এ এক অন্যরকম আনন্দ, অন্যরকম অনুভূতি

প্রকাশ | ১০ জুলাই ২০২২, ০১:২৩

রেজাউল মাসুদ

করোনার চতুর্থ ঢেউ, কাজের ব্যস্ততা, রাস্তার ঝক্কিঝামেলা, ছুটিপ্রাপ্তির অনিশ্চয়তা সব মাড়িয়ে এবারও নাড়ীর টানে চলে এসেছি। গ্রামে এসেছি মা ভাই বোন বন্ধুবান্ধব প্রতিবেশী স্বজনদের সাথে ঈদ আনন্দের মিলনমেলায় যোগ দিতে। শৈশব, কৈশোরের বর্ণিল দিনগুলোর পুরো সময়টাই কেটেছে গ্রামে, তাই গ্রামের ঈদ উৎসব আমার স্মৃতিতে সবসময়ের জন্যই দারুণ উজ্জ্বল আর অমলিন।

এমনিতে ঢাকায় ঈদ কাটানোর চেয়ে দুরূহতম কিছু নেই । বান্ধবহীন দুঃখ উদযাপন করা যায়, উৎসব একেবারেই না। রোজার ঈদে আমার ঢাকা মরুভূমি হয়ে যায়। যদিও আত্মীয় স্বজন এবং পুলিশি অনেক ফাংশন থাকে, তবুও নিজেকে কেবলই এক উটকো উট মনে হয়। মনে হয় হেথা নয় হেথা নয়…অন্য কোথা! তাই তথাকথিত শহুরে জীবন জুলুসের যতই মহড়া দেখাই না কেন, ঈদে আমাদের অধিকাংশের লক্ষ্যই থাকে নীড়ের কাছে, শেকড়ে যেতে গ্রামে ফেরার। গুরুত্বপূর্ণ পদ, দায়িত্বশীল ডেস্ক, পারিবারিক ইকোয়েশনের টানাপোড়েন, অফিসের ছুটি প্রাপ্তি, যাত্রাপথের রিস্ক ভোগান্তি এবং আনুষঙ্গিক নানা অনিশ্চয়তার পরেও এই শেকড়ের টান এবং প্রাণের আকুতিই আমাদের গ্রামে ফিরতে বাধ্য করে। বহুদিনের অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে সচল সাবলীল সরব হয়ে ওঠে আমাদের প্রিয় গ্রামগুলো। পরিবার-পরিজনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের আবহে নগর জীবনের ব্যস্ততা দুঃখ-কষ্ট ফিকে হয়ে যায়। অল্প কয়েকদিনের জন্য প্রাণের মানুষগুলোই হয়ে ওঠে সুখ-দুঃখের আশ্রয়, হয়ে ওঠে পরম আপনজন। স্মৃতি রোমন্থনে করতে কেটে যায় নিমিষেই ছুটির সময়টুকু।

আব্বার সাথে ঈদগায় যাওয়ার পূর্বে সবাইকে নিয়ে পারিবারিক গোরস্থানে দাদা দাদিসহ পূর্বসূরীদের কবর জিয়ারত ছিল প্রধান কাজ। নামাজের পর মুরুব্বি বন্ধু-সহপাঠীদের সাথে কোলাকুলি, মোলাকাত কি যে প্রশান্তি দিত মনে। গ্রামের সবাই মিলে  স্কুল মাঠে কোরবানির পশু জবাই আর সেই কোরবানির পশুর গোস্তের একটা অংশ মহল্লার ঘরে ঘরে এবং স্বজনদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছানোর মজাটা ছিল দারুন। সন্ধায় মামার বাড়ি কিংবা খালার বাড়িতে হাত চুবিয়ে কচকচা ঝাল মাংসের স্বাদ সেটাতো অমৃত। এ বাড়ি ও বাড়ি দাওয়াত খাওয়া, দলবেঁধে বন্ধুদের সাথে পাড়ায় ঘুরে বেড়ানো এসবের মাঝে কী যে এক অনাবিল আনন্দের সুখানুভুতি সেটা কোনোভাবেই ভুলে যাবার মত নয়। অনেক কিছুই পাল্টে গেলেও গ্রামের এমন ঈদ আনন্দের রেশ আজও এখনও অনেকাংশেই বিদ্যমান।

তখনকার দিনে অনেক সময় হেঁটেই হাটে যেতাম। নরুন্দি নান্দিনা চেচুয়া বাজারে বসত আমাদের অঞ্চলের বড় বড় পশুর হাট। বড়দের সাথে কোরবানির গরু কিনতে যাওয়া আর গরু নিয়ে বাড়ি ফেরা, পথে পথে হাজার লোকের প্রশ্নের উত্তরে দাম বলা- সে কি যে এক আনন্দের অনুভূতি তা ভাষায় ব্যক্ত করার মতো নয়।

আমার জন্মস্থান রাজধানী থেকে ১৮০ কিলোমিটার উত্তরে ঢাকা-ময়মনসিংহ হয়ে  মুক্তাগাছার পর জামালপুর আঞ্চলিক সড়কের পাশঘেষা সদর  উপজেলার বন্ধরৌহা গ্রামে। ঈদের দুদিন আগে ১১ ঘন্টা ভ্রমণের রাস্তার ভীষন ঝক্কি-ঝামেলা পেরিয়ে উপজেলা সদরের ভারুয়াখালী বাজারে পৌঁছতেই হৃদয়ের গহীনে লুকিয়ে থাকা অতীত আমাকে তাড়িয়ে বেড়াতে থাকে, দু-চোখে ভেসে উঠতে থাকে অতীতের খণ্ড খণ্ড পুরোনো অনেক স্মৃতিই।

গ্রামের কথা মনে হলেই অতীত সুখ-স্বপ্নে বিভোর হয়ে নিজের অজান্তেই কেমন জানি আনমনা হয়ে হারিয়ে যাই সেই ফেলে আসা শৈশব কৈশোরের দিনগুলোতে। তাই তো– প্রতি বছর ঈদে মা মাটি আর মানুষের টানে সেই চিরচেনা আপন গ্রামীণ পরিবেশেই বারবার ছুটে আসি, ঘুড়ে বেড়াই গ্রামের এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। মিশে যাই আমার প্রিয় গ্রামের আলো-বাতাসে।

পরিবারের সাথে ঈদের খুশি ভাগাভাগি করে আমাদের ভ্রাতৃত্ববোধ এবং বন্ধন আরো সুদৃঢ় হোক, তাতেই প্রকৃত আনন্দ। সবার জীবনে এই ঈদ বয়ে আনুক সুখ-সমৃদ্ধি ও খুশি।

সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।

ঈদ মোবারক।

লেখক: বিশেষ পুলিশ সুপার, সিআইডি।