আমরা পারি, আমরাই পারবো ওরা কেন মানতে পারে না?

প্রকাশ | ১০ আগস্ট ২০২২, ১২:১০ | আপডেট: ১০ আগস্ট ২০২২, ১২:৪১

আরিফুর রহমান দোলন

কতটা মানা যায়?

অকারণে যখন নিজের জন্মভূমিকে হেয় করা হয় তখন কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিকের পক্ষে কি মেনে নেওয়া সম্ভব? সম্ভব না।

সামর্থ্য যা-ই হোক, আমার দেশ, দেশের অর্জনকে খাটো করার অপচেষ্টা হলে দৃষ্টি আকর্ষণ আমি করবোই। আমি প্রতিবাদ করবো। আমি সঠিক তথ্য উপস্থাপন করবো। মাথা উঁচু করেই জানান দেবো—স্বাধীন বাংলাদেশ সব ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে।

ঈর্ষা করে বাংলাদেশের অগ্রগতিকে খাটো করা যাবে না। কোনোভাবেই না।

আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের কোনো কোনো গণমাধ্যম মাঝেমধ্যে এমন নেতিবাচকভাবে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করে যে বিস্মিত হতে হয়! বাংলাদেশের ইতিবাচক অর্জনকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করে কী বার্তা দিতে চায় তারা? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো অমীমাংসিতই থেকে যাবে। কারণ, বড় ভাইসুলভ আচরণের চেয়ে সুযোগ পেলে মোড়লসুলভ আচরণ করতে যারা নিজ দেশের নীতিনির্ধারকদের সবক দেওয়ার চেষ্টা করে তাদের থেকে প্রকৃত মূল্যায়ন আশা করা যায়?

ভারতের এক নম্বর বাংলা দৈনিকের দাবিদার আনন্দবাজার পত্রিকার কথা বলছি। সর্বশেষ ৬ আগস্ট আনন্দবাজার অনলাইন রীতিমতো বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে কটাক্ষ করে প্রতিবেদন লিখেছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সরকারি সিদ্ধান্তকে কটাক্ষ করে আনন্দবাজার পত্রিকা শিরোনাম করেছে, ‘বাংলাদেশ কি শ্রীলংকা হওয়ার পথে?’ এটি কী ধরনের সাংবাদিকতা?

পরিসংখ্যান যেখানে বলছে এখনো ভারতের জ্বালানি তেলের মূল্য বাংলাদেশের চেয়ে বেশি বৈ কম নয়। সেখানে শ্রীলংকার বিধ্বস্ত অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা কী কারণে? বাংলাদেশের গত ১৩ বছরের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে অসম্মান করার হেতু কী? এটি ঈর্ষা ছাড়া আর কী?

এই সেই আনন্দবাজার যারা ক্রিকেটে বাংলাদেশ বিশ্বজয় করলে সম্ভবত অখুশি হয়। বাংলাদেশের অনেক অর্জনকে প্রকৃত স্বীকৃতি দিতে দ্বিধা করে। তাই যদি না হবে তাহলে কীভাবে একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন দাবিদার দৈনিক শিরোনাম করে, ‘ফের অঘটন, দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি ম্যাচেও অস্ট্রেলিয়াকে হারাল বাংলাদেশ।’ এটি ২০২১ সালের ৪ আগস্ট আনন্দবাজার পত্রিকার শিরোনাম। হেসেখেলে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করে বিশ্ব ক্রিকেটের এক মোড়লকে যে বাংলাদেশ হারাল, সেটির প্রশংসা না করে উল্টো অঘটন আখ্যা দেওয়া কি ঔপনিবেশিক মানসিকতা নয়?

একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কাকে হারায়নি বাংলাদেশ? ক্রিকেটে অন্যতম পরাশক্তি ভাবা ভারতকেই একাধিকবার হারিয়েছে বাংলাদেশ। বাড়িয়েছে নিজের জৌলুস। পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলংকা, নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে বোকা বানানোর ইতিহাসও বাংলাদেশের আছে। বারবার জয় পাওয়া নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণকে কি অঘটন বলা যায়?

আমরা পারি, আমরাই পারবো। এটা যখন ধারাবাহিকভাবে প্রমাণ করে চলেছে বাংলাদেশ তখন কেন ওরা মানতে পারে না? এই প্রশ্ন রাখা কি দোষের হবে? কেন এই হীনম্মন্যতা? চাণক্যরা কী কারণে ভীত? বাংলাদেশের চেয়ে তুলনামূলক কখনো সখনো পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকেই কি আমাদের ছোট করার চেষ্টা?

বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল—আইএমএফের সমীক্ষা বলছে, বাংলাদেশের জনপ্রতি আয় ভারতের চেয়েও বেশি। এই স্বীকৃতি কি আমাদের অপরাধ? আয়তনে ভারতের চেয়ে অনেক অনেক ছোট বাংলাদেশ। পশ্চিমবঙ্গের দেড়গুণ, রাজস্থানের অর্ধেক। সেই বাংলাদেশের দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ভারতকে যদি ছাপিয়ে যায় সেটি মানতে না পারা ঈর্ষাপরায়ণ মানসিকতাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবো?

ভারতের গণমাধ্যমই বলছে, কংগ্রেসের অন্যতম শীর্ষ নেতা রাহুল গান্ধী প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছেন বর্তমান সরকারের কাছে এটাই বড় পাওনা যে, মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এই মন্তব্য বিদ্রুপ না-কি প্রশংসা সেটি তর্ক সাপেক্ষ। কিন্তু এটিই যে বাস্তবতা, সেটি অস্বীকারেরও কোনো সুযোগ নেই।

জিডিপির প্রবৃদ্ধির হিসাব বলে এক্ষেত্রে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের স্থিতিবস্থাই ক্রমশ স্পষ্ট। কোভিড-১৯ এর সময়কাল বাদ দিলে টানা পাঁচ বছরেরও বেশি বাংলাদেশের জিডিপি ৭ শতাংশের ওপরে। এই ধারাবাহিকতা ভারতের আছে? আন্তর্জাতিক সমীক্ষা, তথ্য-উপাত্ত যা-ই বলি না কেন বাংলাদেশের অর্থনীতি ভারতের চেয়ে নাজুক, দুর্বল বা অনেক পিছিয়ে এমন কোনো ইঙ্গিত দিচ্ছে না দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময়কাল।

আমাদের এই স্বস্তিই কি তবে ওদের অস্বস্তি?

তথ্য-উপাত্ত, অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণকে চাইলেই কি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যাবে? বাংলাদেশের জনপ্রতি আয় ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। আর ভারতের ১ হাজার ৯৬১ ডলার। এই পরিসংখ্যান ২০২১ সালের। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এই অর্জনকে যদি কোনো কোনো গণমাধ্যম চ্যালেঞ্জ করতেই চায় তাহলে তার অনুসন্ধানী গবেষণামূলক প্রতিবেদন থাকতে হবে। তুলনামূলক তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমের বোঝাতে হবে কে এগিয়ে, কে পিছিয়ে। সেটি না করে দু-একটি বা কোনো কোনো ভারতীয় গণমাধ্যম বিভিন্ন উসিলায়, কিংবা সুযোগ পেলেই যেভাবে বাংলাদেশকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করে তা খুবই দৃষ্টিকটু। শিষ্টাচার বহির্ভূতও বটে।

সবচেয়ে বড় কথা, ভারতের সঙ্গে আমরা বাংলাদেশের কোনো তুলনা কখনোই করি না। ভারত আমাদের অন্যতম বন্ধুরাষ্ট্র। বিশেষত, মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থন আমরা সবসময় কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি। এতটাই যে, ভারতের যেকোনো অর্জনে আমরা আনন্দিত হই। ভারতের কোনো বিসর্জনে আমরাও ব্যথিত হই। ভারতের এক সময়ের প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় কংগ্রেস সভানেত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশজুড়ে যে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল, তা আসলে আপনজন হারানোর ব্যথা থেকেই। এমন ভূরি ভূরি উদাহরণ দেওয়া যাবে।

ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী কারোরই বাংলাদেশের মাটিতে ঠাঁই না পাওয়ার যে দৃঢ় অঙ্গীকার ও প্রত্যয় বঙ্গবন্ধুকন্যা দেখিয়ে চলেছেন তার কি কোনো তুলনা হয়? প্রশংসা পাওয়ার জন্য নয়, প্রকৃত বন্ধুরাষ্ট্রের প্রতি নির্ভেজাল ভালোবাসা আর সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে নিজের কমিটমেন্ট থেকেই তাঁর এই অবস্থান আধুনিক বাংলাদেশের এক প্রতিচ্ছবি।

আমি মনে করি, এসব বিবেচনায়ও বাংলাদেশ ছোট হয়ে যায় বা বাংলাদেশের অর্জনকে খাটো করা হয় এমন কাজ ভারতীয় গণমাধ্যমের কারোরই করা উচিত নয়। সমালোচনার পাশাপাশি দায়িত্বশীল আচরণও কিন্তু গণমাধ্যমকে করতে হবে।

মাঝেমধ্যেই যখন বাংলাদেশকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা হয় তখন ভীষণ কষ্ট লাগে। এই যেমন ভারতীয় অনলাইন পোর্টাল ‘জি২৪ ঘণ্টা’য় একবার শিরোনাম করা হলো, ‘ভারতকে চাপে ফেলতে বাংলাদেশকে খয়রাতি চীনের!’

খয়রাতি? এটি কি শব্দ? খয়রাতি বলতে কিন্তু ভিক্ষা বোঝায়। আমাদের বলা হলো ভিক্ষুক। কে বলল, বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের একটি গণমাধ্যম। এই শব্দচয়ন অরুচিকর। বন্ধুত্বপূর্ণ দুদেশের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি বাড়ানোর ক্ষেত্রে অস্বাস্থ্যকরও বটে। আমাদেরকে বিশেষ করে যেসব গণমাধ্যম উস্কানিমূলক এসব শব্দচয়ন করে তাদের বিষয়টি বেশি করে খেয়াল রাখতে হবে।

ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান, বিশিষ্টজন বাংলাদেশ সফরে এলে আমাদের প্রচারমাধ্যম ঝাঁপিয়ে পড়ে কাভারেজ দেয়। আমাদের ক্ষেত্রে কতটা তারা করে? ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সচিব এলে আমাদের পত্রিকায় বড় করে ছবি ছাপা হয়, টেলিভিশনে স্ক্রলে যায়, অনলাইন পোর্টালেও। বাংলাদেশের একই মানের কেউ ভারত সফর করলে সমান মর্যাদা সেখানকার গণমাধ্যম দেয় কি?

আমরা উদার। এড়িয়ে যাই। প্রশ্ন তুলি না। প্রসঙ্গ উঠতে দেই না। আমলেই নেই না এসব। বন্ধুরাষ্ট্র ভারত আমাদের অকৃত্রিম সহযাত্রী, উন্নয়নে, সন্ত্রাস দমনে, অথনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, শ্রীবৃদ্ধি হোক আরও, এগিয়ে যাক ভারতও। দু’দেশের সম্প্রীতি আর মেলবন্ধন চির অটুট থাকুক। ঈর্ষা আর হিংসা যেন কখনো প্রশ্রয় না পায়। অদম্য শেখ হাসিনা, অদম্য বাংলাদেশ। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়। চির অটুট থাকুক এই নীতি।

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ঢাকা টাইমস, ঢাকা টাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকম ও সাপ্তাহিক এই সময়