প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন প্রযুক্তিপণ্যের রপ্তানিকারক দেশ

প্রকাশ | ২৬ জুন ২০২২, ১৮:৩৬ | আপডেট: ২৭ জুন ২০২২, ১০:৩৮

জুনাইদ আহমেদ পলক

১৯৯৩ সালের কথা। বাংলাদেশের মানুষের কাছে মোবাইল ফোন ছিল একটি বিলাসী পণ্য। সেলফোন বিক্রি ও সেবা প্রদানের জন্য লাইসেন্সপ্রাপ্ত ছিল তৎকালীন বিএনপি সরকারের প্রভাবশালী একজন মন্ত্রীর মালিকানাধীন একমাত্র প্রতিষ্ঠান। স্মৃতি যদি বিশ্বাসঘাতকতা না করে এ কথা অনেকেরই স্মরণে থাকার কথা, তখন একটি সেলফোন কিনতে হতো এক লাখ টাকার বেশি দিয়ে। আর অদ্ভুত একটা ব্যাপার ছিল শুধু ফোন ব্যবহারকারীকে কল করার জন্যই নয়, এ ফোন কেউ রিসিভ করলে তাকেও টাকা গুনতে হতো। জনস্বার্থ উপেক্ষা করে সরকার কর্তৃক একজন ব্যবসায়ী মন্ত্রীর প্রতিষ্ঠানকে মনোপলি ব্যবসার সুযোগ করে দেওয়ার এমন উদাহরণ বিশ্বে বিরল।

প্রশ্ন হলো বিএনপি সরকার কর্তৃক একটি প্রতিষ্ঠানকে এককভাবে ব্যবসার সুযোগ দিয়ে কোটি কোটি টাকা লোপাটের ব্যবস্থা করাই কি এর লক্ষ্য ছিল? এর উত্তর এটা একমাত্র লক্ষ্য ছিল না। কারণ মোবাইল প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও বিকাশ বাধাগ্রস্ত করাও ছিল এর অন্যতম লক্ষ্য। ঠিক যেমনটি করা হয়েছিল আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট সাবমেরিন ক্যাবল সাউথ ইস্ট-মিডল ইস্ট-ওয়েস্টার্ন ইউরোপে (সি-মি-উই) বিনা অর্থব্যয়ে সংযুক্ত হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে।
এখানেই শেষ নয়। ২০০৪ সালে হাওয়া ভবনের কর্ণধার অনৈতিকভাবে অর্থ দাবি করায় বিশ্বখ্যাত দক্ষিণ কোরিয়ার  স্যামসাং কোম্পানি বাংলাদেশে মোবাইল ফোন উৎপাদনে বিনিয়োগ না করে ভিয়েতনামে চলে যায়। বর্তমান সময় পর্যন্ত স্যামসাং ভিয়েতনাম থেকে ৭০ বিলিয়ন ডলার পণ্য রপ্তানি করে। তাদের কারখানায় কর্মসংস্থান হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার মানুষের। অথচ এটা হওয়ার কথা ছিল আমাদের দেশে। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের বিনিয়োগবান্ধব নীতি ও সহায়তার কারণে মেইড ইন বাংলাদেশ লেখা স্যামসাং ব্র্যান্ডের মোবাইল এখন নরসিংদীতে তৈরি হচ্ছে। রপ্তানি হচ্ছে বিভিন্ন দেশে।

