মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি বাড়বে দারিদ্র্য

জ্বালানি তেলের মূল্য পুনর্বিবেচনার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

রুদ্র রাসেল, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০৭ আগস্ট ২০২২, ১১:২৭ | প্রকাশিত : ০৭ আগস্ট ২০২২, ১০:১৪
শুক্রবার হঠাৎ এক লাফে ৪২-৫২ শতাংশ বেড়েছে জ্বালানি তেলের মূল্য

হঠাৎ এক লাফে জ্বালানি তেলের মূল্য ৪২-৫২ শতাংশ বাড়ানোর ফলে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এটি অযৌক্তিক। এতে মূল্যস্ফীতি ২ ডিজিটে দাঁড়াবে। একইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে দারিদ্র্যের হার। কমে যাবে মানুষের আর্থিক সক্ষমতা, ক্রয়ক্ষমতা। করোনা অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে যতটা হুমকি সৃষ্টি করেছিল- তার থেকেও অতিরিক্ত হুমকি হয়ে দাঁড়াবে জ্বালানি তেলের এই দাম বৃদ্ধির প্রভাব। ফলে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের জীবন অতিকষ্টের মধ্যে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং অর্থনীতিবিদরা। তারা সরকারকে এই মূল্য পুনর্বিবেচনার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, এই মূল্য বৃদ্ধির ফলে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে।

শনিবার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে ঢাকা টাইমসের সঙ্গে আলাপকালে এমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, গোলাম রহমান, ড. সালেহউদ্দিন, ড. শামসুল আলম, ম. তামিম ও খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমসহ দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম এত বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল না। এটা অপ্রত্যাশিত। মূল্য বৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান আরও নেমে যাবে। পরিবহন খরচের পাশাপাশি উৎপাদন খরচ বাড়বে। পাশাপাশি প্রান্তিক মানুষের আয় আরও দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাবে।

গত শুক্রবার রাত ১২টার পর জ্বালানি তেলের নতুন দাম কার্যকর হয়েছে। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, পেট্রলের দাম ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা এবং অকটেনের দাম ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা করা হয়েছে।

বড় ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে: ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে আরও বেশিসংখ্যক মানুষ দরিদ্র হবে উল্লেখ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানোর কারণে পরিবহন খরচের পাশাপাশি উৎপাদন খরচও বাড়বে। বিশেষ করে ডিজেলের দাম বাড়ায় সেচ খরচ বেড়ে যাবে। ফলে কৃষিখাত বড় ধরনের চাপের মুখে পড়বে।’

তার যুক্তি হচ্ছে, ‘পরিবহন ও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি বাড়বে। এতে দরিদ্র্, অতিদরিদ্র এবং নিম্ন আয়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বড় ধরনের চাপের মুখে পড়বে। দেশে দারিদ্র্যের হার বাড়বে। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে।’

মির্জ্জা আজিজ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম এখন কিছুটা নিম্নমুখী। তারপরও ভর্তুকি কমানোর কারণে সরকার দাম বাড়িয়েছে। এতে করে সরকারের ভর্তুকি আর থাকার কথা নয়। ফলে সরকারের উচিত হবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে এলে তা সমন্বয় করা।

মানুষের জীবনে অস্থির পরিস্থিতি আসবে: গোলাম রহমান

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান ও কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেছেন, ‘একসঙ্গে এত দাম বাড়াবে কল্পনাও করা যায়নি।’

এই দাম বৃদ্ধির ফলে মানুষের জীবনে অস্থির পরিস্থিতি আসবে বলেও আশঙ্কা তার।

গোলাম রহমান বলেন, ‘ জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে সবকিছুর দাম আরও বেড়ে যাবে। এমনিতেই ৮ শতাংশের কাছাকাছি মূল্যস্ফীতি। এটা ডাবল ডিজিটে চলে যেতে পারে। মানুষের জীবন ধারণ কষ্টকর হয়ে যাবে। আমাদের আশঙ্কা- মানুষের মধ্যে অস্থিরতা কাজ করবে। এমনিতেই মানুষ কষ্টে আছে। সাধারণ মানুষের কষ্ট আরও বেড়ে যাবে।’

তার ভাষ্য, ‘জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা থাকলেও যতটা বৃদ্ধি করা হয়েছে তা অপ্রত্যাশিত। এতটা বাড়ানো যৌক্তিক হয়নি। মানুষের কল্যাণ দেখতে হবে আগে। মানুষ কতটা বোঝা বহন করতে পারে- সেই সঙ্গতি, সেই সক্ষমতা বিবেচনা করতে হবে। এই দাম বৃদ্ধির ফলে সরকারের যত অর্জন তা ম্লান হয়ে যেতে পারে।’

সরকারের প্রতি পরামর্শ কী- এমন প্রশ্নের জবাবে গোলাম রহমান বলেন, ‘আমার মতে করণীয় বলতে মানুষের আয় বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নিতে হবে। মানুষের আয়, কর্মসংস্থান যদি বৃদ্ধি করা যায়- তাহলে হয়ত নেতিবাচক প্রভাব কিছুটা কাটানো সম্ভব হবে।’

অবাককাণ্ড, আইএমএফ বললেই কি তা করতে হবে: ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এক লাফে জ্বালানি তেলের দাম এতটা বৃদ্ধির ঘটনা অদ্ভুত-অবাককাণ্ড, একদম অযৌক্তিক। এটি খুব দুঃখজনক। এতে অনেকের জীবন অতি কষ্টের মধ্যে পড়বে। একটি সেক্টরের ওপরে এত চাপ ঠিক নয়।’

বর্ধিত দাম পুনর্বিবেচনার পরামর্শ দিয়েছেন ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘ভারতে তেল পাচার হবে কিংবা আইএমএফের শর্তের দোহাই দিয়ে তেলের দাম বাড়িয়ে দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই। তেল পাচার হলে বর্ডার কন্ট্রোল করুক। কিন্তু দাম বাড়াবে কেন?- এমন প্রশ্নও রাখেন এই অর্থনীতিবিদ।

তিনি বলেন, ‘সরকারের কেউ কেউ বলছেন পার্শ্ববর্তী দেশের কথা। ভারতে কোনো কিছুর দাম বাড়লেও তা ওরা অ্যাডজাস্ট (সমন্বয়) করে ফেলে। বাংলাদেশে তো তা হচ্ছে না। বিশ্ববাজারে এখন দাম কমতির দিকে। সেই অবস্থায় এখানে দাম বাড়বে কেন?- এমন প্রশ্নও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নরের।

ড. সালেহউদ্দিন বলছেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলেও বাংলাদেশে তেলের দাম সেই তুলনায় কমানো হয়ে থাকে না। এবারও তাই করবে হয়তো। কিন্তু দারিদ্র্যের তলানিতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা যে বাড়ছে- সে বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া উচিত। এসব সেবা খাতে সরকার তো ভর্তুকি দেবেই। আইএমএফ বলল আর তারা এক লাফে দাম বাড়িয়ে দিল ৫২ শতাংশ পর্যন্ত- এর যৌক্তিকতা নেই বলে মনে করি। দেশের মানুষের আর্থিক সক্ষমতা, ক্রয়ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার বিষয়ে সরকারের অবশ্যই ভাবনা থাকা উচিত ছিল।

করোনা থেকেও বেশি হুমকি হয়ে দাঁড়াবে: ড. এম শামসুল আলম

ভোক্তা অধিকার বিষয়ক বেসরকারি সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’র (ক্যাব) উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘করোনা অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে যতটা হুমকি সৃষ্টি করেছিল- তার থেকেও বেশি হুমকি হয়ে দাঁড়াবে হঠাৎ জ্বালানি তেলের মূল্য ৫২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধির এই ঘটনা।’

এভাবে হুট করে অস্বাভাবিকভাবে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি না করে মানুষের কাছ থেকে গণশুনানির ভিত্তিতে প্রস্তাব গ্রহণের পর পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং পরবর্তীতে মানুষের সুপারিশ নিয়ে তা বাস্তবায়ন করা উচিত ছিল।’

এই মুহূর্তে দাম বাড়ানো ন্যায়সঙ্গত নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আইএমএফের ঋণ পাওয়ার শর্ত ছিল ঘাটতি সমন্বয়। দাম বাড়িয়ে ঘাটতি সমন্বয় করতে গিয়ে জনগণের ওপর যে আঘাত হানা হয়েছে, তা সিডর-আইলার মতো ঘূর্ণিঝড়কে হার মানায়।’

শামসুল আলম বলেন, ‘এই মূল্য বৃদ্ধির ফলে সবকিছুর দাম বেড়ে যাবে। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে।’

তিনি বলেন, ‘এমনিতেই মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে গেছে। দাম বাড়লেও মানুষের বেতন, আয় তো বাড়ছে না।’

এছাড়া এই দাম বাড়ানোর ফলে অতিরিক্ত সংখ্যক মানুষ আরো দরিদ্র হতে যাচ্ছে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

সরকার আইএমএফ’র ঋণের জন্য দাম বাড়িয়েছে: ম. তামিম

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ম. তামিম জ্বালানি তেলের দাম একসঙ্গে এত পরিমাণ বৃদ্ধিকে অগ্রহণযোগ্য উল্লেখ করে বলেছেন, ‘সরকারের এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত।’

তিনি বলেন, ‘মূল্যবৃদ্ধি কার্যকরের সঙ্গে সঙ্গে আমরা দেখছি গণপরিবহন বন্ধ রয়েছে। অতিরিক্ত ভাড়া বৃদ্ধির আগেই যদি সরকার পুনর্বিবেচনা করে, তাহলে সেটা ভালো হয়।’

বুয়েটের এই অধ্যাপক বলেন, ‘আমার ধারণা, সরকার আইএমএফ’র ঋণ নেওয়ার জন্য এই বিশাল পরিমাণ দাম বৃদ্ধি করল। কেননা- আইএমএফ’র শর্ত ছিল জ্বালানি পণ্যে ভর্তুকি থাকলে তারা ঋণ দেবে না।’

বিশ্ববাজারে এখন তেলের দাম পড়তির দিকে, তাই এই সময় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর দরকার ছিল না বলেও মনে করেন ম. তামিম।

দারিদ্র্যকে উসকে দেবে: খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ’র (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘সরকার জ্বালানি তেলের দাম যে পরিমাণ বাড়িয়েছে তা সাম্প্রতিক বছরগুলোর হিসাবে সর্বোচ্চ। যা জীবন যাত্রার ব্যয় বাড়াবে। দারিদ্র্য ও মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর বিষয়টি সরাসরি ভোক্তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া উচিত হয়নি বলেও মনে করেন তিনি।

‘আমার মনে হয় এই প্রতিক্রিয়া সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিফলিত হতে যাচ্ছে। কৃষি খাতে শুষ্ক মৌসুমে ডিজেলের মাধ্যমে সেচের ব্যবহারের ওপরও প্রতিক্রিয়া পড়বে। ফলে শাকসবজিসহ কৃষিপণ্যে মূল্য বৃদ্ধি পাবে।’

তিনি বলেন, ‘উদ্বৃত্ত যে অর্থ ছিল, সরকার তা না নিয়ে ভর্তুকির কাজে ব্যবহার করতে পারত। ফলে জ্বালানি তেলের দাম না বাড়ালেও চলত।’

প্রসঙ্গত, শুক্রবার রাতে হঠাৎ জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেয় সরকার। ওই দিন রাত ১২টা থেকেই নতুন দাম কার্যকর হয়েছে। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, পেট্রলের দাম ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা এবং অকটেনের দাম ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা করা হয়েছে।

এর আগে প্রতি লিটার কেরোসিন ও ডিজেল ৮০ টাকা, অকটেন ৮৯ টাকা আর পেট্রল ৮৬ টাকা বিক্রি হচ্ছিল। নতুন দাম বৃদ্ধিতে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৪২.৫ শতাংশ, পেট্রল ৫১.১৬ শতাংশ ও অকটেনের দাম ৫১.৬৮ শতাংশ বাড়লো।

গত নভেম্বরে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে একলাফে ১৫ টাকা বাড়িয়েছিল সরকার। তখন দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮০ টাকা লিটার। ডিজেলের দাম বাড়ানোর পর বাসভাড়া বাড়ানো হয় প্রায় ২৭ শতাংশ, যা তেলের দাম বাড়ানোর হারের চেয়ে অনেক বেশি। একইভাবে তখন লঞ্চভাড়া বাড়ানো হয় ৩৫ শতাংশ।

(ঢাকাটাইমস/০৭আগস্ট/আরআর/এফএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :