আগস্ট হোক স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের প্রত্যয়

প্রকাশ | ১৫ আগস্ট ২০২২, ১৬:১৬

অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান

শোকের মাস আগস্টে আমরা হারিয়েছি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, দ্বিতীয় পুত্র মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, কনিষ্ঠ পুত্র শিশু শেখ রাসেল, সদ্য বিবাহিত পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসেরসহ অনেককেই। ওই দিনে হায়েনারা মিন্টো রোডে সরকারি বাসভবনে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি এবং তৎকালীন মন্ত্রী নন্দিত কৃষকনেতা আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তার একমাত্র মেয়ে বেবি সেরনিয়াবাত, কনিষ্ঠ পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, দৌহিত্র সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু, ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত এবং আত্মীয় আব্দুল নঈম খান রিন্টুকে। আরেকটি বাসায় হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মনি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মনিকে। তাঁরা বর্তমান যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস্ পরশ এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ফজলে নূর তাপসের মাতা-পিতা। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আক্রমণ হয়েছে শুনে সেখানে যাওয়ার জন্য রওনা দেন বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ। তাঁকে ৩২ নম্বরের সামনে হত্যা করা হয়। এছাড়া ঐ দিন ৩২ নম্বরের বাড়িতে কর্তব্যরত অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকেও হত্যা করা হয়।

সেই নিষ্ঠুর নারকীয় হামলার পর দেখা যায়, ভবনটির প্রতিটি তলার দেয়াল, জানালার কাচ, মেঝে ও ছাদে রক্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। গুলির আঘাতে দেয়ালগুলোও ঝাঁজরা হয়ে গেছে। চারপাশে রক্তের সাগরের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল ঘরের জিনিসপত্র। প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে নিথর পড়ে আছে চেক লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ। তাঁর তলপেট ও বুক ছিল বুলেটে ঝাঁজরা। পাশেই পড়ে ছিল তার ভাঙা চশমা ও অতি প্রিয় তামাকের পাইপটি। অভ্যর্থনা কক্ষে শেখ কামাল, মূল বেডরুমের সামনে বঙ্গমাতা বেগম মুজিব, বেডরুমে সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, রোজী জামাল, নিচ তলার সিঁড়ি সংলগ্ন বাথরুমের পাশে শেখ নাসের এবং মূল বেডরুমে দুই ভাবির ঠিক মাঝখানে বুলেটে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল ছোট শিশু শেখ রাসেলের লাশ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পরই খন্দকার মোশতাক আহমেদ যে কি না বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন, সে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দেয় এবং খুনিদের বাঁচানোর জন্য ২৬ সেপ্টেম্বর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে। এরপর ক্ষমতায় আসে সামরিক শাসক মেজর জিয়া। মেজর জিয়া ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনে বৈধতা দেন। এভাবেই  এ দেশে খুনের রাজনীতি বৈধতা পায়। এর পরবর্তী ইতিহাস আমাদের সকলেরই জানা। সব বাধা উপেক্ষা করে এ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ছয় খুনির ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে। এখনো পলাতক রয়েছে কর্নেল খন্দকার আব্দুর রশিদ, লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, লে. কর্নেল এ এম রাশেদ চৌধুরী, রিসালদার (বরখাস্ত) মোসলেম উদ্দিন এবং লে. কর্নেল এস এইচ নূর চৌধুরী। আমাদের দাবি হলো পলাতক সকল খুনিকে গ্রেপ্তার করে ফাঁসির রায় কার্যকর করতে হবে। ঘাতকরা কতটা নির্মম হলে এমন হত্যাকা- সংঘটিত করতে পারে যেখানে অন্তঃসত্ত্বা নারী, শিশু কেউই রেহাই পায়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশে না থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।

আবার এই আগস্ট মাসেই ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী আইভি রহমানসহ ওই দিন আওয়ামী লীগ ২৪ জন নেতাকর্মীকে হারিয়েছে। গ্রনেড হামলার মাঝেও মহান আল্লাহতায়ালার অশেষ রহমতে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আবারো প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। মহান আল্লাহতায়ালা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে দিয়ে বাংলাদেশকে রক্ষা করবেন ও দেশের উন্নয়ন এবং জনগণের উন্নতি ও কল্যাণের জন্য কাজ করাবেন বলেই হয়তো তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। যার বাস্তব প্রমাণ বর্তমানে আমরা দেখতে পাই সকল ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে চলতি বছরের ২৫ জুন স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ঐতিহাসিক উদ্বোধনের মাধ্যমে। বাস্তবায়ন হচ্ছে স্বপ্নের মেট্রোরেল, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ মেগা প্রকল্পসমূহ। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আজ যেমন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তেমন তিনি বিশ্বনেতা। তাই স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীনতাবিরোধী ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী গাত্রদাহে ভুগছে। আগস্ট মাস এলে তাদের গাত্রদাহের মাত্রা বেড়ে যায়। শুরু করে নিত্যনতুন ষড়যন্ত্র। তাই আগস্ট মাসে আমাদেরকে বেশি করে সতর্ক থাকতে হবে। জাতীয় শোককে শক্তিতে পরিণত করে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রান্তকারীদের রুখে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ে নিজেদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। আগামীতে জাতীয় নির্বাচন। তাই এখনই স্বাধীনতাবিরোধীরা ষড়যন্ত্র কূটকৌশল শুরু করে দিয়েছে। জাতীয় নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে তারা নির্বাচন কমিশনের সংলাপে পর্যন্ত অংশ নেয়নি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নয়, তারা হত্যা এবং ক্যু-এর মাধ্যমে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায়। এটাই তাদের ইতিহাস। স্বাধীনতাবিরোধীদের একটাই লক্ষ্য যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় গিয়ে জনগণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা আর নিজের আখের গোছানো, সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা। দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণ নিয়ে তাদের কিছু যায় আসে না। 

২১ আগস্ট প্রসঙ্গে যা বলতে চাই তা হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যে চক্রান্তকারী খুনিচক্র বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে পারেনি সেই একই মতাদর্শে বিশ্বাসী খুনিচক্রই পরিকল্পিতভাবে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ওই হামলা চালায়। ভয়াবহ সেই ঘটনার ১৪ বছর পর ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবরে এই মামলায় রায় ঘোষিত হয়। রায়ে বিএনপি নেতা সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এবং আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদন্ড দেয় ঢাকার একটি বিশেষ দ্রুত আদালত। রায়ে আদালত বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ডের আদেশ দেন। দেশবাসীর দাবি হলো অবিলম্বে এই রায় কার্যকর করতে হবে। তাহলেই বর্বরোচিত ওই গ্রেনেড হামলায় মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আইভি রহমান, তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার  ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা)সহ যে ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন তাঁদের আত্মা শান্তি পাবে এবং আহত হয়ে যারা বেঁচে আছেন তারা একটু হলেও স্বস্তি পাবেন। তাছাড়া এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলা প্রতিরোধে ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এই হামলার বিচারের রায় কার্যকর করা অপরিহার্য।

মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধূলিসাৎ করতেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের ঘৃণ্য পরিকল্পনামাফিক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছিল। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরও পাকিস্তানি ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী মৌলবাদী, জঙ্গি গোষ্ঠী তাদের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে এবং ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দকে হত্যার জন্য গ্রেনেড হামলা চালায়। এই হামলার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে মৌলবাদী পাকিস্তানি ধারার রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। দুঃখজনক বিষয় হলো বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের সাথে মেজর জিয়া বিভিন্নভাবে জড়িত ছিল যা বর্তমানে নানা বিশ্লেষণ ও বিবেচনার দ্বারা প্রমাণিত। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ে মেজর জিয়া সবচেয়ে লাভবান হয় এবং দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়। কিন্তু হত্যা নতুন করে হত্যারই জন্ম দেয়। যে কারণে মেজর জিয়ারও শেষ রক্ষা হয়নি। তাকেও হত্যাকা-ের শিকার হতে হয়েছে। পরবর্তী সময়ে মেজর জিয়ার সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়া সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পেলে তিনিও হত্যা ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি। মেজর জিয়া ও বেগম খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমানও স্বাধীনতাবিরোধী জঙ্গি গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষক। যে কারণেই বেগম খালেদা জিয়া রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাকালীন ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতি ধারার রাজনীতিকে নেতৃত্বশূন্য করতেই এই হামলা চালানো হয়। এই হামলার পরবর্তী সময়ে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে দুষ্কৃতকারীদের খুঁজে বের করার পরিবর্তে জজ মিয়া নাটক সাজানো হয় এবং হামলার শিকার হওয়া আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে নিয়ে বিদ্রুপ করা হয়। বিএনপি-জামায়াত ও স্বাধীনতাবিরোধী, মৌলবাদী-জঙ্গি গোষ্ঠী যে এই হামলার সাথে জড়িত তা আজ আদালতে প্রমাণিত। তাই বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হলে স্বাধীনতাবিরোধী এই অপশক্তির বিরুদ্ধে মহান মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিরন্তর সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে। বাংলাদেশকে পাকিস্তান, আফগানিস্তানের ন্যায় মৌলবাদী শক্তির অশুভ ছায়া থেকে মুক্ত রাখতে সর্বদাই সতর্ক থাকতে হবে। পরিশেষে বলতে চাই, আগস্ট হোক স্বাধীনতাবিরোধী চক্রান্তকারীদের রুখে দাঁড়ানোর  দৃঢ় প্রত্যয়। একই সাথে আমাদের মনে রাখতে হবে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের সদস্যগণ বাংলাদেশের জন্য রক্ত দিয়ে গেছেন, জীবন দিয়ে গেছেন। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষকে ভালোবাসতেন বলেই ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে নির্বিচারে হত্যা করে। আমরা কোনো দিন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের রক্তের ঋণ শোধ করতে পারবো না। কিন্তু আমরা অসাম্প্রদায়িক চেতনা, শোষণমুক্ত ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা, মানুষকে ভালোবাসা,  দেশপ্রেম ও ত্যাগের নীতিকে অনুসরণ করা তথা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও দর্শনকে বাস্তবায়নের মাধ্যমে কিছুটা হলেও তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারবো।

লেখক: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ ও কোষাধ্যক্ষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়