সিটিসেলের একটি সেলফোনের দাম লক্ষাধিক টাকা হওয়ায় সে সময়ে মোবাইল ফোনের বাজার বলতে কিছুই ছিল না। একটি সেলফোন হয়ে ওঠে মুষ্টিমেয় মানুষের বিলাসদ্রব্য ও আভিজাত্যের প্রতীক। অথচ আজকের বাস্তবতা কী? দেশে সেলফোন ব্যবহারকারী ১৭ কোটির বেশি। দেশের শতভাগ এলাকা মোবাইল ফোন কভারেজের আওতায়। কথা বলা, তথ্য আদান-প্রদান এবং হাতের মুঠোয় সেবা পেতে মোবাইল ফোন অতি প্রয়োজনীয় একটি পণ্য। প্রতি বছর মোবাইল ফোন বিক্রি হয় প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার এবং চাহিদা রয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি ৭৫ লক্ষের বেশি ইউনিটের।
অবাক বিস্ময় হলো, মোট মোবাইল ফোনের চাহিদার  ৯০ শতাংশই পূরণ করা হচ্ছে স্থানীয়ভাবে। স্যামসাং, নোকিয়া, ভাইভো, সাওমি, অপ্পোর মতো নামি-দামি ব্র্যান্ডের ফোন বাংলাদেশেই তৈরি হচ্ছে। ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখা মোবাইল ফোন দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। শুধু বিদেশি নয় বাংলাদেশি কোম্পানিসহ ১৫টি প্রতিষ্ঠান স্থানীয়ভাবে মোবাইল ফোন সেট উৎপাদন করছে। প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, এটা কেমন করে সম্ভব হলো? অতি সম্প্রতি সাভারে মোবাইল সেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিম্ফোনির কারখানা পরিদর্শনের সময় আমার মনেও এমন প্রশ্নই শুধু নয়, বিশেষভাবে মনে পড়ছিল নেপথ্যের গল্প। দেশে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের বিকাশ এবং ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখা পণ্যের রপ্তানিকারক দেশ হতে নানা উদ্যোগের কথা।
সরকার যদি দেশপ্রেমিক এবং জনতাবান্ধব হয় তার সিদ্ধান্ত, পরিকল্পনা, আইন ও নীতিমালাসমূহ আবর্তিত হয় দেশ ও মানুষের উন্নয়ন ঘিরে। প্রথমে তেমনি একটি গণমুখী সিদ্ধান্তের কথাই তুলে ধরছি।
১৯৯৬ সালে জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে মোবাইল ফোনের মনোপলি ব্যবসার সুযোগ বন্ধ করে দিয়ে তা সবার কাছে উন্মুক্ত করে দেন। এই একটি সিদ্ধান্তের প্রভাব যে কতটা তা বোঝা যায় যখন আমরা দেখি দেশেই মোবাইল ফোনের উৎপাদন সক্ষমতা ৪ কোটি ইউনিটের বেশি।
দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি দেশে প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদনের পথ সুগম করতে ১৯৯৯ সালে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে হাইটেক পার্ক নির্মাণের সিদ্ধান্ত। যদিও ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে এ সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন করেনি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে দেশে ৩৯টি হাইটেক ও আইটি পার্ক এবং আইটি ইনকিউবেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করছে। ইতোমধ্যে নির্মিত ০৯টি পার্কে ১২৩টি প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করেছে। বর্তমানে হাইটেক পার্কসমূহে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২০০০ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রায় ৪৩৯ মিলিয়ন ডলার।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তৃতীয় নির্দেশনাটি আমাদের রপ্তানিকারক দেশ হওয়ার পথচলাকে দ্রুততর করে। ২০১৫ সালের ৬ আগস্ট ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের দ্বিতীয় সভায় আলোচনার একপর্যায়ে তিনি দেশেই ডিজিটাল ডিভাইস উৎপাদনের নির্দেশনা দেন। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমদানিকারক দেশ হিসেবে নয়, রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে নিজেদের পরিচিত করতে চাই।’
এটা অনস্বীকার্য যে, ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে খ্যাতিমান তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সজীব ওয়াজেদ জয় সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন, ভাবনা ও সিদ্ধান্তসমূহ দ্রুত বাস্তবায়িত হয়। তারই পরামর্শে দেশেই প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদনের জন্য নীতি সহায়তাসহ নানা সুবিধা দেওয়া হয়। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ট্যাক্স হলিডে ঘোষণা করা হয়। হার্ডওয়্যার সংযোজন বা উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামালের ওপর আমদানি শুল্ক কমিয়ে ১ শতাংশ করা হয় এবং আইটি/আইটিইএস খাতে রপ্তানিতে ১০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা ঘোষণা দেওয়া হয়। ফলে দেশেই তৈরি হচ্ছে বিশ্বমানের ডিজিটাল ডিভাইস বা পণ্য।
একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, অবকাঠামো উন্নয়নসহ সরকারের বিনিয়োগবান্ধব উদ্যোগ,  প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা প্রদানের ফলে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে হাইটেক পণ্য উৎপাদনের আকর্ষণীয় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। দেশের হাইটেক  ও সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে দেশ-বিদেশের নামি-দামি কোম্পানি হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার পণ্য উৎপাদন করছে।
বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডে পরিণত করতে যেসব চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার প্রয়োজন, সে সম্পর্কে সরকার অবগত। দেশে ওয়ালটন তৈরি করছে টিভি, ফ্রিজ, এসি, ল্যাপটপ, পিসি, মোবাইল ফোনসহ নানা সামগ্রী। এসব পণ্যসামগ্রী শুধু দেশেই ব্যবহৃত হচ্ছে না রপ্তানিও হচ্ছে।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের নোকিয়া ফোন তৈরি হচ্ছে দেশেই। ফেয়ার গ্রুপ স্যামসাংয়ের সহায়তায় তৈরি করছে স্মার্টফোন। স্যামসাংয়ের আর কোনো স্মার্টফোন বাংলাদেশে আমদানি হবে না বরং বাংলাদেশ থেকে বিদেশে রপ্তানি হবে। ফেয়ার গ্রুপ তৈরি করছে টিভি, ফ্রিজ এবং আগামীতে তৈরি করতে যাচ্ছে ইলেকট্রিক গাড়ি।
এ ছাড়াও ওয়ালটন, স্যামসাং, সিম্ফনিসহ ৭২টি প্রতিষ্ঠান কালিয়াকৈরে বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটিতে উৎপাদন কার্যক্রম শুরুর প্রস্তুতি, সিলেটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাইটেক পার্কে র‌্যাংগস ইলেকট্রনিক্স লিমিটেডসহ ২০টি কোম্পানিকে জমি ও স্পেস বরাদ্দ প্রদান, র‌্যাংগস ইলেকট্রনিক্সের ৩২ একর জমিতে আগামী তিন বছরের মধ্যে রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন, এয়ার কন্ডিশনার (এসি), হোম এন্ড কিচেন এপ্লায়েন্সেস এবং মোল্ডিং উৎপাদনে পৃথক পাঁচটি ফ্যাক্টরি স্থাপন ও  ৮০ মিলিয়ন মার্কিন বিনিয়োগের ঘোষণা, চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কোরিয়ান ইপিজেডে বেসরকারি হাইটেক পার্ক নির্মাণকাজ শুরু এবং প্রাথমিকভাবে ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা আগামীতে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
প্রযুক্তিপণ্যে উৎপাদক বা রপ্তানিকারক দেশ হওয়ার লক্ষ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ সজীব ওয়াজেদ জয়ের নির্দেশে ইতোমধ্যে মেইড ইন বাংলাদেশ-আইসিটি ইন্ডাস্ট্রি স্ট্রাটেজি প্রণয়ন করেছে। প্রথমে স্ট্রাটেজি করা হলেও আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ‘মেইড ইন বাংলাদেশ-আইসিটি ইন্ডাস্ট্রি পলিসি’ প্রণয়ন। ‘মেইড ইন বাংলাদেশ-আইসিটি ইন্ডাস্ট্রি স্ট্রাটেজি’ এমন একটি দলিল যাতে স্থানীয়ভাবে গুণগত মানের ডিজিটাল পণ্য উৎপাদনে উৎসাহিত করা ও প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এর ফলে আমদানি নির্ভরতা কমবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।
খসড়ায় রয়েছে ৬৫টি কর্মপরিকল্পনা, যা তিন মেয়াদে অর্থাৎ স্বল্প মেয়াদ ২০২১ থেকে ২০২৩, মধ্য মেয়াদ ২০২১ থেকে ২০২৮ এবং দীর্ঘ মেয়াদে ২০২১ থেকে ২০৩১ পর্যন্ত সময়ে বাস্তবায়ন করা হবে। স্বল্প মেয়াদে এমন কিছু কাজের বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে যা সময়ের দাবি। যেমন ২০২৩ সালের মধ্যে দেশে ৫ লাখ দক্ষ মানুষ তৈরি ও গুণগতমাণের পণ্য উৎপাদন নিশ্চিত করার জন্য টেস্টিং ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা।
আইন, নীতি সহায়তা এবং বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়নের ফলে দেশে ডিজিটাল অর্থনীতির বিকাশ ঘটছে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে দেশের আইসিটি রপ্তানি ছিল মাত্র ২৬ মিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে ১.৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। ২০২৫ সালে আইসিটি রপ্তানি ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে সরকার।
একটি দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির নেপথ্যের নানা কারণ থাকে। তবে রাষ্ট্র পরিচালনায় দূরদর্শিতা, গণমুখী দৃষ্টিভঙ্গি, সুপরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নে আন্তরিকতাÑ এ চারটি বিষয় সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমনই দূরদর্শিতা ও গণমুখী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নানা খাতের সাথে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতেও বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে প্রযুক্তির ভিত রচনা করে গেছেন।
ভেবে অবাক হতে হয়, সেই ১৯৭৫ সালেই বঙ্গবন্ধু রেডিও-টেলিভিশন প্রযুক্তিপণ্য দেশে উৎপাদনের নির্দেশনা দেন। বঙ্গবন্ধু দেশেই যে প্রযুক্তির ভিত রচনা করে গেছেন তার ওপর দাঁড়িয়েই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করেন। বাংলাদেশকে প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদকের দেশে পরিণত করার নানা উদ্যোগের বাস্তবায়ন করায় ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখা পণ্য এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে, যা আমাদের জন্য শুধু মর্যাদাকরই নয়, গর্বেরও।

লেখক: সংসদ সদস্য এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী।