অন্ধকারের রূপকথা সেলিম খাননামা

প্রকাশ | ০১ আগস্ট ২০২২, ১৪:১১ | আপডেট: ০১ আগস্ট ২০২২, ১৪:২৫

আরিফুর রহমান দোলন

মুঠোফোন বন্ধ তাঁর। হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো বার্তাও দেখছেন না। তবে কি খানিকটা ভয় পেয়েছেন? এমন ভয় কি আগে কখনো পেয়েছেন! কী হলো চাঁদপুরের সেলিম খানের?

সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউপি চেয়ারম্যানের দেখা মিলছে না হঠাৎই। বালুখেকো হিসেবে যার কুকীর্তিতে বিব্রত খোদ চাঁদপুরবাসী।

পেশাগত দায়িত্ব হিসেবে রাজনীতি কাভার করেছি। জাতীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের অনেক নেতার সঙ্গে বিভিন্ন সময় আলাপ ছিল ও আছে। মহিউদ্দিন খান আলমগীর, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, ডা. দীপু মনি, সুজিত রায় নন্দীসহ কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ ছিল কখনো-সখনো। দু-একটি অনুষ্ঠানে জমিয়ে কথা বলার সুযোগও হয়েছে এঁদের কারো কারো সাথে। কিন্তু নিত্য দিনের আলোচনা কখনো হয়নি।

রাজনীতিক-সাংবাদিক যে পারস্পরিক তথ্য আদান-প্রদান হয়, চাঁদপুরের কোনো রাজনীতিকের সঙ্গে সেটি কখনো হয়ে ওঠেনি। উল্টো বাংলাদেশ প্রতিদিনে আমার এক মন্তব্য প্রতিবেদনে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খানিকটা ভ্রু কুঁচকেছিলেন বলে শুনেছি। আগে, পরে ওই জেলার প্রভাবশালী, ক্ষমতাধর কেউ কখনো আমার প্রতি যে প্রসন্ন ছিলেন এমনও নয়।

অতীতে এসব নিয়ে ভাবিনি। প্রয়োজনও হয়নি।

কাউকে পুরোপুরি বুঝতে হলে না-কি তাঁর মধ্যে কিছুটা ক্ষমতা পুরে দিতে হয়। তা হলেই না-কি বোঝা যায় মানুষটা আগের মতো থাকে কি না। কর্তৃত্বের আঁচ, চাকচিক্য কতখানি তাকে বদলে ফেলে সেটি বুঝতে ক্ষমতাই কি মোক্ষম দাওয়াই?

চাঁদপুরের একজন ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানকে এত ক্ষমতা কে দিল?

মনের মধ্যে এ প্রশ্ন অনেকদিন ধরেই ছিল। বছর কয়েক আগে তার নামটি শুনি। ঘনিষ্ঠ এক পেশাজীবীর বাড়ির ড্রইংরুমে। ছোটখাটো আড্ডায় আলপটকা একজন শ্লেষের সুরেই ছুঁড়ে দেন নামটা। নদী থেকে ইচ্ছে মতো বালু ওঠান। আর সিনেমা বানান। চাঁদপুরের ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানকে দেখেন। ঠিক যেন রূপকথার গল্প।

রূপকথা! না-কি অন্ধকারের রূপকথা?

চুপচাপ থেকেছি তখন। আলোচনায় অংশ নেইনি। তবে নামটি বড্ড বেজেছে কানে। সেলিম খান। চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন।

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানেও বারবার উঠে এসেছে ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানের নাম। কখনো বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের অন্যতম সহযোগী হিসেবে। কখনো স্বতন্ত্র অভিযুক্ত। রাজধানীর কাকরাইলের সিনেমা প্রযোজক পাড়ায় ডাকাবুকো সেলিম খানকে তখনো সমীহ-ই করা হয়েছে।

কাদের প্রশ্রয়ে এতদূর এসেছেন এককালের দীনহীন সেলিম খান? এই প্রশ্ন এখন অবান্তর।

দুর্নীতি দমন কমিশন বলছে, অনুসন্ধানে তারা সেলিম খানের ৩৭ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ পেয়েছে। এটি হয়তো আরও আরও বেশি হবে অদূর ভবিষ্যতে। কেন? শুনেছি প্রায় শতাধিক বাংলা সিনেমার সেন্সর সার্টিফিকেট নিয়েছে সেলিম খানের মালিকানাধীন প্রযোজনা সংস্থা। যার একটিও বিস্ময়করভাবে না-কি মুক্তি পায়নি। ভাবা যায়! এক একটি ছবির পেছনে যদি এক কোটি টাকা বিনিয়োগও হয়ে থাকে তাহলে তো এখানেই লুকিয়ে আছে শতকোটি টাকা। এসবের বাইরে কত কী আছে! দুদক নিশ্চয়ই মামলা পরবর্তী তদন্তে সব বের করবে।    

সেলিম খান দিনমজুর ছিলেন না-কি হকার, সেই প্রশ্ন তুলে কি কোনো লাভ আছে? তার নিকট অতীত নিয়ে যারা ঘাঁটাঘাঁটি করবেন তাদের সার্টিফিকেটেই তো তিনি নেতা বনতে পেরেছিলেন। শাসক দলের মনোনয়ন দু’ দুবার বাগিয়ে নেওয়া কি চাট্টিখানি কথা? চাঁদপুরের এই ইউপি চেয়ারম্যানকে মনোনয়ন পেতে সহযোগিতা করেছিলেন কারা? আওয়ামী লীগের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করতে সেলিম খানকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে ‘বালুখেকো’, ‘নদীখেকো’ বানানো কি খুব জরুরি ছিল? স্থানীয় আওয়ামী লীগে এসব প্রশ্ন যারাই তুলুন না কেন শেষ বিচারে তা অনেক দেরিই হয়ে গেছে। যদিও মন্দের ভালো হলো, জেলা আওয়ামী লীগ আজীবন বহিষ্কার করেছে সেলিম খানকে।

চাঁদপুরে সরকারিভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মহতী উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছে জেলা ও পার্শ্ববর্তী সবাই। কিন্তু এই সাধুবাদই আবার হোঁচট খেয়েছে যখন গণমাধ্যমের কল্যাণে জনগণ জেনে গিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি অধিগ্রহণের নামে সাড়ে তিনশ কোটি টাকার বেশি লোপাট করতে সব রকম আয়োজনই সম্পন্ন করে রেখেছিলেন। সেলিম খানদের অসাধু আয়োজন সুসম্পন্ন হয়নি জেলা প্রশাসকের সততা, দৃঢ়চেতা মনোভাবের কারণে। সাধুবাদ অঞ্জনা খান মজলিসকে। মাথা নত না করার জন্য। তাঁর আমলে সুশাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ না করতে দেওয়ার জন্য।

রাজধানীর অনেক প্রভাবশালী আর ক্ষমতাধরদের অন্দরমহলে না-কি অবাধে যাতায়াত ইউপি চেয়ারম্যান ও বালুখেকো খ্যাত সেলিম খানের। গণমাধ্যমের অনেকের সাথেও। তবে কাছ থেকে কখনো দেখার সুযোগ হয়নি। শুনেছি বেশ আড্ডাপ্রিয় এক বৈঠকি মানুষ। বিশাল হৃদয়েরও না-কি। রসবোধ না-কি চমৎকার। লম্বা গোঁফের আড়ালে মুচকি হাসিতে না-কি লাগে বেশ। ঘনিষ্ঠজনদের কাছে নিজের ফেলে আসা জীবনের কথা অকপটে বলেন শুনেছি। তিলে তিলে পরিশ্রম করেই না-কি এতদূর এসেছেন।

আর এখন রাজনীতি আর সিনেমাই না-কি তাঁর ধ্যানজ্ঞান! সবকিছু ফেলে যেখানে সেলিম খান থিতু হতে চান সেখানে তিনি নায়ক না-কি ভিলেন? জানা যাবে অচিরেই।

সিনেমাপাড়ার একাংশের কাছে বালুখেকো খ্যাত সেলিম খান মিঠে স্বভাবের মানুষ। এই অংশ তাকে চেনে আন্তরিক, অতিথি বৎসল হিসেবে। ঢাকায় কিংবা গ্রামে মানুষকে খাওয়াতে গিয়ে না-কি কখনো বিরক্ত হন না। আমন্ত্রিতের সংখ্যাধিক্যকেও না। যদিও তার বালু সম্রাট হয়ে ওঠার কাহিনি ততদিনে সবারই জানা।

গত ১৫ বছরে চাঁদপুরে সেলিম খান নাকি যা চেয়েছেন তা-ই হয়েছে। ২০০৯ থেকে আশীর্বাদ পেয়েছেন এমন দু-একজনের যারা কখনো সামনে থেকে কখনো পেছন থেকে সরকারি কিংবা শাসক দলের অন্যতম চালিকাশক্তি। অন্তত এমনটাই প্রচারণা চাঁদপুর আর ঢাকায়।

নদীভাঙন প্রবণ চাঁদপুরে ইচ্ছে মতন নদী থেকে বছরের পর বছর বালু উত্তোলনের অনুমতি কাদের কাছ থেকে পেলেন  সেলিম খান? তার মতো অনভিজ্ঞ, আনাড়ি, কারিগরি জ্ঞানহীন একজনকে নদী খননের অনুমতি দেওয়া-ই বা কেন?

কাদের কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণে উচ্চ আদালতে প্রশ্নবিদ্ধ হন সেলিম খানদের বিতর্কিত সব কর্মকাণ্ড? যে প্রশ্নের আঁচ শাসক দলের গায়েও পর্যন্ত লাগে?

এক জীবনে দিনমজুরের জীবনযাপন করা সেলিম খানদের রাজত্ব ঘুরে আসলে চাক্ষুষ দর্শনার্থীদের না-কি অস্বস্তিই হবে। এসব অস্বস্তিই কি আগামীতে জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে নেতিবাচক ফ্যাক্টর হয়ে উঠবে। সেলিম খানদের জীবন রূপকথাই বটে। অন্ধকারের রূপকথা।

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ঢাকা টাইমস, ঢাকাটাইমস২৪.কম ও সাপ্তাহিক এই সময়