ভ্রমণ কাহিনীতে নতুন সংযোজন ‘সার্বিয়া শুভ্র শহরের দেশে’

ড. মেহাম্মদ মাহবুব আলী
 | প্রকাশিত : ২৬ জুলাই ২০২২, ১৭:৩৯

ভ্রমণ কাহিনী নিয়ে যে গ্রন্থগুলো আছে, তার মধ্যে ইমদাদ হকের ‘সার্বিয়া শুভ্র শহরের দেশে’ একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। ছেলেবেলায় মুহাম্মদ আব্দুল হাই-এর ‘বিলেতে সাড়ে সাতাশ দিন’ গ্রন্থটি মনের গহিনে দাগ কেটেছিল। আমার প্রয়াত পিতা মোবাশ্বের আলী সাহেব বইটি দিয়ে ক্লাস সিক্সে পড়াকালীন সময়ে বলেছিলেন, ‘বিলেতে মানুষের কর্তব্যনিষ্ঠার পরিচয় পাবে।’

ইমদাদ হকের বইটি পড়তে পড়তে হাই-এর বইটির মতই অনেক বস্তুনিষ্ঠতার পরিচয় পাওয়া যায়। বইটিতে মোট ৩৫টি পরিচ্ছেদ রয়েছে।

সার্বিয়া হচ্ছে প্রাক্তন যুগোশ্লোভিয়ার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। সার্বিয়া ভূমিবেষ্টিত দক্ষিণ পূর্ব ইউরোপের অংশ। প্যারিস এয়ারপোর্টের কোভিড কেন্দ্রিক যাত্রী স্বল্পতার বর্ণনা রয়েছে। লেখক প্যারিস শার্ল দ্য গোল এয়ারপোর্ট দিয়ে আট কোটি লোকের যাতায়াতের কথা বলতে ভোলেননি।

সার্বিয়ানরা কী খায়, সেই অচেনা খাবারের ম্যানুর পাশাপাশি জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে আলোকপাত করেছেন। ‘জোভাংকা ব্রোজ ইন কালার’-এ যুগোশ্লোভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোর ফার্স্ট লেডির কথা বিবৃত করেছেন।

মনে পড়ে যায়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মার্শাল টিটোর অনুরোধে ছয় দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে যান। তাকে মার্শাল টিটো বীরোচিত সংবর্ধনা যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে দিয়েছিলেন।

মার্শাল টিটো সেই সময়কালে আলজেরিস্থ জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন সম্পর্কে বলেছিলেন যে, এতে অংশগ্রহণ করা বাংলাদেশের নৈতিক অধিকার বলে আমরা সমর্থন করছি।’ ‘বেলগ্রেডের সীমা পরিসীমা’ প্রবন্ধে লেখা ক্রিভোর কথা বলেছেন। তিনি মিলানা নামের মেয়ে সম্পর্কে লিখতে গিয়ে লিখেছেন, ‘ভ্রমণ নারীর ইশারায় আটলান্টিকে সাঁতরানো যায়’। অত্যন্ত কাব্যিক ভাষা।

আবার ‘হুররামের প্রদর্শনী কেন্দ্র’ প্রবন্ধে লেখক ক্রিভোর রূপ সৌন্দর্য আশ্চর্য মনোমুগ্ধতার সাথে বর্ণনা করেছেন। ‘সবুজ পার্কে রোমান্টিকতা’ প্রবন্ধে নানাবিধ বৃক্ষরাজি শোভিত কালেমেগদান পার্ক, যাতে সার্বিয়ার পর্যটকদের বড় আকর্ষনের ছবি রয়েছে।

‘শুভ্র শহরের ধূসর প্রান্ত’ শিরোনামের প্রবন্ধে লেখক মন্তব্য করেছেন যে, বৃষ্টিভেজা আবহাওয়ার দাবিই যেন রোমান্টিসিজমের ধোঁয়া ওঠা কফি। একটি সমার্থক পরিবেশ জীবনের সৌন্দর্যবোধ জাগ্রত হয়। দালিউব ও সাভা নদীর রহস্য প্রবন্ধখানি বেশ জ্ঞানগর্ভ।

সত্যি কথা বলতে কী, ঘুনেধরা সমাজ ব্যবস্থার মধ্যেও লেখকের বক্তব্যেই উচ্চারিত হয়, পৃথিবী সুন্দর, সুন্দর এর প্রকৃতি। স্বর্ণমণ্ডিত সেই সভায় সৌন্দর্যের ঝলকানি। সুন্দরকে বিমূর্ত করে তুলেছে।

স্টোজানিভের সাথে তার সাক্ষাতের বিবরণ সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ভিসামুক্ত সমগ্র বিশ্বে যেভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়, তার বর্ণনা বির্ধত হয়েছে। চমৎকারভাবে লেখক যুক্তিগ্রাহ্য করে সেন্সরবোর্ডহীন সিনেমা ব্যবস্থা আর সেন্সরবোর্ডসহ সিনেমা ব্যবস্থার কথা তুলেছেন। আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পীদের আচার আচরণ, বর্তমান রাজা বাদশাহ রাণীদের মতো। সাধারণ মানুষকে তারা ধর্তব্যের মধ্যে আনে না।

অথচ আমরা যারা বড় হয়েছি ফেরদৌসী মজুমদার, সুবর্ণা মুস্তাফা, রাইসুল ইসলাম আসাদ, তারিক আনাম, রাজ্জাক, শাবানা, কবরীদের দেখে, বর্তমান প্রজন্ম সম্পূর্ণ ভিন্ন। এরা সাধারণ মানুষের ওপর চড়াও হয়। খ্যাতির কারণে বিশ্রী প্রভাব অধিকাংশই ঘটায়।

বেলগ্রেড জাতীয় জাদুঘর জীবন্ত ইতিহাসের পাঠ। অত্যন্ত সুন্দর একটি প্রবন্ধ, যা একটি দেশের কৃষ্টি, ইতিহাস, ঐতিহ্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়। সার্বিয়া শিক্ষা ব্যবস্থার বর্ণনা রয়েছে। আমরাও বর্তমান সরকারের আমলে শিক্ষার কল্যাণ করতে চাচ্ছি। তবে শিক্ষকের মর্যাদা রাখতে হলে শিক্ষককেই কাজ করতে হবে। অযাচিত কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়া যাবে না।

‘ভালোবাসার হরমোন, ভালোলাগার রসায়ন’ শিরোনামের প্রবন্ধে সুন্দর করে যাদুঘর, পণ্যের পসরা সম্পর্কে বলেছেন। মানুষের জীবন স্রষ্টার দান, এটিকে স্বার্থক করাই আমাদের কাজ।

সাংস্কৃতিক বৈচিত্রে লেখক তার দেখার আকাঙ্ক্ষার সাথে সময়ের মিল রাখতে না পারা সম্পর্কে বলেছেন। ‘টাইম মেশিনের সময়ের বাঁকে’ প্রবন্ধে লেখক টাইম ফ্রেইমে দেশে ফেরার ঘটনা প্রবাহ বর্ণনা করেছেন। ক্রিভোর নামের তরুণী হয়তো আর দেখা হবে না, কিন্তু স্মৃতির অর্গলে বেঁধে রাখবেন মানুষের স্বমহিমায়। আসলে অন্তর্লীন সত্তায় হৃদয়ের গভীরে অনেক কিছুই থাকে। কখনো বড় হয়ে ধরা দেয়, আবার কখনো বা নস্টালজিয়া। হয়ত আজ থেকে ৩০ বছর পর স্মৃতি অর্গল খুলে গেলে ধরা দেবে।

ইমদাদ হককে প্রাঞ্জল ভাষায় গ্রন্থটি রচনা করার জন্যে ধন্যবাদ এবং অভিনন্দন। সুখ্পাঠ্য গ্রন্থটি সবার ভালো লাগবে বলে আশা করি।

ইমদাদ হকের ‘সার্বিয়া শুভ্র শহরের দেশে’ প্রকাশ করেছে অন্যপ্রকাশ। প্রকাশকাল জুলাই, ২০২২। প্রচ্ছদ করেছেন মাসুম রহমান। ১৭৬ পৃষ্ঠার বইটির মুল্য ৬০০ টাকা।

লেখক: সামষ্টিক ও ফিন্যান্সিয়াল ইকোনোমিস্ট এবং ছড়াকার

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :