখক: চেয়ারম্যান, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক।