অপরাধে জড়াচ্ছে ভাসমানরা, বিপাকে পুলিশ

প্রকাশ | ০৯ আগস্ট ২০২২, ২৩:০৬ | আপডেট: ১০ আগস্ট ২০২২, ১৮:২৯

আবদুল হামিদ, ঢাকাটাইমস

রাজধানীতে ভাসমান ও ভবঘুরে মানুষ অতিমাত্রায় অপরাধে জড়াচ্ছে, যা ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরে এসেছে। সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে আইন প্রযোগকারী সংস্থাগুলোকে। একটি হত্যাকাণ্ড ঘটলেই নড়েচড়ে বসছে সংস্থাগুলো। এর মধ্যে রাজধানীর শাহবাগ ও খিলক্ষেত এলাকায় কয়েকদিনের ব্যবধানে হত্যার শিকার হয়েছেন দু ব্যক্তি। এদের মধ্যে একজন ভবঘুরে মানুষকে অপরাধ করতে বাধা দেওয়া এবং অন্যজন মাদক ভাগাভাগি নিয়ে হত্যার শিকার হন।

ভাসমান মানুষ বসবাস করা এলাকায় সব ধরনের অপরাধ বেশি ঘটছে। গত জুন মাসে রাজধানীতে ২১টি খুন হয়। এর মধ্যে আটটি ঘটনার সঙ্গে ভাসমান মানুষের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে এখন পর্যন্ত সাতটি ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের পরিচয় নিশ্চিত হতে পারেনি সংস্থাগুলো। এছাড়া ভাসমান এসব মানুষের কোনো স্থানীয় ঠিকানা না থাকায় তদন্তে বেগ পেতে হচ্ছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে।

এবারের শুমারিতে সারাদেশে বস্তিতে থাকা মানুষের সংখ্যা ১৮ লাখ ৪৮৬ জন। আর ভাসমান মানুষের সংখ্যা ২২ হাজার ১৮৫ জন। এর মধ্যে ঢাকায় সর্বোচ্চ বস্তিতে থাকা লোকের সংখ্যা আট লাখ ৮৪ হাজার ৪৯৬ জন। আর ভাসমান লোকের সংখ্যা নয় হাজার ৪৭০ জন।

এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর ভাসমান মানুষের দ্বারা অপরাধের ঘটনা বাড়ছে। তাছাড়া রাজধানীতে ভাসমান ও ভবঘুরে মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে কয়েকগুণ। প্রতিটা অপরাধের পেছনে একটা এড্রেস থাকে। কিন্তু ভাসমান মানুষের দ্বারা সংঘটিত কোনো অপরাধের (এড্রেস) ঠিকানা থাকছে না। তারা বিশেষ করে অপরাধ করার পরে ওই এলাকা এড়িয়ে চলেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) একটি অপরাধ পর্যালোচনা প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছর রাজধানীতে খুন হয়েছেন ১৬৬ জন। তবে এ বছর জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত খুন হয়েছেন ৮৬ জন। আর গত বছর জুনে খুন হন দশজন। আর এবছর জুনে খুন হয়েছে ২১ জন। রাজধানীতে গত বছর জুনের তুলনায় এ বছর জুনে খুন হয়েছে দ্বিগুণ।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান বলেন, প্রতিনিয়ত রাজধানীতে ভাসমান মানুষ খুনের ঘটনা বাড়ছে। এরা একসঙ্গে বসে মাদক সেবন থেকে শুরু করে সব ধরনের অপরাধ করে। পরে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে খুনাখুনি করছে।

চলতি মাসের ৬ আগস্ট বিকালে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় ঈদগাহ মাঠের পাশের ফুটপাতে দুই মাদকাসক্তের মারামারির একপর্যায়ে ছুরিকাঘাতে সুমন নামে এক ভরঘুরে খুন হন। নিহত ওই ব্যক্তি মাদকাসক্ত। ওই ঘটনায় রকি নামে আরেক ভবঘুরে মাদকাসক্ত আহত হন।

এর আগে গত ২৯ জুলাই রাজধানীর খিলক্ষেতে হোটেল লা-মেরিডিয়ানের বিপরীতে ফুটপাতে অজ্ঞাত একটি লাশ পাওয়া যায়। পরিচয় শনাক্ত করে দেখা যায়, নিহত আলমগীর ওই এলাকায় নিরাপত্তাকর্মীর কাজ করত। ওই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে ভাসমান মানুষদের অপরাধের চিত্র।

ডিসি মশিউর রহমান বলেন, ফুটপাতে ও রেললাইনের পাশজুড়ে মাদক কেনাবেচা, দেহব্যবসা হতে দেখে তাদের রোজ নিষেধ করতেন, মাঝেমধ্যে বাধাও দিত আলমগীর। এই ক্ষোভ থেকে সুযোগ বুঝে সেদিন মধ্যরাতে ডিউটিরত অবস্থায় আলমগীরকে খুন করে পালিয়ে যায় ভাসমান অপরাধীরা।

তদন্তে নেমে মোয়াজ্জেম ও রুবেল নামে দু’জনকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে তারা খুনের ঘটনার কথা শিকারও করেছেন পুলিশের কাছে। এমন ভাসমান অপরাধী নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভাসমান মানুষ খুনও করছে। অন্য সব অপরাধের ক্ষেত্রে কোনো না কোনো ক্লু থাকে। আবার অপরাধীদের পরিচয়ও মেলে। কিন্তু ভাসমান ও ভবঘুরেরা অপরাধ করলে কোনো পরিচয় না থাকায় তদন্তে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ।

মশিউর রহমান বলেন, প্রতি মাসেই বেশকিছু হত্যাকাণ্ড-জখমের ঘটনা থাকেই। একজন আরেকজনকে খুন করেছে, আঘাত করেছে। এদের কোনো আইডেন্টিফিকেশন (জাতীয় পরিচয়পত্র) থাকে না। একবার এরা পালাতে পারলে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। ভাসমান ভবঘুরেরাও যে রোমহর্ষক ঘটনা ঘটাতে পারে তার উদাহরণ নীলখেত এলাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায়। সেই মামলায় মজনু নামের এক ভবঘুরের সাজাও হয়েছে।

ডিএমপির অপরাধ পর্যালোচনা তথ্য বলছে, রাজধানীতে প্রতিনিয়তই ভাসমান মানুষদের হাতে দু-একটি করে হত্যাকাণ্ড হচ্ছে। এছাড়া চুরি-ডাকাতি-ধর্ষণের মতো ঘটনা তো আছেই। বিষয়টি নিয়ে এখন জটিলতায় পুলিশ। ভাসমান অপরাধী ইস্যুতে সম্প্রতি সভাও করেছে পুলিশ। সেখানে জুন মাসের রাজধানীর ৪২টি মামলা পর্যালোচনায় দেখা গেছে ১৩টি মামলার আসামিদের হদিস মিলছে না। ধারণা করা হচ্ছে এরা ভাসমান।

শারীরিক হেনস্তা, ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টা, ছিনতাইসহ নানা কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছেন ভসমান ও ভবঘুরে মানুষরা। সম্প্রতি অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অপরাধ) এ.কে.এম হাফিজ আক্তারের সভাপতিত্বে এ নিয়ে একটি বিশেষ বৈঠকও করেছে ডিএমপি। এ.কে.এম হাফিজ আক্তার বলেন, ওই বৈঠকে ডিএমপির ৮টি অপরাধ ও গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা অংশ নেন। জুন মাসের ৪২টি মামলা নিয়ে আলোচনার পরে ১৩টি মামলা ডিএমপি মনিটরিং সেলে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যার মধ্যে অধিকাংশ মামলার আসামিই চিহ্নিত করা যায়নি। কারণ, তাদের কোনো পরিচয় কিংবা এলাকা নেই।

বৈঠকে কিশোর গ্যাংয়ের তথ্যভাণ্ডার তৈরি, ভাসমান মানুষ নিয়ে নজরদারি বৃদ্ধি, বিট পুলিশিং জোরদার করার বিষয় আলোচনায় উঠে এসেছে। বিশেষ করে যেই এলাকাগুলোতে ভাসমান লোকজনের আনাগোনা বেশি, সেই সব এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীর উত্তরা বিমানবন্দর, বিশ্বরোড, কদমতলি, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, সদরঘাট, তেজগাঁও, কারওয়ান বাজার, কমলাপুর রেলস্টেশন, হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ ও খিলগাঁওসহ অন্তত ১৫টি এলাকাকে ভাসমান মানুষের অপরাধের জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তবে গুলিস্তান মাজার ও মহানগর নাট্য মঞ্চ পার্কে এখন আর আগের পরিবেশ না থাকায় এলাকায় অপরাধের চাপ একটু কমছে।

ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হারুন অর রশীদ বলেন, বৈশ্বিক কোনো কারণে নয়, টাকা-পয়সার কারণে না কিংবা কোনো লেনদেনের কারণে না। এটা তাদের যে আন্তরিকতা, তাদের সমাজ। যারা গাঁজা খায় তাদের মধ্যে একটা মান-অভিমান থাকে, দুঃখ-কষ্ট থাকে, একটা পর্যায়ে দ্বন্দ্বের কারণে হাতের কাছে যা থাকে ইট বা লাঠি দিয়ে মেরে ফেললো।

এই ভাসমান মানুষরা যাতে অপরাধ করতে না পারে সেজন্য বাহিনীর তৎপরতার পাশাপাশি ভবঘুরের পুনর্বাসনের উদ্যোগও জরুরি বলে মনে করছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।

(ঢাকাটাইমস/০৯আগস্ট/এএইচ/কেএম)