আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি আবদুল জলিল

স্বাধীনতার জন্য আমাদের আন্দোলনের স্বীকৃতি এখনো পাইনি

প্রকাশ | ১৫ আগস্ট ২০২২, ১৫:৫১ | আপডেট: ১৫ আগস্ট ২০২২, ১৫:৫৭

জাফর আহমেদ, ঢাকাটাইমস

আবদুল জলিল। বিমানবাহিনীর সাবেক সার্জেন্ট। আগরতলা মামলার ২৯ নম্বর আসামি। বর্ষীয়ান এই সংগ্রামী আলোকপাত করেছেন স্বাধীনতাপূর্ব আলোচিত এই মামলা নিয়ে। আলাপনে তুলে ধরেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর নানা স্মৃতি। তাঁর স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধুর সাহসী নেতৃত্ব ও বলিষ্ঠ ভূমিকা।

আবদুল জলিল বলেন, ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সবাইকে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হয়। তখন আমরা পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমাদের ‘উকিলদের শিখানো মতো মিথ্যা কথা বলেছিলাম এটা মিথ্যা মামলা’। কিন্তু আসলে এটা মিথ্যা মামলা নয়, আমরা ‘তখন সত্যি সত্যি স্বাধীনতার আন্দোলন’ করেছিলাম। আবার তখন যদি আমরা স্বীকার করতাম ‘হ্যাঁ আমরা স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করেছি’ তাহলে পাকিস্তান বঙ্গবন্ধুসহ আমাদের গুলি করে মেরে ফেলতো। আমাদের চোখের সামনে জেলবন্দি আসামিকে গুলি করে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি পুলিশ। তখন আমরা খুব ভয়ে ছিলাম, আজ মনে হয় বঙ্গবন্ধুকে তারা মেরে ফেলবে। কিন্তু তারপরও বঙ্গবন্ধু তাদের কাছে নতি স্বীকার করেননি।

২০ মার্চ, ১৯৩৫ তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে নারায়ণগঞ্জ মহকুমার অধীনস্থ নরসিংদীর রায়পুরা থানার (বর্তমানে বেলাবো উপজেলা) সল্লাবাদ ইউনিয়নের সররাবাদ (দক্ষিণ পাড়া) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আগরতলা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল জলিল (সার্জেন্ট বিমানবাহিনী)।

ঐতিহাসিক আগরতলা মামলার ২৯ নম্বর অভিযুক্ত আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার হন ও চরম কারানির্যাতন ভোগ করেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে গ্রেপ্তার হয়ে তিনি করাচীর বিমানবাহিনীর পুলিশ সেলে সপ্তাহখানেক আটক থাকেন। ১৯ জুন, ১৯৬৮ থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বন্দি ছিলেন।

প্রশ্ন: বঙ্গবন্ধুসহ কেন আপনাদের নামে আগরতলা মামলা করা হয়েছিল?

আবদুল জলিল: বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এবং পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনীতে লে. ক. মোয়াজ্জেম হোসেনের নেতৃত্বে পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনীর বাঙালিরা প্রাক্তন বাঙালি সৈনিক এবং স্বাধীনতাকামী ছাত্র-জনতার সহযোগিতায় সশস্ত্র পন্থায় বাংলাদেশকে স্বাধীন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং প্রস্তুতিও প্রায় সম্পন্ন হয়েছিল।

ওই পরিকল্পনায় ‘একটি নির্দিষ্ট রাতে নির্দিষ্ট সময়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সবকটি ক্যান্টনমেন্টে আচমকা আক্রমণ চালিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র দখল করে পাকিস্তানিদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাদের বন্দি করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা’ করার কথা ছিল। তবে বিশ্বাসঘাতকের মাধ্যমে পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার কারণে ঐতিহাসিক আগরতলা মামলার সূত্রপাত ঘটে।

১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি দুজন বাঙালি সিএসপি কর্মকর্তাসহ ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের সম্পর্কে সরকারি প্রেসনোটে উল্লেখ করা হয়, ‘গত মাসে (ডিসেম্বর ১৯৬৭) পূর্ব পাকিস্তানে উদ্ঘাটিত জাতীয় স্বার্থবিরোধী এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে এঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর কয়েক দিন পর (১৮ জানুয়ারি) একই অভিযোগে শেখ মুজিবুর রহমানকেও গ্রেপ্তার দেখানো হয়। রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য। তবে এটি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবেই বেশি পরিচিত।

প্রশ্ন: আগরতলা মামলার কোন বিষয়টি বেশি আলোচিত হওয়ার দরকার ছিল কিন্তু এখনো পর্যন্ত হয়নি বলে মনে করেন?

আবদুল জলিল: শেখ মুজিব ভার্সেস অন্য দল। কিন্তু মুজিব ভাইসহ যেদিন আমাদের নামে প্রথম আগরতলা মামলা করা হয়েছিল সেদিন আর্মি সাংবাদিকদের বলে দিয়েছিল পত্রিকার হেডিংয়ে আনতে হবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি। এটা যদি না লিখেন তাহলে আর আসতে পারবে না। তখন থেকে সাংবাদিকরা এই (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি) হেডিংয়ে নিউজ লিখতো। আরেকটা বিষয় আমার খুব মনে পড়ে সেটা হলো বঙ্গবন্ধুসহ আমাদের বিরুদ্ধে আগরতলা মামলায় চারজন সাক্ষী দাঁড় করিয়েছিল রাষ্ট্রপক্ষ (পাকিস্তান)। এর মধ্যে একজন ছিল ইউসুফ। তিনি পুলিশের নির্যাতনের বর্ণনা এমনভাবে বলছিলেন তখন তার জবানবন্দি শুনে সবাই আবেগঘন হয়েছিল এবং তার চোখ বেয়ে পানি পড়ছিল। তখন জজ সাহেব থেকে শুরু করে আদালতের সবাই কাঁদছিল। কিন্তু সেই কথা উল্টো রেকর্ড করে নেওয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধু যাতে ছাড়া না পান। এর আগে আরেকজন রাজসাক্ষী গোলাম মোহাম্মদ তিনিও বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সাক্ষী দিয়েছিলেন কিন্তু আমাদের পাশে বসেই রেকর্ড কারেকশন করছিল বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসানোর জন্য। তার চোখ দিয়েও পানি পড়ছিল, আদালতের বিচারকও দেখছিল কিন্তু মিথ্যা বলে বঙ্গবন্ধুসহ আমাদের ফাঁসানোর চেষ্টা করছিল। বঙ্গবন্ধুসহ আমরা কিন্তু ‘স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করেছিলাম তবে আদালত থেকে বাঁচার জন্য উকিলদের পরামর্শে আমরা অস্বীকার করেছিলাম যে আমরা স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করিনি। আমরা যে স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করেছিলাম সেই স্বীকৃতি কিন্তু আজও আসেনি। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও এটা অফিসিয়ালি মিথ্যা মামলা হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। আমি যে স্বাধীনতার পদক পুরস্কার পেয়েছি এটা কিন্তু আগরতলা মামলার আসামি হিসেবে নয়, বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিরা যে মুক্তিযুদ্ধের জন্য আন্দোলন করেছিল এটাই ছিলে কারেক্ট। এখনো পর্যন্ত এ কথাটা ভিতরেই রয়ে গেছে, এই কথাটা ক্লিয়ার করা হয়নি। আমরা ছিলাম স্বাধীনতা যোদ্ধা।

প্রশ্ন: আগরতলা মামলার আসামিদের কি স্বীকৃতি দাবি করেন?

আবদুল জলিল: অবশ্যই দাবি করি। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে যারা আগরতলা মামলার আসামি হয়েছিল তাঁদেরকে জাতীয় বীর হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এটার জন্য আমরা অনেক দাবি করেছি, মিটিং করেছি। এটা আমাদের মর্যাদার দাবি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন আমাদের মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন এবং তিনি স্বীকারও করেছিলেন। কিন্তু এখনো জাতীয় বীর হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পরও সংসদে আলোচনা করা হয়েছিল, তারপর কেন জানি আমাদের জাতীয় বীর হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলো না। আমাদের মিটিংয়ে যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসেছিলেন তখন তিনি বলেছিলেন আগরতলা মামলার আসামিদের জাতীয় বীর হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। এখনো পর্যন্ত স্বীকৃতি না দেওয়ায় একবার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী খুবই অনুতপ্ত হয়েছিলেন।

প্রশ্ন: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি এখনো কতজন বেঁচে আছেন?

আবদুল জলিল: এখনো তিনজন বেঁচে আছেন নূর মোহাম্মদ (অভিযুক্ত নম্বর ৫), কর্নেল সামছুল আলম, আবদুল জলিল।

প্রশ্ন: আপনি যখন বিমানবাহিনীতে থেকে ভিতরে ভিতরে স্বাধীনতার জন্য জনমত সৃষ্টি করেছিলেন তখন জিয়াউর রহমানের কোনো ভূমিকা ছিল?

আবদুল জলিল: এই সময় জিয়াউর রহমানের কোনো ভূমিকা ছিল না। তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না। জিয়াউর রহমান নামে তখন আমরা কাউকে চিনতাম না।

প্রশ্ন: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পূর্বের অবস্থা আর এখনকার অবস্থা কীভাবে দেখছেন?

আবদুল জলিল: জাতির কাছে জাতীয় বীর হিসেবে স্বীকৃতি তুলে ধরা উচিত। আমরা শুধু মুক্তিযোদ্ধা নই, আমরা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। কারণ দেশ স্বাধীন করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালে কিন্তু আমরা শুরু করেছিলাম এরও বহু আগে।

প্রশ্ন: বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার এমন কোনো স্মৃতি আছে যা এখনো খুব মনে পড়ে?

আবদুল জলিল: আমার এলাকার একজন একটা কলেজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য স্বাধীনতার পূর্ব থেকে চেষ্টা করে আসছিল কিন্তু মঞ্জুরি নিতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু হত্যার কিছুদিন আগে আমি কলেজ নিয়ে কথা বলতে গেলে সবাইকে বাইরে বের করে দিয়ে আমার সঙ্গে একা কথা বলেন বঙ্গবন্ধু। তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন জলিল তুমি এমএ পাস কলেজ করিও না, টেকনিক্যাল কলেজ করো যত টাকা লাগে আমি দেব। এমএ পাস করে এসব ছাত্র জাতির জন্য এবং নিজের জন্য তেমন কিছু করতে পারবে না। কিন্তু টেকনিক্যাল কলেজ থেকে পাস করে বের হলে নিজেরা কিছু করতে পারবে, জাতির জন্য কিছু করতে পারবে, এমনকি বিদেশে গিয়েও ভালো কিছু করতে পারবে। তখন বাংলাদেশে একটাও টেকনিক্যাল কলেজ হয়নি।

তখন যদি টেকনিক্যাল কলেজ করতাম তাহলে এটা হতো বাংলাদেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কলেজ। বঙ্গবন্ধু বলছিলেন, লুলা ল্যাংড়া পাস করিয়ে লাভ নেই, টেকনিক্যাল করো, ইঞ্জিনিয়ার বানাও, দক্ষ জাতি তৈরি করো এই কথাটা খুব বেশি মনে পড়ে।

প্রশ্ন: আগরতলা মামলার আসামিদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভূমিকা কি ছিল?

আবদুল জলিল: বাংলাদেশের হয়ে চুপে চুপে কাজ করার জন্য আমরা লাহোরে প্রস্তাব কমিটি করেছিলাম। এই নাম দিয়ে কমিটি করলে কেউ কিছু করতে পারবে না। এই নাম দিয়ে ভিতরে ভিতরে স্বাধীনতার জন্য কাছ করেছি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমরা যারা আগরতলা মামলার আসামি তারা পল্টনে মিটিং করেছিলাম। মিটিংয়ে অনেক মানুষ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এবং আমাদের বক্তব্য শুনে তখন সবাই আমাদের পক্ষে চলে আসছিল। আমরা তো  প্রথম পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি। আমি ছিলাম মুক্তিবাহিনীর ট্রেইনার।

প্রশ্ন: বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার দেখা ও যোগাযোগ হয়েছিল কীভাবে।

আবদুল জলিল: বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছে এবং আগরতলা মামলার আসামি হয়েছিলাম একটাই কারণ স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করেছিলাম। তখন থেকেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয়। আমি ছিলাম তৎকালীন পাকিস্তানের আমলে বিমানবাহিনীর সদস্য আর বঙ্গবন্ধু ছিলেন রাজনীতিবিদ কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য ছিল এক এবং অভিন্ন।

প্রশ্ন: আপনার এমন কোনো ইচ্ছা যা প্রকাশ করতে চান...

আবদুল জলিল: আমার কোনো নিজস্ব চাওয়া-পাওয়া নেই। মৃত্যুর আগে আমার শেষ ইচ্ছা আগরতলা মামলার আসামিরা যেন জাতীয় বীর হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

(ঢাকাটাইমস/১৫আগস্ট/ডিএম)