বহুমাত্রিক অনন্য প্রতিভার অধিকারী শেখ কামাল

প্রকাশ | ০৫ আগস্ট ২০২২, ১৮:০১

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ

সময়ের আবহে গড়ে উঠেছিলেন তিনি। সময়ের প্রয়োজন তাকে সেভাবেই বিধাতা তৈরি করছিলেন বলে বিভিন্ন ঘটনার পরম্পরায় ঐতিহাসিক সাক্ষ্য। তিনি কখনো মাঠে, কখনো ঘাটে, কখনো মিছিলের স্লোগানে, কখনো নাটকের মঞ্চে, কখনো প্রতিবাদের তপ্ত রৌদ্রের শিখায়, কখনো শিল্প-সাহিত্যের পাতায়, কখনো অধিকার আদায়ে, মুক্তির সংগ্রামে অগ্রনায়ক হিসেবে অস্ত্র হাতে, কখনো তরুণ প্রজন্মের মেধার রক্ষায় দক্ষ সংগঠকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। 

এসব গুণাবলির অধিকারী ছিলেন জাতির পিতা স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ শেখ কামাল। প্রকৃতি ও বাস্তবতার নিষ্ঠুর নিয়মে বঙ্গবন্ধুর এ বীরপুত্র গড়ে উঠেছিলেন। পারিবারিক আবহে রক্তের শিরায় শিরায় বঙ্গবন্ধুর ঔরসজাত হিসেবে শেখ কামাল যে অল্প কদিন বেঁচেছিলেন, সে কদিন তিনি বিশ্ববাসীকে জানান দিয়েছিলেন- ‘আমি বঙ্গবন্ধুর যোগ্য সন্তান’। এই ক্ষণজন্মা শেখ কামাল ১৯৪৯ সালে ৫ আগস্ট তৎকালীন গোপালগঞ্জ জেলায় টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন।

শৈশব থেকে বাবার আদর ও স্নেহের স্পর্শ বড় ছেলে শহীদ শেখ কামাল তেমন পাননি। বাঙালি জাতির মুক্তির আন্দোলন করতে গিয়ে তখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কেটেছে কারাগারে রাজবন্দি হিসেবে। শেখ কামালের জন্মের সময়ও তিনি কারাগারেই ছিলেন। এমন কঠিন সময় পার করে বড় হয়ে উঠছিলেন শেখ কামাল।

শেখ কামালের শিক্ষা শুরু হয়েছিল রাজধানীর শাহীন স্কুলে। এখান থেকে তিনি মাধ্যমিক ও ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর তার সাংগঠনিক শক্তি ও ক্রীড়াপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ বিপুল আকারে প্রকাশ হতে থাকে। স্নাতক সম্মান ডিগ্রি গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শাহাদাতবরণের সময় শেখ কামাল সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এমএ শেষ পর্বের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন।

নিরহংকারী, বন্ধুবৎসল, সদালাপী শেখ কামাল। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে আজও তাঁর স্পর্শ লেগে আছে। তাঁর শূন্যতা হু হু হাওয়ার মতন আজও আমাদের মন ছুঁয়ে যায়।

শেখ কামালকে বাংলাদেশের ক্রীড়া উন্নয়নের অগ্রদূত বললে এক বিন্দুও বাড়িয়ে বলা হবে না। খেলাধুলার প্রতি পারিবারিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার পেয়েছিলেন শহীদ শেখ কামাল। তাঁর দাদা শেখ লুৎফর রহমান এবং বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও ছিলেন ক্রীড়ানুরাগী। দারুণ ফুটবলার ছিলেন তাঁরা। শেখ কামালেরও খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ ছিল শৈশব থেকেই। নিয়মিত ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, বাস্কেটবলসহ বিভিন্ন খেলায় অংশ নিতেন।

শাহীন স্কুলে পড়ার সময় স্কুল একাদশে নিয়মিত ক্রিকেট, ফুটবল, বাস্কেটবল খেলতেন। এর মধ্যে ক্রিকেটটা তাঁকে টানত সবচেয়ে বেশি। দীর্ঘদেহী ফার্স্ট বোলার ছিলেন। নিখুঁত লাইন-লেন্থ আর প্রচণ্ড-গতি দিয়ে খুব সহজেই টালমাটাল করে দিতেন প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানকে। অবিভক্ত পাকিস্তানের অন্যতম উদীয়মান পেসার ছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিবের পুত্র হওয়ার কারণে বঞ্চিত হয়েছেন নিদারুণভাবে। জাতীয় দলে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি। আজাদ বয়েজ ক্লাবের হয়ে শেখ কামাল প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলেছেন দীর্ঘদিন।
শহীদ শেখ কামাল বাস্কেটবলেও ছিলেন দারুণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ত-হল ফুটবল দলের নিয়মিত খেলোয়াড় ছিলেন। ফুটবল খেলোয়াড় কল্যাণ সমিতির সভাপতি ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্কেটবল দলের ক্যাপ্টেন ছিলেন। তাঁর দল ছিল অপরাজেয়।
শেখ কামাল ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে অমর হয়ে থাকবেন উপমহাদেশের অন্যতম সেরা ক্রীড়া সংগঠন, বাংলাদেশে আধুনিক ফুটবলের প্রবর্তক আবাহনী ক্রীড়াচক্রের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। তবে মুক্তিযুদ্ধের আগেই তিনি সংগঠক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি প্রথম ধানমন্ডি ক্লাবের যুগ্ম স¤পাদক নির্বাচিত হন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ কামাল বন্ধুদের নিয়ে ধানমন্ডির সাতমসজিদ এলাকায় গড়ে তোলেন আবাহনী  ক্রীড়াচক্র। আবাহনী ক্রীড়াচক্র আজ দেশ-বিদেশে পরিচিত একটি ক্লাবই নয়, দেশের ক্রীড়াঙ্গনের আধুনিকায়নের পথিকৃৎ প্রতিষ্ঠান হিসেবেও খ্যাতিমান। ক্লাব ভবন থেকে শুরু করে সবকিছুতেই শেখ কামাল আধুনিকতার নিদর্শন নিয়ে এসেছিলেন। বিশেষ করে ফুটবল খেলায় তিনি শুধু বাংলাদেশ কেন, উপমহাদেশেই পশ্চিমা রীতির বিপ্লব এনেছিলেন।

বাংলাদেশের কিংবদন্তি ফুটবলার শেখ কামালের বন্ধু বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন এবং সাফ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের দৃঢ় বিশ্বাস, আজ শেখ কামাল বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ফুটবলে খেলত। এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী দেশে পরিণত হতো বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এখন সবাই সমীহ করে। বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশ ক্রিকেটে নতুন পরাশক্তি। ওয়ানডেতে এখন সত্যিই সমীহ করার মতো খেলছে টাইগার বাহিনী। যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে ক্রিকেট বোর্ড গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন শেখ কামাল। অনেকে বলেছিলেন ক্রিকেট রাজকীয় খেলা, এ খেলায় অনেক ব্যয়। এ দেশের ছেলেরা এত টাকা ব্যয় করে ক্রিকেটসামগ্রী কিনতেও পারবে না, এ খেলার প্রসারও ঘটবে না। 

বহুমাত্রিক অনন্য সৃষ্টিশীল প্রতিভার অধিকারী তারুণ্যের প্রতীক শহীদ শেখ কামাল সেদিন সমালোচকদের কথায় কান দেননি। ফুটবলের মতো ক্রিকেট প্রসারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন বলেই বাংলাদেশ আজ ক্রিকেট বিশ্বে ধীরে ধীরে পরাশক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে।

হকিতেও নতুন দিনের সূচনা করেছিলেন শেখ কামাল। যোগ্যতা, দক্ষতা আর দেশপ্রেমের অসামান্য স্ফুরণে এই মানুষটা বদলে দিচ্ছিলেন সদ্য স্বাধীন একটা দেশের পুরো ক্রীড়াক্ষেত্র।
খুনিরা বুলেট দিয়ে শেখ কামালকে হত্যা করলেও হত্যা করতে পারেনি তাঁর স্বপ্নের ক্রীড়াঙ্গনকে। আর তাই এখনো ক্রীড়াঙ্গনে তাঁর কথা চলে আসে অনিবার্যভাবে। ক্রীড়াঙ্গনের স্বাপ্নিক এই মানুষটির কথা কেউ ভুলতে পারেন না। তিনিই ক্রীড়াক্ষেত্রে আধুনিকতার স্বপ্ন দেখিয়েছেন সবার আগে। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে তাঁর অভাব পূরণ হবার নয়।

সংস্কৃতিক্ষেত্রেও গভীর অনুরাগ ছিল শেখ কামালের। যুক্ত ছিলেন সাংস্কৃতিক আন্দোলনে। আইয়ুব খান এ দেশে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করলে সংস্কৃতিকর্মীরা তুমুল প্রতিবাদ জানান। শেখ কামালও ছিলেন প্রতিবাদী শিল্পীদের পুরোভাগে। খুব ভালো সেতার বাজাতেন। দেশের ঐতিহ্যবাহী সংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছায়ানটের যন্ত্রসংগীত বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। এখান থেকেই তিনি সেতারবাদনে তালিম নিয়েছেন। ধ্রুপদি সংগীতের পাশাপাশি আধুনিক সংগীতেরও অনুরাগী ছিলেন শেখ কামাল। গান করতেন, গলাও ছিল চমৎকার। বন্ধু শিল্পীদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন সংগীত সংগঠন ‘¯পন্দন শিল্পীগোষ্ঠী'।
মঞ্চনাটকেও স্বতঃস্ফূর্ত ছিলেন শেখ কামাল। স্বাধীনতার পরে দেশে গ্রুপ থিয়েটার চর্চার ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটে। বাংলাদেশের পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন কর্মসূচির পাশাপাশি সমাজের পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর ভাগ্য উন্নয়নে সমাজচেতনায় উদ্বুদ্ধ নাট্যকর্মীরা এগিয়ে আসেন। শেখ কামাল যুক্ত ছিলেন তাতে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের নবনাট্য আন্দোলনে তিনি ছিলেন প্রথম সারির সংগঠক। এখনকার বিখ্যাত নাট্যদল ঢাকা থিয়েটার-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শেখ কামাল। নিয়মিত অভিনয়ও করেন মঞ্চে। অভিনেতা হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যাঙ্গনে যুক্ত ছিলেন। কলকাতাতেও নাটকের দল নিয়ে গেছেন, সেখানে প্রশংসিত হয়েছেন অভিনয় করে।

শেখ কামাল বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একজন নিবেদিত, সংগ্রামী, আদর্শবাদী কর্মী হিসেবে '৬৯-এর গণ অভ্যুত্থানে যোগ দিয়েছেন। অংশ নিয়েছেন ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে পাকিসন্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত ৩২ নম্বর বাসভবন আক্রান্ত হওয়ার পূর্বমুহূর্তে বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়ে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।

তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ওয়ার কোর্সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে মুক্তিবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর সাহসী যোদ্ধা লে. শেখ কামাল ক্যাপ্টেন হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে লেখাপড়া, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে মনোনিবেশ করেন।

তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ছিলেন। শাহাদাতবরণের সময় ছিলেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়নের সময় প্রেমে পড়েন একই বিভাগের ছাত্রী ও ক্রীড়াবিদ সুলতানার। সুলতানাকে সবাই পূর্ব পাকিস্তানের গোল্ডেন গার্ল বলতেন। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুলাই দেশবরেণ্য অ্যাথলেট সুলতানা খুকুর সঙ্গে শেখ কামালের বিয়ে হয়।

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই যখন শহীদ হন, মেহেদির দাগ তখনো মোছেনি হাত থেকে। ১৯৭৫-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে শহীদ শেখ কামালকে নিয়ে অনেক কুৎসা ছড়ানো হয়, কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় সেগুলো মিথ্যা। শেখ কামাল শহীদ হওয়ার পর অবৈধ সেনাশাসক জিয়া অনেক তদন্ত করেও শেখ কামালের নামে কোনো বাড়ি, ব্যাংক ব্যালান্স বা ইন্ডাস্ট্রি পায়নি। মিথ্যা দিয়ে সত্যকে আড়াল করা যায় না।

বিপুল প্রাণশক্তিতে ভরপুর এক তরুণ ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শহীদ শেখ কামাল। বীর মুক্তিযোদ্ধা, ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়াসংগঠক, ধ্রুপদি সংগীত ও নাট্যশিল্পী, সাংস্কৃতিক সংগঠক, ছাত্রনেতা- এমন অনেকভাবেই তাঁর পরিচয় দেওয়া যায়। তবে দুঃখজনক হলো শেখ কামালের এই প্রতিভার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেনি। বলা সংগত যে, সে জন্য যথেষ্ট সময় তাঁকে দেওয়া হয়নি। মাত্র ২৬ বছর বয়সে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। শহীদ শেখ কামালের প্রতিভা ও অবদানের মূল্যায়ন দূরে থাক, উপরন্তু নানা মিথ্যা প্রচারে তাঁকে হেয়প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চলেছে দীর্ঘ সময় ধরে। তবে আজ সব অসত্যের অন্ধকার থেকে সত্যের আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে এই স্বল্পায়ু মহৎহৃদয়, সুকুমার মনোবৃত্তির মানুষটির অবদানের কথা।

লেখক: উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।