টিপু হত্যার সব তথ্য মিলেছে
মতিঝিল নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় একাধিক গ্রুপ
বৃহত্তর মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যার ঘটনায় কারা জড়িত, কী কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে- এসব বিষয় নিয়ে চার মাসের তদন্তের পরে একটি পর্যায়ে এসেছে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। তারা বলছেন, হত্যাকাণ্ডের সব তথ্য উদ্ঘাটন শেষ দিকে। অপেক্ষা মোল্লা শামীমকে গ্রেপ্তারের।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়, কোথায় বসে পরিকল্পনা হয়- সব তথ্য মিলেছে। হত্যাকাণ্ডের পিছনে মতিঝিল এলাকার চাঁদার দ্বন্দ্বই মূলত আলোচনায় আছে।
গোয়েন্দারা বলছেন, জিসানের হয়ে কাজ করা খালিদ ক্যাসিনো কাণ্ডে ফেঁসে যাওয়ার পরে সম্রাটও গ্রেপ্তার হন। পরে পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রণ চলে আসে টিপুর হাতে। কিন্তু টিপু সামনে নির্বাচন করার জন্য অবস্থান পরিষ্কার করতে চাঁদাবাজি কিংবা টেন্ডার বাণিজ্য থেকে একটু দূরেই ছিলেন। এতে করে বিরোধী (এন্টি) গ্রুপ সুবিধা করতে পারছিলেন না।
অবশেষে আন্ডার ওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসী ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা পরস্পর যোগসাজশ করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটায। এলাকার পরিস্থিতি বর্তমানে স্বাভাবিক থাকলেও নিয়ন্ত্রণে নিতে কয়েকটি গ্রুপ কাজ করছে। তবে চাঁদা ও টেন্ডার বাণিজ্যের মোট অঙ্কের অর্থ পাঠাতে হবে আন্ডার ওয়ার্ল্ডের কাছে।
ওই ঘটনায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের নাম উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা করেন তার স্ত্রী ফারজানা ইসলাম ডলি। টিপু কিলিং মিশনে অংশ নেয়া শুটার মাসুম মোহাম্মদ আকাশকে ঘটনার দুদিন পরে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। আকাশকে গ্রেপ্তারের পরে হত্যাকাণ্ডের তদন্ত নতুন মোড় নেয়। আকাশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে অনেকটা পরিষ্কার হন গোয়েন্দারা। তবে সংস্থাটি এই হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত কোনো আলামাত উদ্ধার করতে না পারায় জটিলতা দেখা দেয়।
এ বিষয়ে গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, খুব অল্প সময়ে আলামতসহ আকাশকে মোটরসাইকেলে বহনকারী মোল্লা শামীমকে গ্রেপ্তার করতে পারব। তাকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
দুই কোটি টাকার চুক্তিতে জাহিদুল ইসলাম টিপুকে খুন করার পরিকল্পনা করা হয়। ‘কিলিং মিশন’শেষ হলে নগদ দেয়া হবে ১৫ লাখ টাকা আর পর্যায়ক্রমে এ টাকা পরিশোধ করা হবে এবং এই টাকার বিরাট অংশ শোধ করা হবে টেন্ডারবাজির কমিশন থেকে- এরকম চুক্তি ছিল। টিপু হত্যাকাণ্ডের সময় তাকে বহন করা মাইক্রোবাসের পিছনের সিটে বসেছিলেন বোচা বাবুর বাবা আবুল কালাম। তিনি টিপুর ঘনিষ্ট বন্ধু।
এদিকে টিপু হত্যাকাণ্ডের পর ঘটনাস্থল থেকে সংগ্রহ করা আলামত পরীক্ষা-নীরিক্ষা করছে সিআইডির ক্রাইম সিন। সংগৃহীত আলামত পর্যালোচনা করে একজন কর্মকর্তা বলেছেন, এই খুনে ঘাতক নাইনএমএম (৯এমএম) পিস্তল ব্যবহার করে। সেভেন পয়েন্ট সিক্স ফাইভ (৭.৬৫) ক্যালিভারের পিস্তলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ১৫টি গুলি করা যায়। ঘটনাস্থলের পাশের একটি ভবনের সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ গোয়েন্দারা পর্যবেক্ষণ করছেন। হত্যায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি শনাক্ত করেছে গোয়েন্দা সংস্থা।
স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা বলছেন, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, রেলওয়ে, রাজউক, গণপূর্ত, কমলাপুর আইসিডি ও বিদ্যুৎ ভবনের টেন্ডারবাজির একক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে টিপুর সঙ্গে একটি বড় গ্রুপের দ্বন্দ্ব হয়। এই গ্রুপটি হচ্ছে ২০১৩ সালের ২৯ জুলাই গুলশানে ‘শপার্স ওয়ার্ল্ড’বিপণী বিতানের সামনে খুন হওয়া যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজুল হক খান মিলকীর গ্রুপ। মিলকী হত্যা মামলার চার্জশিটে ১০ নম্বর আসামি জাহিদুল ইসলাম টিপুর নাম বাদ দেয়া হয়। চার্জশিটে যুবলীগ নেতা মারুফ রেজা সাগর ওরফে পানি সাগরের নামও বাদ দিয়ে তার স্ত্রী ফাহিমা ইসলাম লোপার নাম দেয়া হয়। মিলকী গ্রুপের প্রধান শেল্টারদাতা দুবাইয়ে আত্মগোপন করা তেইশ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অন্যতম জিসান আহমেদ মন্টি ওরফে জিসান। টিপুর প্রতিপক্ষ জিসানের কিলার গ্রুপ দিয়ে ‘কিলিং মিশনটি সম্পন্ন করায়। কিলিং মিশন সম্পন্ন করার পর পর্যায়ক্রমে ২ কোটি টাকা জিসানের কাছে পৌঁছে যাওয়ার কথা।
