জ্বালানিতে ভর্তুকি বন্ধ সময়োপযোগী, শিক্ষায় বিনিয়োগ চাই

অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ
 | প্রকাশিত : ০৬ আগস্ট ২০২২, ১৭:৪৭

আজ সারা বিশ্বে জ্বালানি সংকট একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। সেই সংকট মোকাবেলা করার জন্য সব দেশের সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা এমন পরিস্থিতিতে ভর্তুকি দিয়ে চলছিলাম। আর সরকারের কাঁধে ঋণের বোঝা চাপিয়ে আনন্দ-ফুর্তি করছিলাম। সেই বোঝা আসলে সরকার নয় দেশের দরিদ্র মানুষদের বহন করতে হয়।

জ্বালানির ওপর ভর্তুকি দেওয়ার যুক্তি হিসেবে কৃষি, উৎপাদন ও পণ্য সরবরাহকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু সেই ভর্তুকির সুবাদে আমরা সুলভ মূল্যে গাড়ি চড়ে বিলাসী জীবনযাপন করি। বিগত বছরগুলোতে দেখছি যানজট আর যানজট। আমরা এত অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ করি তা বোধহয় পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের মানুষ করে বলে মনে হয় না।

আমাদের গাড়ি কেনার একটি যুক্তি সন্তানকে স্কুলে পাঠানো, স্ত্রীকে নিউমার্কেটে পাঠানো এবং ছুটির দিনে দাওয়াত খাওয়া। আমাদের এই কর্মকাণ্ড থেকে সৃষ্টি হচ্ছে অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতা। সবাই একটি গাড়ি কেনার স্বপ্ন দেখছি। আমরা উপলব্ধি করছি জলবায়ুর পরিবর্তন। হাঁসফাঁস করছি গরমে। কিন্তু আমি নির্দয়ভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র ব্যবহার করছি।

আমরা সেগুলো খুবই যত্নের সঙ্গে ব্যবহার করতে পারি। কিন্তু সেদিকে আমাদের নজর নেই। আমরা যদি বুঝতাম তবে আমাদের উন্নয়ন আরও অনেক ধাপ উপরে যেত। আমার মতে, কেবল জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি করলেই চলে না। বরং সেখানে রেশনিং করে দেওয়া হোক। পাশাপাশি পাবলিক ট্রান্সপোর্ট উন্নত করা হোক। পথে পথে চাঁদাবাজি বন্ধ করা হোক। জনগণ এসব পলিসির সুফল পাবে।

আমাদের ঋণের বোঝা যত কম থাকবে ততই আমরা ভালো থাকব। ‘ঋণ করে হলেও ঘি খাও’ নীতি প্রকৃত সুখ বয়ে আনতে পারে না।

সম্প্রতি লোডশেডিং দেওয়ার প্রতিবাদ করে আমাদের বিরোধী দল প্রতিবাদ সভা, মিছিল ও হরতাল করেছে। কিন্তু তাতে কেউই সাড়া দেয়নি। জনগণ বুঝছে যে আমাদের সতর্ক হওয়া দরকার। সুতরাং তারা লোডশেডিং মেনে নিয়েছে। আমাদের এখন মনোযোগী হওয়া দরকার কীভাবে দিনের আলো, প্রকৃতির বাতাস ব্যবহার করে ভালো জীবনযাপন করা যায়। আমাদের সীমিত সম্পদ কীভাবে সুষম বণ্টন করা যায় যাতে সামাজিক বৈষম্য কমে। আমাদের নজর দেওয়া উচিত কীভাবে গ্রাম থেকে শহরে যে ব্যাপক মাইগ্রেশন চলছে সেটা বন্ধ করা যায়।

আমাদের গ্রামের সব রাস্তা পাকা। সুতরাং একজন ডাক্তার সেখানে যেতে পারেন। রোগীদের ঢাকা পর্যন্ত ছুটতে যাতে না হয়। সেজন্য আমাদের হাসপাতালগুলোতে নজর দেওয়া দরকার। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া, যাতে সেখানে যত্নের সঙ্গে পড়ালেখা হয়। যাতে করে ভালো শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানো যায়। যদি আমরা প্রতিটি বিদ্যালয়ে ভালো শিক্ষক দিতে পারি তাহলে কেউই মিরপুর থেকে মতিঝিল কিংবা আজিমপুর থেকে উত্তরা যাবে না।

আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে ভালো শিক্ষক পাওয়া যায় না, তার অন্যতম কারণ বেতন কম এবং পদমর্যাদা কম। ফলে একজন মেধাবী ছাত্র চলে যায় ব্যাংক, বিমা কিংবা ওই রকম কোনো কাজে। আর এভাবেই শুরু হয় সংকট।

আমাদের এক নতুন রোগ ইংলিশ মিডিয়াম। এই রোগ নিয়ে আমাদের কারও ভাবনা নেই। ফলে সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে নজর দিতে হলে যেখানে আমাদের ভর্তুকি কিংবা অপচয় হচ্ছে কিংবা যেখানে দুর্নীতি হচ্ছে সেখানে নজর দেওয়া সম্ভব। আমরা যে দুষ্টচক্রে জর্জরিত সেটাকে ভাঙতে হলে শিক্ষাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। ভোগবাদী জীবন নয়, আদর্শকে শিক্ষায় আনতে হবে। যদি সেটা সম্ভব হয় তবে উন্নয়ন টেকসই হবে। আশা করি সবাই সেটা বুঝতে পারবে।

আমাদের সরকার শিক্ষায় অনেক মনোযোগ দিয়েছেন। কিন্তু সেখানে এখনও আরও অনেক কিছু করার আছে। গুণগত মানের শিক্ষা দিতে শিক্ষক, ছাত্র, অভিভাবক এবং সরকারকে সদা জাগ্রত থাকতে হবে।

আমি মনে করি, জ্বালানি তেলের মতো আরও যেখানে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে সেগুলো বন্ধ করা যায় কি না। মানুষ এখন এতটাই দিশেহারা যে, জীবনের মূল্য ও সুখ কোনোটাই পাচ্ছে না। সে ছুটছে ছুটছে কিন্তু তার তৃপ্তি নেই। তার মনে হতাশা আর হতাশা। জীবনের অপূর্ণতাকে জয় করতে হলে সঠিক শিক্ষা একান্ত উপযোগী। আমাদের শিক্ষাকে যদি মানসম্মত করতে পারি তবেই আমরা প্রকৃত উন্নয়ন অর্জন করতে পারি। আসুন আমরা শিক্ষাকে গুরুত্ব দেই।

আমরা এখন প্রতিটি প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একটি লাইব্রেরি নির্মাণ করতে পারি। তাতে যে নির্মাণকাজ হবে সেখানে কর্মসংস্থান হবে। আমাদের অর্থনীতি সচল হবে। আমাদের স্কুলগুলোতে বিজ্ঞান মেলা, বিতর্ক ও পাঠের প্রতিযোগিতা আয়োজন করতে পারি। ফলে দেশব্যাপী আমাদের শিশুরা আনন্দে পড়াশোনায় মাতবে। তারা ভার্চুয়াল জগৎ থেকে বাস্তব জগতে সময় কাটাবে। আশা করি আমাদের ভাবোদয় হবে।

আমরা যদি ভাবি আমাদের সন্তানেরা প্রাইভেট গাড়িতে করে স্কুলে যাবে, তবে কোনোদিনই আমরা টেকসই উন্নয়ন অর্জন করতে পারব না। আমাদের শিক্ষার ঘাটতি আমাদের উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা ও সব অসুখের কারণ। সেজন্য শিক্ষায় মনোযোগ দেওয়া একান্ত জরুরি।

যে উন্নয়নের ডানা আমরা মেলেছি তার জ্বালানি জোগাড় যে নেই, সেটা ভুলে গেছি আর তাই উদ্বিগ্ন হচ্ছি কীভাবে ঋণ শোধ করব ভেবে। এমন সময়ে জ্বালানির ওপর ভর্তুকি বন্ধ একটি বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ।

লেখক: অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :