বিয়ের উৎসবের সমাপ্তি বিষাদে, সড়কে ঝরল ৫ প্রাণ

প্রকাশ | ১৫ আগস্ট ২০২২, ২৩:৪০

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

দিনেদুপুরে সড়কে প্রাণহানি। প্রাইভেটকারে থাকা পাঁচজনের মৃত্যু। সেই গাড়িটির ওপর ক্রেন থেকে ছিঁড়ে পড়ে ফ্লাইওভারের গার্ডার। বাস র‌্যাপিড ট্রানজিটÑবিআরটি প্রকল্পের সেই গার্ডার সরানো হচ্ছিল কোনো ধরনের সুরক্ষা-নিরাপত্তা ছাড়াই। ক্রেনটি কাঁৎ হয়ে পড়লে গার্ডারটি চাপা দেয় একটি প্রাইভেটকারকে। সেখানে ছিল সাত জন। তাদের মধ্যে দুই শিশুসহ পাঁচজনের মর্মান্তিক মৃত্যু। এভাবেই একটি পরিবারের বিয়ের উৎসব শেষ হলো বিষাদের মধ্য দিয়ে।

সোমবার দুপুর সাড়ে তিনটার দিকে রাজধানীর উত্তরায় ব্যস্ততম জসিম উদ্দিন সড়কের আড়ংয়ের সামনে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন- প্রাইভেট চালক রুবেল মিয়া (৬০), ফাহিমা (৩৭), ঝর্না (২৬), জান্নাতুল (৬) ও জাকারিয়া (৪)। এ ঘটনায় আহত দুজন উত্তরার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তবে তারা শঙ্কামুক্ত। এই দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারের প্রতি গভীর শোক জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

দুর্ঘটনা কবলিত প্রাইভেটকারকারটি নরসিংদীতে বৌভাতের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে আশুলিয়া যাচ্ছিল। পথে উত্তরার জসিম উদ্দিন পৌঁছালে চলমান বিআরটি প্রকল্পের একটি গার্ডার ক্রেন থেকে ছিড়ে পড়লে ঘটনাস্থলেই পাঁচজনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় নববধু রিয়া মনি ও তার স্বামী হৃদয় আহত হন।  তাদেরকে উদ্ধার করে উত্তরার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দুর্ঘটনার পর পর ওই ক্রেনের চালক পালিয়ে গেছেন। পুলিশ বলছে, চালককে ধরা গেলেই সব প্রশ্নের জবাব মিলবে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গাড়ির চালকের আসনে ছিলেন নববধূর বাবা মো. রুবেল। তার পাশে ছিলেন নববধূ। গাড়ির পেছনের সিটে ডান পাশে বসা ছিলেন নববধূর স্বামী হৃদয়ের বোন ঝর্না ও দুই শিশু জান্নাত ও জাকারিয়া। বাকি আরেক নারীর পরিচয় জানা যায়নি। ক্রেন থেকে গার্ডারটি ছিড়ে চালকের আসন বরারবর পড়ে। ফলে চালকের আসনে থাকা রুবেল ও তার পেছনের সিট বরাবর থাকা দুই শিশু ও এক দুই নারী নিহত হন।

ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার মো. সাইফুল হক ঢাকাটাইমসকে বলেন, উত্তরা আড়ংয়ের সামনে একটি গার্ডার প্রাইভেটকারের উপরে পড়ে। এসময় পাঁচজন মারা গেছেন। আর প্রাইভেটকারটির বাম পাশে থাকা দুইজন বেরিয়ে গিয়েছিলেন। তারা বেশ আহত।

নিহতদের পরিবারের এক সদস্য বলেন, ‘আমার বোনের বিয়ের বৌভাত শেষে বোনের শ্বশুর গাড়ি চালিয়ে বাসায় ফিরছিলেন। এ সময় গাড়িতে আরোহী ছিলেন মোট সাত জন। এর মধ্যে দুজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বাকি পাঁচজনকে গাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়।’

