একসময়ের কোলাহলপূর্ণ এফডিসি এখন...

প্রকাশ | ১০ আগস্ট ২০২২, ১৩:২৪

লিটন মাহমুদ, ঢাকা টাইমস

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনকে (বিএফডিসি) বলা হয় ঢাকাই সিনেমার ‘আঁতুর ঘর’। এখানেই নির্মিত হয় সিনেমা। বসে অভিনয়শিল্পী, পরিচালক, প্রযোজক ও কলাকুশলীদের আড্ডা। কিন্তু সিনেমা নির্মাণ কমে যাওয়ায় এখন আর লাইট, ক্যামেরার ঝলকানি, পরিচালকের অ্যাকশন, কাট শব্দগুলো তেমন আর শোনা যায় না। আগের মতো তারায় তারায় মুখরিত হয় না এফডিসি।

একসময়ের কোলাহলপূর্ণ এফডিসি বর্তমানে অনেকটাই নীরব, নিস্তব্ধ। মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে এফডিসিতে গেলে ঢুকতে হলো কারওয়ান বাজার রেলগেটের পাশে বানানো নতুন গেট দিয়ে। কয়েক কদম এগিয়ে যেতে দেখা মিলল দুজন নিরাপত্তাকর্মীর। আর একটু এগিয়ে বাঁ হাতে ঢুকে দেখা গেল গুমোট অন্ধকার।

ভিআইপি প্রজেকশন হলের বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়াতেই পাশ থেকে কানে এলো কাঠ ঠোকরানোর আওয়াজ। শব্দ অনুমান করে আগাতেই দেখা গেল ৭ নম্বর ফ্লোরে চারজন ব্যক্তি সেট নির্মাণে ব্যস্ত। কিসের সেট জিজ্ঞেস করলে তারা জানালেন, একটি বিজ্ঞাপনের শুটিং হবে শুক্রবার। বিশাল সেট নির্মাণ করতে হবে। এ জন্য তারা কাজে খুব মনোযোগী।

সেখান থেকে বের হয়ে জসিম ফ্লোরের পাশ দিয়ে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সামনে যেতেই ঘন অন্ধকার। সমিতির বাইরে তালা, জ্বালানো নেই লাইটও। আরেকটু এগিয়ে পরিচালক সমিতির সামনে গিয়েও কাউকে দেখা যায়নি। সমিতির সামনে শুয়ে আছে চার-পাঁচটা কুকুর। তবে এর উল্টো পাশে থাকা ১ নম্বর সেটে লোকজন দেখা গেল।

ভেতরে প্রবেশ করে জানা গেল, তারা একটি গ্রিন ব্যাকগ্রাউন্ড সেট নির্মাণ করছেন। সেখানে একটি বিজ্ঞাপনের ক্রমার শুট হবে। ওখান থেকে বেরিয়ে ক্যান্টিনের দিকে এগিয়ে যেতেই সেটিকে তালাবদ্ধ পাওয়া গেল। অথচ, এফডিসির ভেতরে এই জায়গাটাই থাকে সবচেয়ে কোলাহলপূর্ণ। তারকা থেকে শুরু করে এফডিসির গেটম্যানও এই ক্যান্টিনের খদ্দের। পাশে থাকা একজনকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর এলো, ঘন্টাখানেক আগেই ক্যান্টিন বন্ধ হয়েছে।

সেখানে পাওয়া গেল ক্যান্টিন দেখভাল করার দায়িত্বে থাকা জিহাজ শেখকে(১৭)। কখন ক্যান্টিন বন্ধ হয়েছে জানতে চাইলে জিহাদ জানালো, ৭টার দিকে ক্যান্টিন বন্ধ করে দিছি। কারণ জিজ্ঞেস করলে জিহাদের জবাব, ‘প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার টাকা বিক্রি হয়। আগে ভাত-তরকারি বিক্রি করতাম। এখন লোকই নাই। এফডিসির ভেতরের কয়েকজন লোক যারা সবসময় থাকে, তাদের কাছেই আমাগো ব্যাচাকেনা। এখন শুধু চা-বিড়ি আর ফাস্টফুড আইটেম বেচি। বাইরের লোক আসে না। শুটিংও তেমন হয় না। যেদিন শুটিং হয় সেদিন ব্যাচাকেনা বাড়ে।’

জিহাদের কাছ থেকে জানা গেল ক্যান্টিনের বর্তমান মালিক নৃত্য পরিচালক একে আজাদ। যোগাযোগ করা হলে আজাদ জানান, নিলামের মাধ্যমে তিন বছরের চুক্তিতে ক্যান্টিন পেয়েছেন তিনি। কত টাকা দিয়ে নিয়েছেন প্রশ্ন করলে আজাদ প্রতিবেদককে পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘আপনি নেবেন নাকি ভাই? এটা আমার পুরো লস প্রজেক্ট। আমি ক্যান্টিন ছেড়ে দিতে চাই।’ পরে দুঃখপ্রকাশ করে বলেন, ‘তিন বছর পূর্ণ হলে আমি বাঁচি।’

ক্যান্টিন থেকে আর একটু এগিয়ে মান্না ফ্লোরে দেখা গেল পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। পাশেই দাঁড়ানো তিনজন পুলিশ সদস্য। তাদের সঙ্গে আলাপকালে সুজন ইসলাম নামে এক পুশিল সদস্য ঢাকা টাইমসকে বলেন, এখানে মাঝেমধ্যে ডিউটি থাকে তাদের। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে ডিউটি শুরু হয়েছে। শেষ হবে পরদিন সকাল ৭টায়।

সুজন আরও বলেন, ‘এফডিসিতে ডিউটি পড়লে আমি এর ভেতরে সব জায়গায় ঘুরি। দুই মাস আগে একদিন রাতে শুটিং দেখেছিলাম। কিন্তু কাউরেই চিনি না। ছোটবেলায় শুনতাম, এফডিসিতে গেলে নায়ক-নায়িকা দেখা যায়। মাঝেমধ্যেই এফডিসিতে ডিউটি পড়ে। কিন্তু নায়ক-নায়িকা তো দেখি না।’

পাশেই টিন দিয়ে ঘেরা। ঢুকতেই দেখা গেল সেখানে চলছে বিশাল ভবন নির্মাণের কাজ। দুটি ট্রাক থেকে রড নামানোর কাজে ব্যস্ত ৮-১০ জন লোক। পাশেই নির্মাণ কাজে ব্যস্ত বহু শ্রমিক। তিন মাস আগে শুরু হয়েছে এ কাজ। সেখানে কথা হয় লেবার কন্ট্রাকটর সোহেল খানের সঙ্গে। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘তিন মাস ধরে এই প্রজেক্টের কাজ চলছে। বর্তমানে নিচের ছাদ নির্মাণের কাজ চলছে। মাটির নিচে তিন তলা আন্ডারগ্রাউন্ড হবে।’

কত কোটি টাকার প্রজেক্ট? সোহেল বলেন, ‘এ বিষয়টি আমি বলতে পারব না। এই কাজের কন্ট্রাক্ট নিয়েছে ‘বিশ্বাস ট্রেডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন’। টাকার অংকটা তারা বলতে পারবে।’

কিন্তু একসময়ের কোলাহলপূর্ণ এফডিসি বর্তমানে এমন নিস্তব্ধ কেন? এ প্রসঙ্গে কথা হয় প্রবীণ চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর সঙ্গে। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘পরিচালক-প্রযোজক বলো আর নায়ক-নায়িকা, কেউ আর এখন সিনেমা বানানোর ধান্দায় থাকে না। সবার ধান্দা এখন বিভিন্ন সমিতির নেতা হওয়া। তাই এফডিসি তো ফাঁকা থাকবেই।’

ঝন্টু আরও বলেন, ‘আমরা সিনেমা বানিয়েছি, নায়ক-নায়িকাদের এফডিসিতে ডেকে এনে এখানে আলোচনা করেছি। কাজ ছাড়াও সবাই এফডিসিতে ঘোরাফেরা করতাম প্রতিদিন। আর এখন শুটিং হয় এফডিসির বাইরে। কাজের বাইরে সবাই সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে ব্যস্ত। এফডিসিতে আসার কারও সময় নাই। এসব নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগে না। এসব আর আমারে জিজ্ঞেস কইরেন না তো।’

তবে এফডিসির ভেতরে যে কর্মযজ্ঞ চলছে সেটা শেষ হলেও আবারও এখানে নিয়মিত সিনেমার শুটিং হবে, নায়ক-নায়িকা, পরিচালক-প্রযোজকদের আড্ডা হবে, কোলাহলপূর্ণ হয়ে উঠবে চলচ্চিত্রের আঁতুর ঘর। এমনটাই মনে করছেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট অনেকে। সত্যি কি এফডিসি ফিরে পাবে তার হারানো জৌলস? উত্তর মিলবে সময় হলেই। সেই সময়ের অপেক্ষায় সবাই।

(ঢাকা টাইমস/১০ আগস্ট/এএইচ)