বৃহস্পতিবার ঠিক কী হয়েছিল দুদকে? পারটেক্সের রাসেলকে নিয়ে তুলকালামই বা কেন? মুচলেকা কি কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা?

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১২ আগস্ট ২০২২, ২০:৪৩ | প্রকাশিত : ১২ আগস্ট ২০২২, ১৯:৩৫

বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার কাছাকাছি সময়। সেগুনবাগিচায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয়ে প্রধান ফটকের নিরাপত্তারক্ষীর বাধা উপেক্ষা করে একটি গাড়ি বেপরোয়াভাবে ঢুকে পড়ে ভেতরে। এমন ঘটনা আর কখনো ঘটেনি দুদকের আঙিনায়। এরপর বাধে তুলকালাম।

কে সেই গাড়িওয়ালা? জোর করে ঢুকেই শুধু ক্ষান্ত হননি, যে দুদকের ভয়ে কম্পমান রথি-মহারথিরা, সেই সংস্থার একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে অসদাচরণ করেন, শার্টের কলার চেপে ধরেন কারও। সঙ্গে গালিগালাজ। একসময় দুদক ভবনের অভ্যর্থনা অংশে গিয়ে সিগারেট ধরিয়ে টানতে থাকেন তিনি। মদ্যপও নাকি ছিলেন সেই সুদর্শন ব্যক্তিটি।

স্বয়ং দুদক কার্যালয়ে বহিরাগত কেউ এমন কাণ্ড ঘটাতে পারে, দেখে-শুনে বিস্মিত সবাই। তারা আরও বিস্মিত, এমন শৃঙ্খলাবিরোধী আচরণ এবং সরকারি কর্তব্যকাজে বাধা দিয়ে কেবল মুচলেকায় পার পেয়ে গেছেন মানুষটি।

ঘটনার আকস্মিকতায় দুদকের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা লোকজন প্রথমে তাকে চিনতে না পারলেও, পরে জানা গেলে তিনি পারটেক্স গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আম্বার গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক শওকত আজিজ রাসেল। তার বিরুদ্ধে নানা আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়ায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে দুদকে তলব করা হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে নারী কেলেংকারি, ব্যাংক ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীর পরিবারকে পুনর্বাসনসহ নানান অনৈতিক কাজের জন্য সমালোচনায় ছিলেন আম্বার গ্রুপের এই চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এবার সামনে এলেন একাধিক দুদক কর্মকর্তা-কর্মচারীর ওপর চড়াও হওয়ার ঘটনায়।

স্বয়ং দুদক কার্যালয়ে এসে কোনো অভিযুক্তের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে বিস্মিত দুদকের প্রধান আইনজীবী খুরশিদ আলম খান ঢাকাটাইমসকে বলেন, কমিশন চাইলে তার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাবিরোধী আচরণ এবং সরকারি কর্তব্যকাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আনতে পারে।

আর দুদক কমিশনার (তদন্ত) জহুরুল হক বলেন, অসদাচরণের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বলতে তাকে আটকে রাখা হয়েছিল, পরে মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে কমিশনের সামনে কেউ অসদাচরণ করলে তার জন্য এক ধরনের ব্যবস্থা থাকতে পারে বলে জানান তিনি।

কী ঘটেছিল সেদিন

বৃহস্পতিবার সকালে দুদক প্রধান কার্যালয়ের সামনে আম্বার গ্রুপের চেয়ারম্যান রাসেলের হাতে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনার আদ্যোপান্ত ঢাকাটাইমসের কাছে তুলে ধরেন দুদকের একজন কর্মকর্তা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা জানান, দুদক কার্যালয়ে ভেতর বহিরাগত কারও গাড়ি প্রবেশের নিয়ম নেই। খুব প্রয়োজন হলে কমিশনের অনুমতি নিতে হয় আগে।

দুদক কর্মকর্তা বলেন, সেদিন সকালে আম্বার গ্রুপের চেয়ারম্যান রাসেল গাড়ি নিয়ে বেপরোয়াভাবে প্রধান কার্যালয়ে ঢুকে পড়েন। ফটকের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একাধিক কর্মকর্তা তাকে বাধা দিলেও তিনি তা মানেনি। তিনি তখন মদ্যপ ছিলেন। যে কারণে গেট থেকে সবাই তাকে বাধা দিতে ভেতরে ছুটে যান। কিন্তু তাতেও খুব একটা কাজ হয়নি।

দুদকের ওই কর্মকর্তা জানান, তাকে আটকাতে দুদকের সহকারী পরিচালক রাকিবুল হায়াত ছুটে যান। সেখানে গিয়ে তাকে বাধা দিলে তিনি কারো বাধাই মানতে রাজি হননি। একপর্যায়ে দুদক ভবনের সামনের অভ্যর্থনা অংশে সিগারেট ধরিয়ে টানতে থাকেন রাসেল। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একজন কর্মী তাকে সিগারেট না খেতে বারণ করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে রাসেল তাকে গালিগালাজ শুরু করেন।

ঘটনার আকস্মিকতা বর্ণনা করতে গিয়ে দুদকের কর্মকর্তা বলেন, বহিরাগত কারো গাড়ি নিয়ে কমিশন কার্যালয়ে প্রবেশ নিষেধ, এ কথা শুনে উত্তেজিত শওকত আজিজ রাসেল দুদকের এক কর্মচারীর শার্টের কলার চেপে ধরেন।

এ ঘটনায় হতবিহ্বল কমিশনের সহকারী পরিচালক রাকিবুল হায়াত ঘটনার প্রতিবাদ করেন। উত্তেজিত রাসেল দুদকের এই কর্মকর্তাকেও ধাক্কা মেরে লাঞ্ছিত করেন। এ সময় শওকত আজিজ রাসেলের স্ত্রী ও পরিবারের কয়েকজন সদস্য এগিয়ে আসেন। তাদের সহযোগিতায় রাসেলকে দুদকের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়।

দুদকের অভিযোগ অনুসন্ধান-সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, পরে দুদকের উপপরিচালক আলী আকবর গিয়ে শওকত আজিজ রাসেলকে কমিশন কার্যালয়ের অভ্যর্থনা কক্ষে নিয়ে যান। এরপর তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদকের জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বিকাল চারটা পর্যন্ত তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

পারটেক্সের মতো দেশের বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর কর্ণধারের এমন অশালীন ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে শুধু দুদক নয় বিস্মিত হয়েছে অনেক বিশিষ্টজন ও ব্যবসায়ী। তার এমন আচরণের নিন্দাও জানিয়েছেন তারা।

বৃহস্পতিবার দুদক কার্যালয়ে শওকত আজিজ রাসেল।

দুদকের মতো একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে কোনো ব্যক্তির এমন আচরণ শুধু নিন্দা বা মুচলেকাতে শেষ হলে অন্যদের জন্য এটা বাজে মেসেজ হিসেবে গণ্য হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাই এই ধরনের অপরাধের জন্য তার যথোপযুক্ত বিচার হওয়া উচিত বলে মনে করেন তারা।

কী বলছেন দুদক সংশ্লিষ্টরা

এক প্রশ্নের জবাবে দুদক সচিব বলেন, ‘এটা একটা সরকারি অফিস, তাই সবার কাছে মার্জিত ব্যবহার প্রত্যাশা করি। কিন্তু এই ধরনের ব্যবহার (রাসেলের) অপ্রত্যাশিত।’

দুদক কমিশনার (তদন্ত) জহুরুল হক বলেন, তার অসদাচরণের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বলতে তাকে আটকে রাখা হয়েছিল, পরে মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

কমিশনের সামনে একজন লোক অসদাচরণ করলে বা সেটার জন্য এক ধরনের ব্যবস্থা থাকতে পারে, তবে কমিশনের যে প্রসিডিউরাল অনুসন্ধান- তদন্ত, তার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।

দুদকের প্রধান আইনজীবী খুরশিদ আলম খান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘দুদকে এমন ঘটনা আগে আর কোনোদিন শুনিনি। কমিশন চাইলে তার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাবিরোধী আচরণ এবং সরকারি কর্তব্যকাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আনতে পারে।

রাসেলের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

অনুসন্ধান-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র ঢাকাটাইমসকে জানায়, আম্বারের চেয়ারম্যান রাসেল ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালক থাকার সময় কবির এন্টারপ্রাইজ ও অন্য আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে ১৩০ কোটি টাকা ঋণ দেন। ঋণের ওই টাকা খেলাপি হয়ে গেছে। অভিযোগ রয়েছে রাসেল ও তার সহযোগীরা এই অর্থ তছরুপের সঙ্গে জড়িত।

