সেই সব দিনের কিছু স্মৃতি

প্রকাশ | ১৫ আগস্ট ২০২২, ১৩:৫১

ড. সনজীদা খাতুন

উনসত্তর সালের এক দ্বিপ্রহরে ইডেন কলেজের বেয়ারা জাবেদ আলী ধেয়ে এল, ‘প্রিন্সিপাল আপায় ডাকে’। বেলা আড়াইটা-তিনটা হবে, কলেজে ক্লাস সেরে এসে খাওয়াদাওয়া করে বিশ্রাম করছি দ্রুত তৈরি হয়ে ছুটলাম কলেজে। প্রিন্সিপালের ঘরে ঢুকবার মুখে বাংলার খোদেজা আপার সঙ্গে দেখা, আমাকে ধরে ফেললেন। ইশারার সঙ্গে ফিসফিস করে বললেন, যেয়ো না। এই দেরিটুকু হওয়াতে ভেতর দিকের দরজা দিয়ে ততক্ষণে প্রিন্সিপাল জেবুন্নেসা রহমান বেরিয়ে পড়েন। নিজের কোয়ার্টারের দিকে রওনা হয়েছেন। খোদেজা আপা বললেন, বেঁচে গেলে! ওর রাগের মুখে পড়লে অকথ্য সব শুনতে হতো।

ব্যাপারখানা কী? শুনলাম কলেজে মেয়েরা নটীর পূজা করছিল। হঠাৎ প্রিন্সিপাল গিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে অনিয়ম বন্ধ করে দিয়েছেন। তাঁর কাছে কোনো গার্জিয়ান নাকি চিঠি দিয়েছে যে ছাত্রীরা ঘণ্টা বাজিয়ে পূজা করছে ওই নাটকে। টেলিফোনও এসেছে এই নিয়ে। হলে গিয়ে তিনি চিৎকার করেছেন, কে এসব করাচ্ছে জানি না? শান্তিনিকেতন থেকে সব বুদ্ধি আসছে। তারপরেই ‘ডাকো সন্্জীদাকে’ ঘটনা।

ওই সময়টাতে খুব উল্টোপাল্টা হাওয়া বইছে পাকিস্তানে। মেয়েরা নটীর পূজা করছিল জানতাম। শেষ দিকে একটা গান শিখিয়ে দিতে বলেছিল আমাকেÑসেটি শিখিয়েছি এই পর্যন্ত। নাটক দেখতে যাওয়ার কথাটাও ভাবিনি। কিন্তু শান্তিনিকেতনের ভারতীয় দাগ গায়ে রয়েছে যে আমার। পাকিস্তানের জন্য বড়ই ভয়ের কথা। ব্যাপার তাই অত সহজে মিটল না। কিছুদিনের ভেতরেই আদেশ এল বদলির। রংপুরের কারমাইকেল কলেজে যেতে হবে। পানিশমেন্ট ট্রান্সফার আসলে। ছয় মাস অসুস্থতার সার্টিফিকেট দাখিল করে ছুটিতে রইলাম। শেষে বাই দ্য অর্ডার অব দ্য চিফ সেক্রেটারি এডুকেশন সেক্রেটারির কাছ থেকে আদেশ এল নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে চাকরিস্থলে গিয়ে কাজে যোগ না দিলে কড়া অ্যাকশন নেওয়া হবে।

অগত্যা ছেলেমেয়ে ঘরসংসার ফেলে যেতে হলো রংপুরে। কারমাইকেল কলেজের যে বাড়িতে এক অধ্যাপকের কাছ থেকে চেয়ে নেওয়া একটি ঘরে বাস করতাম। তার পাশেই থাকতেন কেমিস্ট্রির অধ্যাপক কালাচাঁদ রায়। ফুটফুটে এক কন্যাসন্তান তাঁর ঘরে। বড় বড় উজ্জ্বল কালো চোখের তারা আর কোঁকড়া চুলের মাঝখানে ছোট্ট মুখখানি নিয়ে অপরূপা সে। ডাকনামটা বিচ্ছিরিÑমুন্না। ভালো নাম জিজ্ঞেস করলে সপ্রভিত অথচ আধো আধো উচ্চারণে বলত শ্রীমতি ভাচ্ছতি (ভাস্বতী) রায়। ওর মা মঞ্জু একহাতে রান্নাবান্না, কাচাকাচি, ধোয়ামোছা, ঘর পরিষ্কার, মেয়ের দেখাশোনা করত। কাজ শেষে বিকেল বেলা পরিপাটি চুল আঁচড়ে গোড়া বেঁধে দাঁত দিয়ে দড়ি ধরে রেখে বিনুনি করত সামনের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে। ততক্ষণে মেয়ে এক ঘুম দিয়ে উঠে এসেছে। সারা দিন মায়ের সঙ্গে খাওয়া পরা-ঘুম, কিন্তু বিকেলে বাবাকে ফিরতে দেখলে সেই যে তার উল্লাস হাসি হুল্লোড় তার তুলনা হয় না। পাশের অংশের জাহাঙ্গীর সাহেবের বউ ময়না আর আমি মুন্নাকে খেপাতাম। আহ্লাদে ‘বাবা’ ‘বাবা’ ডাকে খানিকটা অ্যা-কারের ভাব লেগে যেত। হতো ‘বাবা ব্যাবা’। বলতাম, ‘আ-হা, ব্যাবা ব্যাবা। সারা দিন মা-ই দেখাশোনা করল এখন ব্যাবা।’

মেয়ে খলখল হাসতে-হাসতে ছুটে এগিয়ে যেত আর বাবা তাকে তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘরে ঢুকতেন।

কালাচাঁদবাবু বাড়ির সামনের দিকের জমিটাতে আলুর চাষ করতেন। কেবি হোস্টেলের গৃহশিক্ষক হিসেবে জমির পরিচর্যা করবার জন্য লোক তাঁর ছিল। শীতের তরিতরকারিও ফলাতেন খুব। কারমাইকেল কলেজের শিক্ষকদের অনেকেই এই সব করতে ভালোবাসতেন। কালাচাঁদবাবু আবার তাঁর রসায়নবিদ্যার দৌলতে নানা রকম সার দিতেন জমিতে, ঘরে এনে রাখতেন সার।

উনসত্তরের মাঝামাঝি কারমাইকেল কলেজে যোগ দিয়ে অপেক্ষায় ছিলাম। শিগগিরই বদলি হয়ে ফিরব ঢাকাতে। কোথায় কী? একটি ঘরে থাকি। তার একদিকে ইতিহাসের জাহাঙ্গীর সাহেবের পরিবার, অন্যদিকে কালাচাঁদ রায় মঞ্জু। আগে এ বাড়ি ছিল কলেজের ভাইস প্রিন্সিপালের। মাঝখানের ঘরটি বৈঠকখানা হিসেবে তৈরি বলে এখনকার দুই পরিবারের ঘরের দিকে আছে দুটি দরজা। আরও চারখানি দরজা রয়েছে সামনের আর পেছনের বারান্দার দিকে দুটি দুটি করে। ছখানা দরজাওয়ালা দিব্যি বড়সড় ঘর। কিন্তু জানালা নেই কোনো। দরজা বন্ধ করে ঘুমাতে হলে বারান্দার দিকের দরজাগুলোর খড়খড়ি খুলে রাখতে হতো কিঞ্চিৎ বাতাস পাবার আশায় ঘরে ফ্যানট্যান নেই কিছুই। গরমের দিনের দুর্দশার কথা বলব আর কাকে, হাতপাখা নেড়ে নেড়ে রাত কাটে। একদিন কালাচাঁদবাবু আমার ঘরে ঢুকে বললেন, এ কী! একটা টেবিল ফ্যান পর্যন্ত নেই। থাকেন কী করে। তাঁদের একটি বাড়তি টেবিল ফ্যান তক্ষুনি বসিয়ে দিয়ে গেলেন টেবিলে। পাশাপাশি বাস, শিশুদের টানেই আত্মীয়তা জন্মে গেল পরস্পর।

