ব্যয় সংকোচনে অভিন্ন নীতি

প্রকাশ | ০৫ আগস্ট ২০২২, ২৩:২১

ওমর ফারুক, ঢাকাটাইমস

চলমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক ব্যয় সাশ্রয়ে আটটি ব্যয় সংকোচন নীতি ঘোষণা করেছিল সরকার। সব সরকারি দপ্তরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ব্যবহার কমানো, অধিকাংশ সভা অনলাইনে আয়োজন, বিদেশ ভ্রমণ যথাসম্ভব পরিহার ও রাজস্ব ব্যয় কমানোর মতো নির্দেশনা ছিল তাতে।

ব্যয় সেংকোচন নীতি ঘোষণার পর বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ও বিভাগ তাদের নেওয়া পদক্ষেপের কথাও সংবাদমাধ্যমে ঘোষণা করেছে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নেও ব্যয় সংকোচন নীতি প্রয়োগ করা হচ্ছে। প্রকল্পগুলোর গুরুত্ব বিবেচনা করে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এখনই বাস্তবায়ন করা কিংবা না করার মতো সিদ্ধান্ত রয়েছে এতে।

সরকারের গৃহিত প্রকল্পগুলোকে যথাক্রমে এ, বি ও সি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় গুরুত্ব অনুযায়ী প্রকল্পগুলোকে ‘এ’, কোনগুলো ‘বি’ ও কোনগুলো ‘সি’ ক্যাটাগরিতে ফেলবে। ‘এ’ ক্যাটাগরির হলো যেগুলো ইমিডিয়েটলি প্রয়োজন। ‘এ’ ক্যাটাগরির প্রকল্পের পুরো টাকা খরচ করা হবে। ‘বি’ ক্যাটাগরির প্রকল্পগুলোতে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত খরচ করা যাবে। আর ‘সি’ ক্যাটাগরির প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন স্থগিত থাকবে।

এ নির্দেশনা অনুযায়ী ফলে দেশে চলা কম গুরুত্বপূর্ণ ৮১ টি প্রকল্পে ব্যয় স্থগিত করেছে সরকার। মধ্যম গুরুত্বের প্রায় সাড়ে ৬০০ প্রকল্পের চার ভাগের এক ভাগ অর্থ খরচে বাধা পড়ে। সব মিলিয়ে ১,৩৭২ টি প্রকল্পের মধ্যে প্রায় ৭০০ প্রকল্প ব্যয়ের বরাদ্দে লাগাম পড়েছে। এসব প্রকল্পে আপাতত অর্থ ছাড় দেবে না অর্থ মন্ত্রণালয়। যেসব প্রকল্প সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে চিহ্নিত রয়েছে, সেগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। 

এদিকে দেশের আর্থিক চাপ সামাল দিতে সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকও একের পর এক উদ্যোগ নিয়েছে।

চলমান আর্থিক পরিস্থিতি মোকাবিলা ও ব্যয় সংকোচনে প্রশাসনের স্তরে স্তরে গৃহীত নানামুখী পদক্ষেপ থেকে মনে হচ্ছে সরকারি সব প্রতিষ্ঠান এক অভিন্ন ব্যয় সংকোচন নীতি মেনে চলছে। 

গত ২০ জুলাই সরকারের পক্ষ থেকে ব্যয় সংকোচনের আট দফা নির্দেশনা জারি করা হয়। সেসব নির্দেশনা কতটা পালন করা হচ্ছে তার খোঁজ নিতে ঢাকাটাইমস কথা বলে বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তার সঙ্গে।

তারা জানান, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া অনেক আগেই শুরু হয়েছে। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে সরকারি দপ্তরে নানামুখী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। গাড়ি ও জ্বালানির ব্যবহার কমানো হয়েছে। লাগাম টানা হয়েছে বিদেশ ভ্রমণে।

নিজেরা ছাড়াও অন্যান্য দপ্তরকেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ে তাগাদা দিচ্ছেন বলে জানান  বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপপ্রধান তথ্য কর্মকর্তা মীর মোহাম্মদ আসলাম উদ্দিন।

ঢাকাটাইমসকে আসলাম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা আমাদের অফিসে ২৫ শতাংশ বিদ্যুৎ কম ব্যবহার করছি। প্রয়োজন ছাড়া এসি চালানো হচ্ছে না। অফিসাররাও দরকার ছাড়া গাড়ি ব্যবহার করছেন না। সুতরাং জ্বালানিও সাশ্রয় হচ্ছে। আমরা অন্যান্য দপ্তরেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ের তাগাদা দিয়ে যাচ্ছি।’ এটি বাস্তবায়ন হচ্ছে বলে জানান তিনি।   

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সরকারি গাড়ি যত্রতত্র ব্যবহার করা যাবে না জানিয়ে বলেছেন, এরইমধ্যে কয়েকজন অফিসারের সরকারি গাড়ি ব্যবহার করার বিষয় নজরে এসেছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এছাড়া যখনই কারো বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ আসবে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সরকারী কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার।  সম্প্রতি ৩০০ কর্মকর্তার সম্ভাব্য বিদেশ সফর বাতিল করা হয়েছে। এসব কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণের অনুমতি দিয়ে সরকারি আদেশ (জিও) জারি করেছিল কর্তৃপক্ষ। ব্যয় সংকোচন নীতির কারণে সেটি বাতিল করা হয় বলে জানানো হয়।