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে আছেন চায়না একটি কোম্পানি। ঘটনার পর প্রজেক্টটির দায়িত্বে থাকা দুই চীনা নাগরিকসহ চারজনকে আটক করে থানায় নেওয়া হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রকল্পের একটি গার্ডার ক্রেন দিয়ে সরানো হচ্ছিল। এসময় ক্রেনটি গার্ডারের ভর ঠেকাতে না পারলে ওই দিক দিয়ে যাওয়া একটি প্রাইভেটকারের উপরে পড়ে। সেসময় আশপাশে কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনি ছিল না। দুর্ঘটনায় সঙ্গে সঙ্গে পাঁচজন মারা যান। তাদের মধ্যে দুইজন শিশু ও দুইজন নারী ও একজন পুরুষ রয়েছেন। কারটির চালকের আসনে ছিলেন মোহাম্মদ রুবেল। আহত দুইজন বাম পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসেন। এসময় আশপাশের সাধারণ মানুষ তাদেরকে উদ্ধারে করেন।

তারা বলছেন, এই দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ অবহেলা। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে প্রতিষ্ঠানটির একজন বিশেষজ্ঞ এসেছিলেন। কিন্তু তিনি অবস্থা দেখে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান। এই ঘটনায় বিআরটি-র বিরুদ্ধে মামলা হওয়া দরকার।

গত কয়েক বছর ধরেই রাজধানীতে মেগাপ্রকল্পের কাজ চলমান। এসব উন্নয়ন কার্যক্রম চলাকালীন হরহামেশা দুর্ঘটনা ঘটছে। চলতি বছরও একাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে হতাহতের শিকার হয়েছেন বেশ কয়েকজন।

ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত যানজট নিরসনে ২০১২ সালে বিআরটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের কাজ ২০২২ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও মেয়াদ বেড়েছে। এ প্রকল্পের নির্মাণকাজের কারণে উত্তরাসহ আশপাশের এলাকায় যানজট লেগেই থাকে। এর আগে ৩০ মে রাজধানীর পল্লবী এলাকায় মেট্রোরেল প্রকল্পের নির্মাণ কাজের ইট পড়ে এক পথচারীর মৃত্যু হয়। তার নাম মাহবুবুর রহমান তালুকদার। তিনি একটি জুয়েলারি দোকানের কর্মচারী ছিলেন। ১৫ জুলাই বিকেলে চান্দনা চৌরাস্তার কে চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানি ফিলিং স্টেশনের সামনে গার্ডার চাপায় জিয়াউর রহমান নামে এক নিরাপত্তারক্ষী নিহত হন। গত বছরের ১৪ মার্চ সকালে এই বিআরটিরই গার্ডার ভেঙে অন্তত চারজন আহত হন, যাদের মধ্যে দুজন বিদেশিও ছিলেন। তখন ফায়ারকর্মীরা জানান, ক্রেনের মাধ্যমে গার্ডারটি তুলে ফ্লাইওভারে স্থাপনের কাজ চলছিল। সেসময় সেটি ছিটকে ভেঙে পড়ে।

দুর্ঘটনার পর পুরো এলাকা কর্ডন করে রাখা হয়। যেখানে পুলিশ, র‌্যাব ও আনসার সদস্যরা কাজ করেন। তবে উৎসুক জনতার কারণে উদ্ধার কাজ ব্যহৃত হয়। ৬টা ১১ মিনিটে গার্ডার চাপা পড়া গাড়িটির ছাদ কেটে মরদেহ উদ্ধারের চেষ্টা করে ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু তাতে সফল হয়নি তারা। উত্তরা পূর্ব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন বলেন, ৭০ টন ওজনের গার্ডার সরাতে ৮০ টনের বেশি মেশিন দরকার। দুপুরে দুর্ঘটনা ঘটলেও ৬টা ১৩ মিনিট পর্যন্ত ঘটনাস্থলে আসেনি কোনো বিশেষজ্ঞ টিম। পুলিশ ভেকু এনে গার্ডার সরানোর চেষ্টা করে।

উদ্ধার কাজে থাকা ফায়ার সার্ভিস বলছে, যান্ত্রিক ক্রুটিপূর্ণ ক্রেনের কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। গার্ডার সরানোর জন্য ১৫০ টনের বেশি ভার নিতে পারে এমন ক্রেন লাগত। কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের কাছে এমন সক্ষমতার ক্রেন নেই; আছে সড়ক ও জনপথ বিভাগের কাছে।

৬টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত পাঁচটি মরদেহ গাড়ির ভিতরে ছিল। আর ফায়ার ফাইটারদের জন্য পানির ব্যবস্থা করা হয়। মৃতদেহ নিতে ৬টা ২৫ মিনিটে ঘটনাস্থলে আসে তিনটি অ্যাম্বুলেন্স। ৬টা ৩০ পর্যন্ত ঘটনাস্থলে সংশ্লিষ্ট প্রকল্প প্রতিষ্ঠানের কেউ ঘটনাস্থলে আসেনি। পরে রাত সাড়ে সাতটার দিকে একটি বড় ক্রেন এনে গার্ডারটি সরিয়ে গাড়ি থেকে মরদেহগুলো উদ্ধার করা হয়। এরপর মরদেহগুলো পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। রাত সাড়ে আটটার দিকে রেকার দিয়ে ঘটনাস্থল থেকে গাড়িটি সরিয়ে নেয় পুলিশ।

ফায়ার সার্ভিসের ডিউটি অফিসার দেওয়ান আজাদ হোসেন জানান, ক্রেন দিয়ে গার্ডার ওঠানোর কাজ চলছিল। প্রাইভেটকার নিচ দিয়ে যাচ্ছিল। তখন ক্রেনটির এক পাশ উল্টে গার্ডারটি ছিটকে গাড়ির ওপরে পড়ে যায়।

এই দুর্ঘটনার একটি ভিডিওতে দেখা যায়, বিআরটি প্রকল্পের একটি গার্ডার ভেঙে পড়েছে খয়েরি রঙের একটি প্রাইভেটকারের ওপর। ভারী গার্ডার মাঝ বরাবর পড়ায়, প্রাইভেটকারটি একদম চ্যাপ্টা হয়ে যায়। রাস্তায় জমাট রক্ত দেখতে পাওয়া যায়। দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া গাড়িটি উদ্ধারে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও দেখা যায়।

ঘটনাস্থলের বর্ণনা: গার্ডারটি প্রাইভেটকারের ডান পাশের অর্ধেক অংশে পড়ে। পেছনের সিটে ছিলেন বর হৃদয়ের বোন ঝর্না। তার কোলে ছিলেন চারবছরের শিশু জান্নাত। তার পাশে ছিলেন আটবছরের আরেক শিশু জাকারিয়া। তার পাশে ছিলেন একজন নারী। তবে তার পরিচয় জানা যায়নি। ঝর্নার কোলে থাকা শিশু জান্নাতের মুখমন্ডল বোঝা গেলেও বাকিটা অংশ গার্ডারে চাপা পড়েছিল। আর চালকের আসনে থাকা নববধূর বাবা রুবেলের শরীর একদম থেতলে ছিল গার্ডারের সঙ্গে।

উদ্ধার কাজ: গার্ডার পড়ার খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে যায়। তারা লোহা কাটার মেশিন দিয়ে প্রথমে প্রাইভেটকারটির ছাদ কাটার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে সফলতা আসেনি। কারণ ছাদ কাটার ফলে গার্ডার গাড়ির উপরে আরও পড়তে থাকে। পরে একটি ভেকু এনে সেটি সারনোর চেষ্টা করা হয়।

দুর্ঘটনার পর তীব্র যানজট: দুর্ঘটনার পরপরই উত্তরার ওই সড়কটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রভাব পড়ে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব সড়কে। ফলে সন্ধ্যার আগে থেকেই রাজধানীজুড়ে দেখা দিয়েছে তীব্র যানজট। মহাখালী, বাডডা, বনানী, বিমানবন্দর ও উত্তরা এলাকার প্রতিটি সড়কে গাড়ি চলা শুরু করে ধীরগতিতে। পরে নয়টার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।

(ঢাকাটাইমস/১৫আগস্ট/এসএস/ডিএম)