প্যারাডাইস-পানাামা পেপারস কেলেঙ্কারি

তদন্তে সিআইডির উচ্চপর্যায়ের টিম

প্রকাশ | ০৬ জুলাই ২০২২, ০৮:১১ | আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২২, ০৯:৫৬

সৈয়দ ঋয়াদ, ঢাকাটাইমস

বহুল আলোচিত পানামা ও  প্যারাডাইস পেপার্স কেলেঙ্কারিতে জড়িত বাংলাদেশিদের অর্থ পাচার সংক্রান্ত তদন্তের দায়িত্ব পড়েছে সিআইডির ওপর। তদন্তের জন্য সিআইডির দুজন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ও চারজন সহকারী পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের  উচ্চ পর্যায়ের ছয়টি পৃথক টিম গঠন করা হয়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রের।

জানা গেছে, মানিলন্ডারিং আইনে দুদকের তদন্তে সীমাবদ্ধতার কারণে পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্স কেলেঙ্কারিতে দুদকের তদন্ত হাতছাড়া হলো। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ওই ফাইল সিআইডিকে হস্তান্তর করা হয়।
তদন্তের জন্য নিয়োজিত সিআইডি টিমের সদস্যরা হলেন-ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের সহকারী পুলিশ সুপার (টিম লিডার) আল আমিন হোসেন, একজন দুদক কর্মকর্তা ও পুলিশ পরিদর্শক মনিরুজ্জামান। দ্বিতীয় টিমে রয়েছেন ফাইন্যান্সিয়ল ক্রাইম ইউনিটের সহকারী পুলিশ সুপার (টিম লিডার) শেখ সুরাইয়া উর্মি, একজন দুদক কর্মকর্তা ও পুলিশ পরিদর্শক মীর কাশেম।

তৃতীয় টিমের নেতৃত্বে রয়েছেন সিআইডির সিরিয়াস ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. কামরুল আহসান (টিম লিডার), দুদকের একজন কর্মকর্তা ও পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ ছাদেক আলী। চতুর্থ  টিমের নেতৃত্বে রয়েছেন সিআইডির সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সহকারী পুলিশ সুপার (টিম লিডার) কাজী আবু সাঈদ, একজন দুদক কর্মকর্তা ও পুলিশ পরিদর্শক  মো. ইব্রাহিম হোসেন।

পঞ্চম টিমে রয়েছেন সিআইডির (দক্ষিণ) ঢাকা মেট্রোর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (টিম লিডার) জিসানুল হক, দুদকের একজন কর্মকর্তা ও পুলিশ পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান।

ষষ্ঠ টিমের সদস্যরা হলেন,  সিআইডির (উত্তর) ঢাকা মেট্রোর সহকারী পুলিশ সুপার মো. জাহাঙ্গীর হোসেন, একজন দুদক কর্মকর্তা ও  পুলিশ পরিদর্শক মো. মেহেদী মাকসুদ।

দুদক থেকে সিআইডিতে নথি হস্তান্তরের প্রসঙ্গে বিআইএফইউর ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়,  হাইকোর্টের গত ৩০ জানুয়ারির নির্দেশনা অনুযায়ী বিএফআইইউ ও দুদক কর্তৃক হাইকোর্টের উপস্থাপিত তালিকায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং অভিযোগের সুষ্ঠু অনুসন্ধান ও তদন্তের জন্য সরকারের পরামর্শ অনুযায়ী শর্ত সাপেক্ষে একটি যৌথ তদন্তকারী দল গঠন করা হলো।

এদিকে সিআইডির তদন্তের জন্য অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেক দেওয়া পৃথক প্রজ্ঞাপনে পাঁচটি শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, ২০১২ এর ৯(১) ধারায় সুষ্ঠু অনুসন্ধান ও তদন্তের স্বার্থে সিআইডির কাছে এই আর্থিক কেলেঙ্কারির বিষয়টি হস্তান্তর করা হয়।

এছাড়া বাকি চারটি শর্ত হলো,  সিআইডির মনোনীত কর্মকর্তা বিষয়টি অনুসন্ধান করবে। চার্জশীট দাখিলের ক্ষেত্রে যৌথ তদন্তকারী দলের প্রধান নিজ সংস্থার অনুমতি নিয়ে আদালতে দাখিল করতে হবে। চার নং শর্তে বলা হয়, অনুসন্ধান তদন্ত কাজ আইন বিধি-বিধান মেনে তদন্ত কর্মকর্তারা সম্পন্ন করবেন এবং নির্ধারিত সময়ে শেষ করবেন। 

পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্স কেলেঙ্কারি ও আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে গঠিত পুলিশের অপরাধ তদন্ত টিমে যুক্ত করা হয় দুদকের তিন কর্মকর্তাকে। তারা হলেন, সহকারী পরিচালক মো. ইসমাইল হোসেন, উপসহকারী পরিচালক সোমা হোড় ও মো. কামিয়াব আফতাহি উন নবী।

২০১৬ সালের মে মাসে পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারি ঘটনা ঘটে আর  প্যারাডাইস কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে ২০১৭ সালে। নথি ফাঁসের এই আলোচিত কাণ্ডে বিশ্বের ধনী আর ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা কোন কৌশলে কর ফাঁকি দিয়ে অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে গোপন সম্পদের পাহাড় গড়ছেন সেই তথ্য বেরিয়ে আসে।
পানামা পেপার্স ও প্যারাডাইস পেপার্স কেলেঙ্কারিতে নাম আসে বাংলাদেশের ৬১ ব্যক্তি ও আটটি প্রতিষ্ঠানের। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, মূলত জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও তা পাচারের মাধ্যমে বিদেশে বিনিয়োগ করেছেন তারা। আলোচিত এই কেলেঙ্কারির পর বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পৃথকভাবে অভিযুক্তদের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে।

পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারির  বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের যে টিম গঠন করা হয়েছে সেই টিমের একজন কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে বলেন, আমাদের এখান থেকে তিনজনকে সিআইডির অনুসন্ধান কাজে যুক্ত করা হয়। সিআইডিতে নথিপত্র হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। নথি হস্তান্তর শেষ হলে সিআইডি বিষয়টি অনুসন্ধান করবে। দুদক তাদের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সব নথি দিয়ে সহযোগীতা করবে। 

সিআইডির উচ্চ পর্যায়ের অনুসন্ধান টিমে  থাকা দুদকের অপর এক সদস্য ঢাকাটাইমসকে বলেন, পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্স কেলেংকারির বিষয়ে দুদক আগে থেকেই অনুসন্ধান করছিলো, দুদকের নথিপত্র সিআইডির কাছে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। আমরা সেগুলো নিয়ে কাজ করছি।  এর বেশি কিছু জানি না।

দীর্ঘ ছয় বছর দুদকে ঝুলে থাকার পর আলোচিত এই বিষয়টি হাতছাড়া হওয়ার বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ বলেন. মানিলন্ডারিংয়ে যে ২৮ ধরণের অপরাধ রয়েছে, সেখানে কেবল সরকারী কর্মকর্তাদের ‘ঘুষ ও দুর্নীতি’ এই একটি বিষয় অনুসন্ধান ও তদন্ত করার এখতিয়ার আছে দুদকের। এছাড়া বাকি ২৭ অপরাধের বিষয় অনুসন্ধান ও তদন্তে দুদকের এখতিয়ার নেই। পানামা ও প্যারাডইস পেপার্স আমাদের এখতিয়ার না থাকায় সিআইডিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

এর আগে ২০২১ সালে হাইকোর্টে পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্স কেলেঙ্কারি ৪৩ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তালিকা দিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আদালতে সেই তালিকা শুনানি করে অর্থ পাচারে নাম আসা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুদক কী পদক্ষেপ নিয়েছে তা জানতে চেয়ে একই বছরের ৬ ডিসেম্বর নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। 

পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্স কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত বাংলাদেশিদের মধ্যে বিএনপি নেতা আব্দুল আউয়াল মিন্টুসহ অন্তত ১৭ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। ২০১৬ সাল থেকে ছয় বছর ধরে চলে আসা এই তদন্তের বিষয়ে হাইকোর্টের এক আদেশের পর ২০২১ সালের ২৯ মার্চ দুদক আদালতে একটি লিখিত জবাব দেয়।

মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ২(ঠ) সম্পৃক্ত ২৭টি অপরাধের মধ্যে কেবল একটি অপরাধ ‘ঘুষ ও দুর্নীতি’র অনুসন্ধানের এখতিয়ার রয়েছে দুদকের। দেশি-বিদেশি মুদ্রাপাচার, জালিয়াতি, প্রতারণা, শুল্কসংক্রান্ত অপরাধ অনুসন্ধান ও তদন্তের ক্ষেত্রে দুদকের এখতিয়ার রাখা হয়নি।
দুদক কমিশনার জহুরুল হক সম্প্রতি দুদকে আইনের সংশোধন ও সাতটি বিষয়ে কাজ করার অনুমতি চেয়ে মন্ত্রিপরিষদে চিঠিও দিয়েছেন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট দুদকের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আইনের সংশোধন আনা হলে দুদকের জন্য অনেক কাজই করা সহজ হবে। মানি লন্ডারিংয়ে দুদকের কাজ করার এখতিয়ার সীমিত। কিন্তু সাধারণভাবে মনে হবে দুদকে কেন এটা করছে না ওটা করছে না? তফসিলভুক্ত না হওয়ার কারণে দুদক অর্থ পাচারের এসব বিষয়ে কোনো কাজ করতে পারছে না।’
পানামা পেপার্সে নামা আসা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান হলো-

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপ বিল্ডার্সের ক্যাপ্টেন সোহাইল হোসাইন, স্পার্ক লিমিটেডের চেয়ারম্যান ইফতেখারুল ইসলাম, বাংলা ট্র্যাক লি. এর আমিনুল হক, নাজিম আসাদুল হক ও তারিক ইকরামুল হক, বিএপিআই–এর সাবেক সভাপতি ড. এ এম এম খান, মমিন টি এর পরিচালক আজমত মঈন, সি পার্লের চেয়ারম্যান ড. সৈয়দ সিরাজুল হক, ইউনাইটেডে গ্রুপের হাসান মাহমুদ রেজা, খন্দকার মঈনুল আহসান শামীম, আহমেদ ইসমাইল হোসেন, আখতার মাহমুদ ও এফএফ জোবায়দুল হক, সিক্স সিজনসের দিলীপ কুমার মোদী, অনন্ত গ্রুপের শরীফ জহির, মার্কেন্টাইল করপোরেশনের আজীজ খান, তার স্ত্রী আঞ্জুমান আজীজ খান, মেয়ে আয়েশা আজীজ খন, ভাই জাফের উমায়েদ খান ও ভাগনে ফয়সাল করিম খান, সেতু করপোরেশনের মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও তার স্ত্রী উম্মে রাব্বানা, ক্যাপ্টেন এম এ জাইল, এফএম জোবায়দুল হক, সালমা হক, খাজা শাহাদাৎ উল্লাহ, মীর্জা এম ইয়াহিয়া, সৈয়দা সামিনা মীর্জা, আমিনুল হক, তারেক একরামুল হক, জাহিদুল ইসলাম, মোহাম্মদ শহীদ, মোহাম্মদ ফয়সল করিম খান, নজরুল ইমলাম, সৈয়দ সিরাজুল হক, জুলফিকার হায়দার এবং বিবিটিএল। 

প্যারাডাইস পেপার্সে নামা আসা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান হলো-

প্যারাডাইস পেপার্সে নাম এসেছে বিএনপি নেতা আব্দুল আউয়াল মিন্টু,– মেঘনাঘাট পাওয়ার লি. এর ফয়সাল চৌধুরী, ওয়াই ফরিদা মোগল, শহীদ উল্লাহ, সামির আহমেদ, সেভেন সিজ অ্যসেটস লি. , সোয়েন ইনভেস্টমেন্টস লি. , ব্রামার অ্যান্ড পার্টনার্স লি. , ইউনোকল বাংলাদেশ লি. , ইউনোকল বাংলাদেশ এক্সপ্লোরেশন লি. , ইউনোকল শাহবাজপুর পাওয়ার লি. , ইউনোকল শাহবাজপুর পাইপলাইন লি. , ইউনোকল বাংলাদেশ ব্লক সেভেন লি. , ইউনোকল শাহবাজপুর লি. , ইউনোকল বাংলাদেশ ব্লক ফাইভ লি. , ইউনোকল বাংলাদেশ ব্লক টেন লি. , এনএফএম এনার্জি পিটিই লি. , বারলিংটন রিসোর্সেস বাংলাদেশ লি. , ইউনোকল বাংলাদেশ ব্লকস থারটিন অ্যান্ড ফরটিন লি. , ইউনোকল বাংলাদেশ ব্লক টুয়েলভ লি. , ফ্রন্টিয়ার বাংলাদেশ (বারমুডা) লি. এবং টেরা বাংলাদেশ ফান্ড লি.।

(ঢাকাটাইমস/৬জুলাই)