এরই মধ্যে অকস্মাৎ পুলিশের লোক এল আমার খোঁজে। ডিভিশনাল ইন্টেলিজেন্স অফিসার ঢাকা থেকে আদেশ পেয়ে কথা বলতে এল। সেটা আসলে এনকোয়ারি। কথার শেষে বলেছিলেন, দেখতে এসেছিলাম সন্্জীদা খাতুনকে। কারণ, আমার নামের ফাইল এত মোটা যে অফিসারকে ঢাকাতে অধিক সময় থেকে ফাইল পড়ে শেষ করতে হয়েছিল। আমার ছেলের নাম পার্থ, হিন্দু নাম। আমার আচার-আচরণ হিন্দু। আমি নাকি সিঁদুর পরি, মূর্তিপূজা করি। নামাজ পড়ি না, ইসলামি নিয়মকানুন মেনে চলি না ইত্যাদি ইত্যাদি। তো ভদ্রলোক দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলে ওসব বিষয়ে আমার বক্তব্য শুনলেন। জাহাঙ্গীর সাহেব সাক্ষ্য দিলেন, তাঁর ছেলেদের স্কুলের আরবি পড়া আমিই পড়িয়ে দিই। আর শুনলেন, উচ্চমাধ্যমিকের বাংলা বইয়ের কিছু প্রবন্ধে যেসব আরবি বাক্যাংশ আছে, সেগুলো আমি আরবির অধ্যাপকদের কাছ থেকে বুঝে নিয়ে ক্লাসে পড়াই। সেসব যা-ই হোক, ভদ্রলোক আমাকে বলে গেলেন, যাতে পাশের হিন্দু পরিবারের সঙ্গে বেশি মেলামেশা না করি। আরও জানালেন আমাকে তিন মাস কাল আন্ডার-সারভেইল্যান্স থাকতে হবে। অর্থাৎ রংপুর থেকে ঢাকায় আসতে হবে এবং ঢাকা থেকে রংপুর যেতে পুলিশকে টেলিফোন করে জানিয়ে যাওয়া-আসা করতে হবে। তারা নজর রাখবেন। ওদিকে ভদ্রলোক কী মনে করে ঢাকায় রিপোর্ট দিলেনÑশি ইজ আ হাইলি রিলিজিয়াস লেডি। ঢাকাতে সে রিপোর্ট পৌঁছুতেই টেলিফোনে ধমক খেলেন ডিআইজি। ‘কে বলেছে রিলিজিয়াস। সে কি নামাজ পড়ে।’ তাঁর দূত ছুটে এসে আমাকে বিশেষ অনুরোধ জানিয়ে গেল যেন দেখিয়ে নামাজ পড়ি। ইসলামে দেখিয়ে নামাজ পড়ার বিধান আছে বলে জানি না। নামাজ দেখানো নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাইনি, তবে কলেজের এক অনুষ্ঠানে ধর্মনিষ্ঠা প্রচার করেছিলাম ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে/মধুচন্দ্রিমারই সেখা চাঁদ দোলে’ গান গেয়ে। কিন্তু পাশের হিন্দুবাড়ির সঙ্গে কম-কম মিশব তার সাধ্য কী! তত দিনে মঞ্জুর আর একটি সন্তান হয়েছে। বসতেও শিখে গেছে। সুমন। ভোরবেলায় যখন গলা সাধি তখন সে-ও নাকি দুলে-দুলে আ আ শুরু করে দেয়। তার মা তাই কাজের ফাঁকে একহাতে ওর ডানা ধরে ঝুলিয়ে এনে বসিয়ে দিয়ে যায় আমার মেঝেতে। আমি আ আ করি, সে-ও দোলে আর কচিকণ্ঠে বলে ‘আ আ’।

আমি যখন খেতে বসি, মুন্না এসে উঁকি দিয়ে দেখে পাতে কী আছে। ডিম ভাজাতে তার লোভ। চোখ চকচক করতে দেখে এঁটো হাতেই ডিম ভেঙে ওর মুখে দিই। একদিন তো ওর মা দেখতে পেয়ে ধুমধাম কটা কিল কষিয়ে ওকে টেনে নিয়ে গেলেন এই রকম ঝাল-মিষ্টি সম্পর্কে সরকারি হুকুমে কী বলে ছেঁটে ফেলি। একাত্তরের দশই মার্চ আমি ঢাকায় চলে এসেছিলাম, শেখ সাহেব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছুটি দিয়েছেন জেনে।

শুনেছি, পঁচিশে মার্চে হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে কালাচাঁদবাবু সপরিবার জাহাঙ্গীর সাহেবের সঙ্গে গিয়ে এঁদের গাইবান্ধার বাড়িতে আশ্রয় নেন। একটি শক্তিশালী ট্রানজিস্টারে কালাচাঁদবাবু বিবিসি আর ভয়েস অব আমেরিকা শুনতেন সব সময় । কলকাতায় নিত্য নক্সালি-হত্যার খবর শুনে প্রায়ই বলতেন, পাকিস্তানেই আমরা ভালো আছি। ফলে কিছুদিনের ভেতরেই তাঁর বিশ্বাস হলো সরকার যখন সবাইকে যার যার কাজে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে, তখন ফিরে গিয়ে কলেজে জয়েন করবার কিছুই অসুবিধা নেই। সুবোধ কালাচাঁদবাবু মঞ্জুদের রেখে চলে গেলেন রংপুরের বাসায়। ওদিকে কদিনের  ভেতরেই মঞ্জু উঠল অস্থির হয়ে, সে-ও যাবে রংপুর শহরে তার স্বামীর কাছে একদিন সেই গাইবান্ধা থেকে রিকশা করেই রওনা হয়ে গেল মঞ্জু কারমাইকেল কলেজ ক্যাম্পাসের উদ্দেশে ভেঙে ভেঙে রিকশা বদল করে করে শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গেল ঠিকানায়। পূর্বের অভ্যস্ত জীবনে বড়ই স্বস্তি।

তারপরের আসলে ঘটনাটি যখন শুনি, তখন আমি ছেলেমেয়েদের নিয়ে কালকাতায় কর্নফিল্ড রোডের এক বাসায় আছি, রাখী চক্রবর্তী এসেছিল দেখা করতে। চলে যাওয়ার সময়ে যখন তাকে এগিয়ে দিতে গেছি তখন হঠাৎ বলল, মঞ্জুর খবর তো জানেন, কলকাতার কাগজেও বেরিয়েছে। বুকে হাত চেপে জিজ্ঞেস করলাম কী? বলল, পড়েননি? ওদের স্বামী-স্ত্রীকে নিয়ে গিয়ে দমদমের ব্রিজের কাছে গুলি করে মেরে পুঁতে রেখেছিল। মঞ্জুর কোমর পর্যন্ত নিচের দিকটা মাটিতে পোঁতা। ঊর্ধ্বাঙ্গে কোনো আবরণ ছিল না। পাশবিক অত্যাচারের পর হত্যা।’ এক মুহূর্তের জন্য জ্ঞান হারিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বালিকা কন্যার ঘাড়ে ঢলে পড়েছিলাম।

দেশে ফিরে শুনলাম, ওরা এসে কালাচাঁদবাবুকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। কারণ, ঘরের ভেতরে কেমিক্যালস (সেই ক্ষেতে ছড়াবার সার) পাওয়া গেছেÑনিশ্চয়ই বোমা তৈরির সরঞ্জাম। মঞ্জু তখন এক বছর বয়সের সুমনের জন্য দুধ ভরে টেবিলে রেখেছে মাত্র। ছুটে গিয়ে পথ আগলে জড়িয়ে ধরেছিল স্বামীকে কিছুতে ছাড়াতে না পেরে তাকে সুদ্ধ জিপে তুলে নিয়ে গিয়েছিল তারা। তাদের দোষ কী? ওপর থেকেই হিন্দু এলিমিনেশনের। পরিষ্কার আদেশ ছিল যে।

পরদিন কার্য শেষ হলে প্রতিবেশী রিয়াজ সাহেবেরা এসে দেখেন ঘরে বাতি জ্বলছে, টেবিলে দুধ-ভরা বোতল, মশারির ভেতরে বসে ঊর্ধ্বস্বরে কাঁদছে মুন্না আর সুমন। স্বাধীনতার পর দাদু তাদের নিয়ে আসার আগপর্যন্ত রিয়াজ সাহেবদেরই আব্বা-আম্মা ডেকে প্রতিপালিত হয়েছে এক বছরের সুমন আর তিন বছরের মুন্না। আর আশ্চর্য, নিহত মঞ্জুর আঙুল থেকে তার সোনার আংটি খুলে রিয়াজ সাহেবদের কাছে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল এক রাখাল। কলেজের অধ্যাপকদের তারা চিনত যে।