আবদুল হাই ছিলেন প্রসন্নচিত্তের মানুষ

প্রকাশ | ১৭ জুলাই ২০২২, ১৬:৩৯ | আপডেট: ১৭ জুলাই ২০২২, ১৮:২৫

রফিকুল ইসলাম

'বেঁচেও মরে যদি মানুষ দোষে,/ মরেও বাঁচে যদি মানুষ ঘোষে' - এ কথাটি খাটে বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক মো. আবদুল হাইয়ের ক্ষেত্রে। তিনি ছিলেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের প্রাণপ্রিয় অনুজ। তাঁর সহকারী একান্ত সচিব শুধু নয়, ছিলেন বিশ্বস্ত সহচর ও ছায়াসাথী।


কোভিড-১৯ করোনাভাইরাস সংক্রমণের উপসর্গকে ওসিলা করে ২০২০ সালে আজকের এই দিনে (১৭ জুলাই) সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) দুই সপ্তাহব্যাপী চিকিৎসাধীন থেকে অমর্ত্যলোকে পাড়ি জমান তিনি। আজ তার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী।


হাওরবন্ধু আবদুল হাই ২০১৩ সালে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ে গণসংযোগ শাখার উপ-পরিচালক থাকাকালীন অবসরে গেলে ওই বছরই রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) হিসেবে নিযুক্ত হন। এর আগে ১৯৯৮ সালে জাতীয় সংসদের তৎকালীন ডেপুটি স্পিকার এবং পরবর্তীতে স্পিকার মো. আবদুল হামিদের এপিএস ছিলেন।


ঋদ্ধিমান এই কর্মবীর রাষ্ট্রের অর্পিত দায়িত্ব পালন ছাড়াও ছিলেন আলোকিত দেশ গড়ার বাতিঘর এবং আদর্শিক রাজনীতিক ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তেজস্বী এই অন্তপ্রাণ দেশ মাকে ভালোবেসে যুদ্ধে লড়েছেন একাত্তরে। যুদ্ধশেষে মায়ের কোলে ফিরে এসেছিলেন বীরদর্পে। সিনা টান করে সেদিন দেশ-মায়ের লাল সবুজের পতাকা মায়ের হাতে সঁপে ছিলেন বিজয়ের হাসিতে।


তিনি দেশ মাতৃকার প্রশ্নে কখনো কারও সাথে আপস করেননি। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে ছিলেন অবিচল। মানবতায় বিশেষ করে হাওরের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য যা ন্যায্য, তা অকপটে বলতেন এবং ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করতেন দৃঢ়চিত্তে। ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়া নয়, দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে কাজ করে গেছেন নিঃস্বার্থভাবে। তার সতত আদর্শিক অবস্থানটা ধরে রেখেছিলেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। 


তার একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং জাতি গঠনে তাঁর আত্মত্যাগ ও অবদানের কথা স্মরণ করে গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রী রাম নাথ কোভিন্দসহ রাষ্ট্রের শীর্ষ পদস্থ অনেকেই। তাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল মাতৃকোল পারিবারিক কবরস্থানে।


রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার থাকাকালীনই চির অবহেলিত হাওরকে দেশের উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করতে নিরলসভাবে কাজ করার দীর্ঘ আড়াই দশক ধরে পথ চলার অনুঘটক ছিলেন সহোদর আবদুল হাই।


তিনি বিশেষ করে ২০১৩ সালে মো. আবদুল হামিদ দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে মহামান্যের জ্যেষ্ঠ পুত্র কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম) আসনের টানা তিনবারের নির্বাচিত সাংসদ প্রকৌশলী রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিকের সমন্বয়ে সংসদীয় এলাকার জনসাধারণের সাথে সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে সেতুবন্ধের সারথিও ছিলেন।


আবদুল হাই ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন শেষে রাজধানীতে লোভনীয় চাকরির সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আলোকিত হাওর গড়তে ছুটে চলেন গ্রামে। সংসদীয় এলাকায় প্রতিষ্ঠিত শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদেরই প্রতিষ্ঠিত প্রথমে হাজী তায়েব উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে অবৈতনিক এবং পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হক সরকারি কলেজে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন।


শিক্ষক হিসেবেও তিনি ছিলেন আদর্শবান। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে তিনি মনে করতেন, কেবল প্রতিভার দ্বারা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভ করা যায় না। দাঁড়াতে হয় জনগণের কাতারে। তাঁদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হতে হয়। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে অভ্যস্ত হতে হয়। সর্বোপরি দেশ এবং দেশবাসীর স্বার্থকেই সবার ওপরে স্থান দিতে হয়।


তিনি বলতেন, রাজনৈতিক দলের উপাদান তিনটি- নেতা, অনুগামী ও পরিস্থিতি। একটি আরেকটির পরিপূরক। কোনো রাজনৈতিক দলের 'নেতা' অন্যতম উপাদান হলেও একমাত্র নয়। নেতা ছাড়া দল চলে না বলা হলেও 'অনুগামী' ছাড়া দল অন্ধ। নেতা হয় ক'জনা, আমজনতাই হতে পারে দলীয় অনুগামী। এক্ষেত্রে নেতা কাণ্ড  হলে অনুগামী সেখানে দলের শিকড়।


আবদুল হাই দেশকে কত ভালোবাসতেন, দেশের মানুষের জন্য, দেশের মুক্তির জন্য, তার ব্যাকুলতা কত গভীর ছিল উপরিউক্ত বক্তব্যেই তা স্পষ্ট। অভিব্যক্তিতেই শুধু নয়, কর্তব্যপরায়ণে ছিলেন প্রসন্নচিত্ত। কারও সালাম পাবার অভিলাষে না দেখার ভান ধরতেন না। আগুয়ান হয়ে নিজেই নাম ধরে ভরাটকণ্ঠে ডাক জুড়ে দিতেন। আদ্যোপান্তের খোঁজখবর নিতেন।


সম্বোধনে ও মর্যাদায় কারোর বেলাতেই ভিন্নতা ছিল না। 'বড় ভালো লোকটি'র সাথে সবিশেষ দেখা হয়েছিল করোনা-পূর্ব বঙ্গভবনে। আত্মমর্যাদা বোধে নাম ভাঙানো ও ক্ষমতার ধারে কাছে ঘেঁষার আমার বাতিক না থাকায় অনুশাসনে সেদিন বলেছিলেন, 'অনেকেই ত রঙ বদলাইয়া দুই লাইন লেইখ্যা মুই কি হনুরে সাজে বঙ্গভবনে এসে! আর তুমি কি না রাজ্যের লেহা লেইখ্যা নিষ্ঠ-ঘনিষ্ঠজন অইয়াও এলিয়েনের লাহান হঠাৎ দেহা দেও।’


আসলে এটা তার গুণেরই দিক। পারিবারিক মর্যাদা ও প্রভাব-প্রতিপত্তিসহ সংসদ ভবন এবং বঙ্গভবনের মতো শীর্ষস্থানের বাসিন্দা হয়েও প্রচারবিমুখ নিভৃতচারী পরোপকারী ছিলেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতির এপিএস শুধু নয়, সর্বোপরি রাষ্ট্রপতির সহোদর হয়েও ছিল না ক্ষমতার কোনো দম্ভ। অহংবোধের লেশমাত্র ছিল না মনে।


ক্লিন ইমেজ আর অকৃত্রিম দরদই ছিল আবদুল হাইয়ের ভূষণ। কোনো প্রাপ্তি ছাড়াই সরল মনে পরের তরে জীবন ধরে দেওয়ায় হাওরবাসীর হৃদয়ে বসেছিলেন স্বপ্নের বরপুত্র হয়ে। হাওরবাসীও শতজনমের চেনা মহৎপ্রাণ বন্ধুপ্রতিম প্রিয় অভিভাবকের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিরও ছিল না কোনো ঘাটতি। মূল্যায়িতও হচ্ছেন মনের মাধুরীতে। স্মরণার্হে বলা হচ্ছে- 'হাই সা'ব আছিন সাদাসিধা-দিলদরিয়া মানুষ। ঠেকলে সহায়তা পেতে নির্ভয়ে মন খুইল্যা দুইডা কতা কওন গ্যাছে। লোকটা আর যা-ই হোক, পেডের ভিত্তে দাঁত (কুবুদ্ধিপ্রসূত) আছিন না।'


আবদুল হাই দেশের বিখ্যাত এক রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তার জন্ম ১৯৫৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন উপজেলার কামালপুর গ্রামে। পিতা হাজী তায়েব উদ্দিন এবং মাতা তমিজা খাতুন। ৫ ভাই ও ৪ বোনের মধ্যে তিনি অষ্টম এবং ভাইদের মধ্যে চতুর্থ।


তার অন্তর্ধানে বর্তমানে ভাই-বোনের মধ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং মিঠামইন উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অধ্যক্ষ মো. আবদুল হক নূরু ও মিঠামইন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যন আছিয়া আলম ছাড়া অন্যরা কেউ বেঁচে নেই।


বর্তমানে স্ত্রী, এক পুত্র ও দুই কন্যার মধ্যে স্ত্রী নাহিদ পারভিন তার স্বামীর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। অর্থাৎ মহামান্য রাষ্ট্রতির সহকারী একান্ত সচিব পদে নিযুক্ত রয়েছেন। পুত্র প্রকৌশলী শাইখ মোহাম্মদ ফারাবী প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। জ্যেষ্ঠ কন্যা সুমাইয়া ফাজরিন মাশিয়াত পেশায় একজন চিকিৎসক এবং কনিষ্ঠ কন্যা মিম শাহরিন অনসূয়া কানাডার মনট্রিয়াল কনকর্ডিয়া ইউনিভার্সিটিতে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত।


আব্দুল হাই মিঠামইন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার, আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি, বিআরডিবির চেয়ারম্যান, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংগঠন 'প্রবাহের' সভাপতিসহ কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় অসংখ্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। জনসেবা ও আধুনিক হাওর রূপায়নে তথা এলাকার উন্নয়নেও তার অবদান অনস্বীকার্য।


আবদুল হাইয়ের মৃত্যতে হাওরবাসী হারাল মাটির প্রদীপ 'আমরার লোকটিকে'। পরলোকে থেকো পরম শান্তিতে।


লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট। সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়, ঢাকা।