বেদনার বেলাভূমি বিদগ্ধ আগস্ট ট্র্যাজেডি

প্রকাশ | ১৫ আগস্ট ২০২২, ১৪:১০ | আপডেট: ১৫ আগস্ট ২০২২, ১৪:১২

আশিকুর রহমান অমি

১৫ই আগস্ট, জাতির বেদনাবিধুর আর্তনাদের এক বিরহের কবিতা৷ যে কবিতার উপসংহারে ভুলুন্ঠিত হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে অর্জিত বীরত্বের ইতিকথা, যার উপসংহার ম্লাণ করে দিয়েছিল বাঙালি জাতির স্বপ্নের বুনিয়াদ, আচ্ছন্ন করেছিল বাঙালি জাতিকে আধাঁরে আড়ষ্ট ঘনঘটায়। আগস্ট ট্র‍্যাজেডিকে যদি কোন অবয়বে রূপান্তরিত করা হয়, তাহলে হয়তো পুরো বিশ্ব ব্রক্ষ্মান্ড বেদনার পাহাড়ে চিরকালের জন্য আচ্ছাদিত হয়ে রইবে। আগস্ট শোকের আবহ বাংলার হাজার বছরের গ্লাণি, দুঃখ, জ্বরা, ভ্রমকেও হার মানিয়ে জগদ্দল পাথরের মতো অসার হয়ে বাংলার বুকে চেপে রয়েছে।

বাঙালি জাতি-রাষ্ট্রের পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু বাঙালি জাতির নয়, বিশ্বের শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত, শৃঙ্খলিত ও দুঃখী মানুষের কণ্ঠস্বর ও মুক্তির বিমূর্ত  প্রতীক। সে কারণে তার হত্যাকাণ্ডের ক্যানভাস বিশালভাবে ব্যপৃত ও বিস্তৃত। জাতিক ও আন্তর্জাতিক নানামুখী ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়।সুনির্দিষ্টভাবে কয়েকটি বিষয় প্রধান হয়ে সামনে আসে। প্রথমত, বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা  যেখানে শোষণ ও সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান হবে না। দুঃখী মানুষের মুক্তি এই লক্ষ্যে তিনি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন; ঘুণেধরা প্রচলিত রাষ্ট্র কাঠামো এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন, বিচার ও প্রথাসিদ্ধ শৃঙ্খলা বাহিনীকে ভেঙে জনগণের কল্যাণকর নতুন আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাপনা।

তিনি বলতেন, ‘আমার সেনাবাহিনী হবে পিপলস্ আর্মি।’ বিদ্যমান ঘুণেধরা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করে সরাসরি জনগণের কাছে জবাবদিহি হতে পারে এমন একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা কার্যকর করা। কারণ এই আমলাতন্ত্র বঙ্গবন্ধুর কথায় ‘ঘুণেধরা, দুর্নীতিপূর্ণ এবং জনগণকে হয়রানি করার জন্য।’ সেজন্য প্রত্যেক স্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতা দিয়ে আমলাদের তাদের অধীনস্থ করার পদক্ষেপ নেন। জনগণের কাছে প্রশাসনকে জবাবদিহি করা; এর ফলে ব্রিটিশ-পাকিস্তানে প্রশিক্ষিত আমলাতন্ত্রে বিরাট অভিঘাত তৈরি হয়।

একইসূত্রে, তৎকালীন বাংলাদেশে সামরিক বাহিনীতে পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনা-অফিসারদের সংখ্যাই ছিল বেশি। কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত অধিকাংশই ছিল পাকিস্তানি মানসিকতায় আচ্ছন্ন। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর জৌলস ও কর্তৃত্ব তাদেরকে পুরনো স্বপ্নযুগে বারবার পিছু টেনে রেখেছে। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে উজ্জীবিত বা তাড়িত ছিল না। বরং মুক্তিযোদ্ধা সেনা-অফিসারদের বঙ্গবন্ধু পদোন্নতি দেওয়ার ফলে পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা অধিকাংশ সেনা-অফিসার ছিল বিক্ষুব্ধ। বঙ্গবন্ধু হত্যার সময় তারা এগিয়ে আসেনি, বরং তারা ছিল উল্লসিত এবং তাদের মুখে ছিল পাকিস্তানের স্লোগান ‘জিন্দাবাদ’।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে সবচেয়ে ক্রিয়াশীল ছিল স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। তারা দেশে এবং বিদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ব্যাপক অপপ্রচার চালায়। মুসলিম বাংলা স্লোগান দিয়ে ওই নামে বেতার স্থাপন করে মিথ্যাচার ও কুৎসা রটায়। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো সেসময়ে মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে একযোগে বাংলাদেশবিরোধী প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যে অপতৎরতা চালায়। আবার এদিকে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার’ নামে অঘোষিত যুদ্ধে নামে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার বেনিফিসিয়ারি হিসেবে এটিও ছিল অন্যতম একটি কারণ। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই মুজিব নগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশে স্বাধীনতা যাতে অর্জিত না হয় সেই লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা সংস্থা সি আই-এর সঙ্গে গোপন যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। সেই ধারাপাত থেকে হেনরি কিসেঞ্জার লিখিত ‘হোয়াইট হাউস ইয়ার্স’ বইতে দেখা যায় খন্দকার মোশতাক ও তার সহচরবৃন্দ কমপক্ষে ১৩ বার তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। সেসময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ নয়, বড়জোর পাকিস্তানের সঙ্গে একটি কনফেডারেশন গঠন।

কিন্তু মোশতাক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেই পরিকল্পনা সফল হয়নি। এমতাবস্থায় তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার দৃঢ়ভাবে পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন জারি রাখে। ফলশ্রুতিতে গোপনে অস্ত্র, অর্থ এমনকি যুদ্ধের শেষদিকে পারমাণবিক নৌ-যুদ্ধবহর বঙ্গোপসাগরের দিকে ধাবিত করে যেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা নস্যাৎ করা যায়। কিন্তু বহুল আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জনের পরেই মার্কিনপন্থিরা সেসময়ে ব্যাপকভাবে নাখোশ ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের চাপা ক্ষোভ আন্তর্জাতিক মহলে ব্যক্ত করেছিলেন যা পরবর্তীতে আগস্ট ট্র‍্যাজেডির ক্ষেত্রে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। আবার এদিকে স্বাধীনতা উত্তর সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু জমির সিলিং নির্ধারণ ও দেশজ শিল্প স্থাপনে ৩ কোটি টাকার অধিক বিনিয়োগ না করার সীমা বেঁধে দেন এবং কলকারখানা জাতীয়করণ করেন যাতে অর্থনৈতিক ভারসাম্য অর্জিত হয়। কিন্তু এর ফলে সেসময়ের ভূস্বামী, ধনীক ও বণিক শ্রেণি একযোগে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সঙ্গে হাত মেলায়।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে  আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসে যা ৭১ পরবর্তীতে প্রতিবিপ্লবী শক্তির নাশকতামূলক তৎপরতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। বিশেষভাবে বলতে গেলে, চীনপন্থিরা নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে এবং সারা দেশে খুন, হত্যা, নাশকতা, থানা ও ফাঁড়ি লুট, অগ্নিসংযোগ ঘটিয়ে অরজাকতা সৃষ্টির অপপ্রয়াস নেয়। যেখানে প্রয়োজন ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন কাজে অংশগ্রহণ, জাতীয় স্বাধীনতার সার্বভৌমত্বকে সুসংহত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর হাতকে শক্তিশালী করা, সেখানে প্রতিক্রিয়াশীলরা সশস্ত্রভাবে বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে মাঠে নামে। এদের মধ্যে একটি অংশ যেসব নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড করেছে তা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড প্রণোদনায় উৎসাহিত করেছে। তারা গণবাহিনী সৃষ্টি করেছে। সামরিক বাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহের উসকানি দিয়েছে।

বঙ্গবন্ধু দুর্নীতি, উচ্ছেদ, কালোবাজারি, মুনাফাখোর ও দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এদের শাস্তির  জন্যে তিনি প্রকাশ্যে ‘ফায়ারিং স্কোয়াড’ আইন প্রণয়নের ঘোষণা করেন। ফলে অসৎ আমলা, দেশপ্রেমহীন সেনাবাহিনীর ক্ষুদ্রাংশ, রাজনীতিবিদ ও শোষকদের মৃত্যুঘণ্টা বেজে ওঠে। তারা মরিয়া হয়ে বঙ্গবন্ধুকে উত্খাতের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে। দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য দুষ্প্র্রাপ্য করে তোলে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পি.এল-৪৮০ অধীনে জাহাজ বোঝাই যে খাদ্য বাংলাদেশে আসছিল তা কূটনৈতিক চক্রান্তে অন্যদিকে ঘুরে যায়। দেশে খাদ্যসংকট তৈরি হয়। এই খাদ্য সংকটের পেছনে ছিল আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ষড়যন্ত্র, অসৎ রাজনীতিবিদ, দুর্নীতিগ্রস্ত সচিব পর্যায়ের আমলা, শিল্পপতি ও ধনিকচক্র। এই অবস্থায় খুনি রশিদ-ফারুক-এর ভিডিও ভাষ্য মতে উপ-সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের মদদে এবং খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়।

১৯৭৬ সালের ২ আগস্ট যুক্তরাজ‌্যের আইটিভিতে প্রচারিত এক অনুষ্ঠানের একটি সাক্ষাৎকারে উদ্ধৃতি দিয়ে মেজর ফারুক বঙ্গবন্ধু হত‌্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমান জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। কর্নেল ফারুকের স্বাক্ষরে সানডে টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধেও বঙ্গবন্ধু হত‌্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমানের জড়িত থাকার কথা উঠে আসে। এছাড়া মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফসুলজ তার একটি বইতে বঙ্গবন্ধু হত‌্যাকাণ্ডে জিয়ার সম্পৃক্ততার কথা তুলে ধরা হয় এবং জিয়াউর রহমানকে সাইকোটার হিসেবে আখ‌্যায়িত করা হয়।

বঙ্গবন্ধু হত্যার ছক মেজর জিয়ার নখের ডগাতেই হয়েছিল এবং এ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসার হয়ে তিনি সরাসরি না থাকতে পারলেও জুনিয়র অফিসারদের এই হত্যাকান্ডে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন। এছাড়াও বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়ার কাছে যাওয়া হলে তিনি উদাসীনভাবে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘So what? Let the vice president take over. We've nothing to do with politics’

১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ছিলো ইতিহাসের কালো যুগে ঘটা সবচেয়ে জঘন্য রাজনৈতিক হত্যাকান্ড। যুগে যুগে আমরা দেখেছি মহান দার্শনিক, মহান রাজনীতিকদের হত্যা করে তাদের কন্ঠ রোধ করবার অপতৎপরতা চলেছে সমগ্র বিশ্বে। কিন্তু এভাবে স্বপরিবারে শিশুপুত্রসহ হত্যা সকল রাজনৈতিক হত্যার বর্বরতার সীমারেখার পাত ভেঙে ফেলেছে। এই নারকীয় হত্যাকান্ড কোন সেনা বিদ্রোহ ছিলনা। সুদীর্ঘ সময়ের পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রের আচল বেঁধে এই আগস্ট ট্র‍্যাজেডিকে মঞ্চস্থ করা হয়েছিল দেশি-বিদেশী ও আন্তর্জাতিক মহলের প্রত্যক্ষ মদদে।

আক্ষেপের আকাশ আরও বেশি প্রসারিত হয় যখন ৭৫ পরবর্তীতে খুনী মোশতাক ও খুনী জিয়া মিলে ৭৫ এর সেই ঘাতকদের রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দিয়ে পুনর্বাসিত করে। রাষ্ট্রের এই মানব রূপী দানবদের সংসদে, সচিবালয়ে প্রবেশাধিকার  ও বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ করে এবং আইন করে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের সমস্ত পথ বাতিল করে দেয়৷ এর মাধ্যমে জাতির গাঁয়ে কলংকের সর্বশেষ তিলকটুকুন তারা এঁকে দেয়।বঙ্গবন্ধু হত্যায় ফাঁসির রায় পাওয়া ঘাতকের কিয়দাংশ এখনও বিদেশে পলাতক রয়েছে। অবিলম্বেই তাদের সকলের কাঙ্খিত গন্তব্য বাস্তবায়ন করবে বঙ্গবন্ধু দুহিতা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার আজকের এই শোকাভিভূত দিনে এটুকুই কামনা।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

(ঢাকাটাইমস/১৫আগস্ট/এসএটি)