এই ঋণের বিষয়ে ইতিমধ্যে ইউনাইটেড কমার্র্শিয়াল ব্যাংকের এমডি শাহাজাহান ভূইয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আরও পাঁচ থেকে সাতজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলেও জানায় সূত্রটি।

দুদকের অনুসন্ধান-সংশ্লিষ্ট অন্য একটি সূত্র ঢাকাটাইমসকে জানায়, রাসেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালক থাকা অবস্থায় তিনি ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন। এছাড়া বিভিন্ন ব্যংকে তাদের চার হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে রাসেল এসব প্রশ্নের মুখে পড়েছেন।

গেল জুন মাসের শেষ দিকে পারটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এম এ হাশেমের পাঁচ ছেলে ও তাদের পরিবারের সদস্যদের পাঁচ বছরের ব্যাংক লেনদেনের তথ্য চেয়ে চিঠি দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সংস্থাটির সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি) থেকে দেশের ব্যাংকগুলোকে এ-সংক্রান্ত চিঠি দেয়া হয়।

পারটেক্স দেশের অন্যতম শিল্পগৌষ্ঠী। এই গ্রুপটিরই অনেকে কয়েকটি অভিজাত ও সামাজিক ক্লাবে নেতৃত্বে আছেন। তবে অভিযোগ রয়েছে, ক্লাবিংয়ের আড়ালে তারা নানা ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত।

একাধিক গোয়েন্দা সূত্র জানায়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনি কর্নেল খন্দকার আবদুর রশিদের মেয়ে মেহনাজ রশিদের সঙ্গেও শওকত আজিজ রাসেল ও তার ভাইদের গভীর সখ্য রয়েছে।

রাসেলের যত নারী কেলেংকারি

কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) এক নেত্রীর সঙ্গে রাসেলের অন্তরঙ্গ ছবি নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয়। তবে নিজের এই ছবি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হলেও মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন তিনি।

গত জুনে ঢাকা টাইমসের হাতে আসে একটি ভিডিও ক্লিপ। সেখানে দেখা যায়, দেশের অন্যতম শিল্পগ্রুপটির কর্ণধারদের তিনজন মদ্যপ অবস্থায় নাচানাচি করছেন। তাদের সঙ্গে বেশ পরিচিত একজন গায়িকাও ছিলেন।

কথিত আছে, শিল্পপ্রতিষ্ঠানটির কর্ণধাররা ক্লাবপাড়া ছাড়াও বিভিন্ন সময় উঠতি বয়সী তরুণীদের সঙ্গে ফূর্তিতে মাতেন। তবে ওই ভিডিওতে দেখা যাওয়া গায়িকার দাবি, তাকে গান গাইতে সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ব্যবসায়ীরা মদপান করছিলেন। কিন্তু তিনি এসবের সঙ্গে ছিলেন না।

ভিডিওর দৃশ্যে দেখা গেছে, একটি ফ্ল্যাটে স্বল্প লাইটের আলোতে চারজন ব্যক্তি বসে আছেন। একজনের হাতে গ্লাস। পাশে টেবিলে রাখা আছে নামিদামি বিভিন্ন ব্রাণ্ডের মদের বোতল। যেখানে দেশের আলোচিত গায়িকা খালি কণ্ঠে গান করছেন। বসে থাকা চারজনের মধ্যে তিনজন ওই শিল্পগ্রুপের কর্ণধার। গায়িকার গানের তালে তারা ফূর্তিতে মাতোয়ারা। ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবে রাসেলে বেশ কিছু আপত্তিকর ভিডিও ইতিমধ্যেই নেটিজেনদের কাছে খুবই পরিচিতি। ঢাকার অভিজাত ক্লাবে বিভিন্ন সময়ে প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় রাসেল গায়িকা বা ডান্সারকে জড়িয়ে ধরের এমন নাচের দৃশ্য এখন নেটে অহরহ দেখা যায়অ। রাসেলের সঙ্গে বহু নারীর সখ্য ও ঘনিষ্ঠতার বিষয় অনেকটাই ওপেন সিক্রেট, সম্প্রতি দুদক-কাণ্ড যেন তার পুরনো বিতর্ককেই আবার সামনে নিয়ে এসেছে।

(ঢাকাটাইমস/১২আগস্ট/এসআর/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :