জ্বালানি তেলের সংকট কতটা গভীর?

প্রকাশ | ১২ আগস্ট ২০২২, ০৭:৫০ | আপডেট: ১২ আগস্ট ২০২২, ০৭:৫৫

ওমর ফারুক, ঢাকাটাইমস

দেশে জ্বালানি তেলের মজুদ নিয়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) দেয়া তথ্যে জনমনে নানা ধরনের প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। বুধবার বিপিসি চেয়ারম্যান জানিয়েছিলেন, দেশে ৩০ দিনের জ্বালানি তেলের মজুদ আছে। সে কারণে প্রশ্নটি সামনে আসে- আদতে তেলের মজুদ কত এবং মজুদ শেষ হলে এরপর কী হবে?

মানুষ যেন জ্বালানি তেলসংক্রান্ত তথ্যবিভ্রান্তিতে না পড়েন, সেজন্য তাদের সঠিক তথ্য দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকেও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, জ্বালানি তেলের মূল্যের বিষয়ে পরিষ্কার তথ্য দিতে হবে।

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিসহ আর্থিক নানা চাপে মানুষ অনেকটা দিশেহারা। কোনো দুঃসংবাদই মানুষ আর নিতে পারছে না। এমন বাস্তবতায় গতকাল বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদের সঙ্গে কথা হয় ঢাকাটাইমসের। তিনি জানান, তেল সংকটের কোনো আশঙ্কা নেই, কারণ তেলের আমদানি প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

তেলের আমদানি একটি সাইক্লিং প্রক্রিয়া- এ কথা উল্লেখ করে এর ব্যাখ্যাও দেন বিপিসি চেয়ারম্যান। বলেন, ‘এখন যদি আগামী ৩০ দিনের মজুদ থাকে, মাসের মাঝামাঝি সময়ে আমদানিকৃত তেল এসে মজুদ পূর্ণ করে দেবে। অর্থাৎ আমদানি প্রক্রিয়া সর্বদা চলমান। বিপিসি টেন্ডারের মাধ্যমে বছরে দুটো চুক্তি করে। ছয় মাসের সময়সীমায় বর্তমানে আমরা তেল কিনছি ভিটল এশিয়া থেকে।’

দেশের ডিপোগুলোর মোট তেল ধারণক্ষমতা চল্লিশ দিনের বলে জানান এ বি এম আজাদ। বলেন, সেটা ৩০ দিনে নেমে এলে আতঙ্কিত হবার কিছু নেই। কারণ আমদানি অর্ডার করা আছে। মূল সংকট হলো ডলারের। আমার টাকা দিয়েও ব্যাংক থেকে যথেষ্ট পরিমাণ ডলার পাচ্ছি না। ফলে অর্ডার সম্পূর্ণ করতে ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে।’

বিপিসির ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে বছরে মোট জ্বালানি তেল ব্যবহার হয়েছিল ৫৫.০৩ লাখ মেট্রিক টন।

ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৭৩.১১ শতাংশ ছিল ডিজেল, পেট্রোলের ব্যবহার ছিল ৫.৮৬ শতাংশ আর অকটেন ব্যবহার হয়েছে ৪.৭৮ ভাগ।

২০২১-২২ সালে মোট জ্বালানি তেলের চাহিদা ছিল প্রায় ৭০ লাখ মেট্রিক টন, যার মধ্যে অকটেনের ব্যবহার ছিল ৩ লক্ষ ৩৯ হাজার ৬০২ মেট্রিক টন, আর পেট্রোলের ব্যবহার ছিল ৪ লক্ষ ৪৬ হাজার মেট্রিক টন।

বিপিসির সূত্র অনুযায়ী, মোট জ্বালানি তেলের ব্যবহার প্রতিবছর কিছুটা বৃদ্ধি পায়। জ্বালানি তেলের বার্ষিক ব্যবহারের পরিমাণই জ্বালানি তেলের চাহিদা হিসেবে বিবেচিত হয়।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন সূত্র বলছে, বাংলাদেশে বছরে অকটেনের চাহিদা থাকে তিন থেকে সাড়ে তিন লক্ষ মেট্রিক টন, আর পেট্রোলের চাহিদা থাকে চার থেকে সাড়ে চার লক্ষ মেট্রিক টন।

এই জ্বালানি তেলের মধ্যে বাংলাদেশ পেট্রোল আমদানি না করলেও বিপিসি'র তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের বাৎসরিক অকটেনের চাহিদার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বাংলাদেশ আমদানি করে থাকে।

বার্ষিক চাহিদার কী পরিমাণ অকটেন আমদানি করতে হয়, সে সম্পর্কে তথ্য পাওয়া না গেলেও বিপিসির ওয়েবসাইটে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালের মার্চ মাসে সংস্থাটি ৫১ হাজার ৮৬ মেট্রিক টন অকটেন আমদানি করে। ফেব্রুয়ারি মাসে এই আমদানির পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ৯১৩ মেট্রিক টন।

আমদানির পাশাপাশি, বাংলাদেশের ভেতরে গ্যাস উত্তোলনের সময় গ্যাসক্ষেত্র থেকে পাওয়া উপজাত বা 'কনডেনসেট' থেকেও স্থানীয়ভাবে অকটেন উৎপাদন করা হয়ে থাকে।

গত ৫ আগস্ট রাতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়, ডিজেল ও কেরোসিনের প্রতি লিটারের দাম ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, পেট্রোল ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা এবং অকটেন ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ওই দিন মধ্যরাত থেকে নতুন দর কার্যকর করা হয়।

এরপর থেকেই বাস, ট্রাক, অ্যাপের প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল, লঞ্চ ও হিউম্যান হলারের ভাড়া বেড়ে যায়। বেড়েছে চাল, আটা, ডাল, শাকসবজি, মাছ, মাংসসহ সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলে অর্থনীতি ও জনজীবনে যে প্রভাব পড়ে সেটার রেশ শেষ হতে ৯ মাস লেগে যায়। ফলে আগামী ৯ মাস দেশে মূল্যস্ম্ফীতির চাপ থাকবে। এর সঙ্গে জড়িত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও। এজন্য আগামী দিনগুলো কেমন যাবে তা মূল্যায়নে যুক্তরাষ্ট্রে সুদহার বাড়ানো, রাশিয়া-ইউক্রেনের চলমান পরিস্থিতির সঙ্গে চীন-তাইওয়ানের মধ্যকার উত্তেজনাও বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে ডলারের উচ্চ দর। এখন সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে ডলারের উচ্চ দর নিয়ন্ত্রণে।

অর্থ বিভাগের তথ্যমতে,  আগস্ট শেষে মূল্যস্ম্ফীতি বেড়ে ছাড়িয়ে যাবে ৮ শতাংশ।  যা পরে কিছুটা কমে আসতে পারে। তবে অর্থবছর শেষে ১২ মাসের গড় হিসাবে সাড়ে ৭ শতাংশের বেশি থাকবে মূল্যস্ম্ফীতি। সামগ্রিক পরিস্থিতিতে সরকার এই অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেশি জোর দিচ্ছে। উচ্চ মূল্যস্ম্ফীতি হলে প্রবৃদ্ধি কম হবে এমন ধরে নিয়েই এগোচ্ছে সরকার।

(ঢাকাটাইমস/১২আগস্ট/মোআ)