অন্যদিকে, টিপু খুনের পর মতিঝিল, পল্টন, শাহজাহানপুর ও খিলগাঁও এলাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের বিভিন্ন গ্রুপে থমথমে অবস্থান বিরাজ করছে। টিপু খুনের পর বিশাল এলাকার হাজার হাজার কোটি টাকার টেন্ডারবাজির কমিশন কার হাতে যাবে-তা নিয়ে চলছে গোপন আলোচনা। বিদেশ থেকে বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে কথোপকথন চলছে। এদিকে, স্বামী টিপু হত্যার পর অজানা আতংকে ভুগছেন সংরক্ষিত মহিলা আসনের কাউন্সিলর ফারহানা ইসলাম ডলি।
রাজধানীর শাহজাহানপুর গত ২৪ মার্চ রাতে মোটরসাইকেলে আসা এক দুর্বৃত্ত যানজটে আটকে পড়া টিপুর গাড়ির কাছে এসে তাকে গুলি করেন। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান টিপু। ওই সময় টিপুর গাড়ির পাশে থাকা রিকশা আরোহী কলেজছাত্রী সামিয়া আফনান প্রীতিও গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
ঘটনার দুদিন পরে ২৬ মার্চ রাতে বগুড়া থেকে মাসুম মোহাম্মদ ওরফে আকাশ নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। ডিবির পক্ষ থেকে বলা হয়, এই ব্যক্তিই টিপুকে গুলি করেছিলেন। পরে কমলাপুর থেকে আরফান উল্লাহ দামাল নামে আরও একজনকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয়। বলা হয়, টিপু হত্যার পরিকল্পনা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন দামাল। এরপর ২ এপ্রিল মুসার ভাই সালেহ শিকদার ওরফে শুটার সালেহ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের ১০নং ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক, নাসির উদ্দিন ওরফে কিলার নাসির ও মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্লা পলাশকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। সর্বশেষ মাহাবুবুর রহমান (টিটু), জুবের আলম খান (রবিন), আরিফুর রহমান (সোহেল) ও খাইরুল ইসলামসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি।
ডিবি সূত্র জানায়, টিপু হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে গিয়ে এ পর্যন্ত যে ২২ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে আগে থেকেই কোনো না কোনো অপরাধে জড়িত থাকার তথ্য রয়েছে। মতিঝিল এলাকার আধিপত্য, টেন্ডারবাজি ও রাজনৈতিক পদ-পদবি নিয়ন্ত্রণের জন্য টিপুকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।
টিপু হত্যাকাণ্ডে সর্বশেষ রাতে নতুন করে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের মধ্যে মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাবেক সেক্রেটারি সোহেল শাহরিয়ার, ১০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি মারুফ রেজা সাগর, একই ওয়ার্ডের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আরিফুর রহমান সোহেল ওরফে ঘাতক সোহেল, মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান টিটু, মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক খায়রুল আলম ও এই হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার হওয়া জাতীয় পার্টির নেতা জুবায়ের আলম রবিন কমলাপুর এলাকার প্রগতি সংঘের সভাপতি। টিপুকে হত্যার আগে ওই ক্লাবেই বৈঠক হয়েছিল বলে তথ্য আছে গোয়েন্দা সংস্থার কাছে।
তদন্তকারীদের ভাষ্য, মুসা ‘রাজনীতি ও অপরাধজগতের মধ্যে যোগসূত্র’হিসেবে কাজ করে আসছিলেন। ঢাকা ও দুবাইয়ের অপরাধজগতের মধ্যেও সংযোগের সমন্বয় করতেন তিনি। হত্যাকাণ্ডের ১২ দিন আগেই মুসা দুবাই চলে যান। হত্যা পরিকল্পনা ও নির্দেশনা সেখান থেকেই দেওয়া হয়। হত্যাকাণ্ডের পর দুবাইতে বার্তা যায়, ‘কাজ শেষ।
নিহত টিপুর স্ত্রী সংরক্ষিত মহিলা আসনের কাউন্সিলর ফারহানা ইসলাম ডলি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ঢাকা মহানগর পুলিশ যে কাজ করছে, তাতে আমি সংস্থাকে ধন্যবাদ জানাই। মুসাকে দেশে আনার পরে অনেক কিছু বের হয়েছে। সেটার পরে অনেককে গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু এখনও আমার শঙ্কা রয়ে গেছে। নির্দেশ যারা দিল তারা তো ধরা পড়ল না। এছাড়া অস্ত্র ও মোটরসাইকেল উদ্ধার না হলে আমার জীবনের ঝুঁকি থেকে যায়।
কারাগারে আসামিরা-
রিমান্ড শেষে এই হত্যা মামলার ২২ জন আসামি সবাই কারাগারে আছেন। গ্রেপ্তাররা হলেন- শুটার আকাশ, পরিকল্পনাকারী মুসা ও তাদের সহযোগী আরফান উল্লাহ দামাল, মুসার ভাই আবু সালেহ শিকদার ওরফে শুটার সালেহ, ওমর ফারুক, নাসির উদ্দিন ওরফে কিলার নাসির, মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্লা পলাশ, মাহাবুবুর রহমান (টিটু), জুবের আলম খান (রবিন), আরিফুর রহমান (সোহেল), খাইরুল ইসলাম, মারুফ খান, মশিউর রহমান, ইলিয়াস আরাফাত সৈকত, সেকান্দার সিকদার, হাফিজুল ইসলাম, সোহেল শাহরিয়ার ওরফে শটগান সোহেল, মারুফ রেজা সাগরসহ আরও কয়জন।
ঢাকাটাইমস/১৪আগস্ট/এফএ