কর্মকর্তাদের বিদেশভ্রমণ ও সরকারের অর্থ অপচয় রোধের বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা নজরদারি বাড়াচ্ছি। একনেকের প্রকল্পগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে যথেষ্ট বিবেচনার সাথে। এসব প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় বিদেশভ্রমণের বিষয় নজরে এলে তা ছেঁটে ফেলা হচ্ছে। আমাদের কর্মকর্তারা এখন এসব বিষয়ে বেশ অ্যালার্ট (সতর্ক)।’

শারীরিক উপস্থিতিতে সভার হার কমিয়ে অনলাইনে সভার হার বাড়ানোর নির্দেশনা রয়েছে সরকারের। এই নির্দেশনা বাস্তবায়নের বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবদুল্লাহ শিবলী সাদিক বলেন, ‘কোভিডের শুরু থেকেই আমরা অনলাইনে বেশির ভাগ সভা করি। কিছুদিন আগেও ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির মিটিং আমরা অনলাইনে করেছি। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া শারীরিক উপস্থিতিতে সভা করা হচ্ছে না।’

খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্যপণ্যের মূল্য সহনীয় রাখতে বাজার মনিটরিং, মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে মজুদদারির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. সহিদুজ্জামান। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘বাজার স্থিতিশীল রাখতে প্রতিনিয়ত আমরা মনিটরিং করে যাচ্ছি। আমাদের বাজার মনিটরিং কমিটি প্রতি সপ্তাহেই মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক বাজার মনিটর করছে।’

এদিকে দেশের আর্থিক চাপ সামাল দিতে ও দেশে ডলার সংকট নিরসেন মাঠে নেমেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলার নিয়ে কারসাজির অভিযোগে বেশ কয়েকটি মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স বাতিল করেছে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানটি। সর্বশেষ দুর্বল ১০টি ব্যাংক চিহ্নিত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকটি।

এর আগে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত দেশের সব ব্যাংকের গাড়ি কেনা বন্ধ করার পাশাপাশি অ্যাপায়ন, ভ্রমণ, আসবাব ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম কেনার খরচও অর্ধেক করে দেওয়া, ব্যাংকঋণ পুনঃ তফসিল ও পুনর্গঠনের নীতিমালা সংশোধন এবং আমদানি ঋণপত্র খোলার সংখ্যা কমানোসহ আরো বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

বর্তমান অবস্থায় আইএমএফের ঋণ প্যাকেজ নেওয়া কথা বলেন পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও আইএমএফের সাবেক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘দেশের আর্থিক অবস্থা এখন অনেক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাই সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত না নেওয়া হলে বড় ক্ষতির মুখে পড়তে পারি। আইএমএফের ঋণ প্যাকেজ অনুমোদন দিলে বাজার স্থিতিশীল হবে এবং আমরা কিছু তহবিল পাব, যা দিয়ে রিজার্ভ উন্নত করা যাবে।’

অপরদিকে ডলার সংকট নিরসনে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আইনুল ইসলাম। ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার নিয়ন্ত্রণে রাখতে একের পর এক উদ্যোগ নিয়ে যাচ্ছে। ডলার রিজার্ভের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় আমানত হিসাবে কেউ ডলার জমা রাখালেই তাকে চার থেকে পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, যা একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। ডলার সংকট মোকাবেলায় সময়ে সময়ে বাংলাদেশ যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে সবগুলোই ছিল সময়োপযোগী।’

চলমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক ব্যয় সাশ্রয়ে ব্যয় সংকোচন নীতি হিসেবে সরকার যে আটটি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল, সেগুলো হলো-

  • বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে সব মন্ত্রণালয় (মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সব অফিস) প্রয়োজনীয় কর্মপন্থা নিরূপণ করবে। সরকারি সব দপ্তরে বিদ্যুতের ব্যবহার ২৫% হ্রাস করতে হবে।
  • জ্বালানি খাতের বাজেট বরাদ্দের ২০ শতাংশ কম ব্যবহারের লক্ষে অর্থ বিভাগ প্রয়োজনীয় পরিপত্র জারি করবে। অর্থাৎ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা তেল ব্যবহার করেন এখন তাদের বরাদ্দ ২০ শতাংশ কম হবে।
  • অনিবার্য না হলে শারীরিক উপস্থিতিতে সভা পরিহার করতে হবে এবং অধিকাংশ সভা অনলাইনে আয়োজন করতে হবে।
  • অত্যাবশ্যক না হলে বিদেশ ভ্রমণ যথাসম্ভব পরিহার করতে হবে।
  • খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্যপণ্যের মূল্য সহনীয় রাখতে বাজার মনিটরিং, মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে মজুদদারির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ অন্যান্য পদক্ষেপ জোরদার করতে হবে।
  • শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী পরিবহনে ব্যক্তিগত যানবাহনের ব্যবহার যৌক্তিকিকরণের লক্ষে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
  • অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ বৃদ্ধিকল্পে অর্থবছরের শুরু থেকেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এনবিআরকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
  • প্রতিটি মন্ত্রণালয় নিজস্ব ক্রয় পরিকল্পনা পুনঃপর্যালোচনা করে রাজস্ব ব্যয় কমানোর উদ্যোগ গ্রহণ কবে।

(ঢাকাটাইমস/০৫আগস্ট/ওএফ/মোআ)