বেহেশত, জাহান্নাম এবং মন্ত্রীদের ‘ভ্রম’

প্রকাশ | ১৬ আগস্ট ২০২২, ২১:২৯ | আপডেট: ১৭ আগস্ট ২০২২, ১৩:৪৯

মিজান মালিক

‘কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক/ কে বলে তা বহুদূর/ মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক/ মানুষেতে সুরাসুর।’ কবির কবিতায় স্বর্গ-নরকের বিষয়টি রূপক অর্থে তুলে ধরা হয়েছে মানুষের জন্য, কিংবা মানুষের কল্যাণে- এই ভাবনা থেকে। আবার আমরা অনেক গানেও শুনতে পাই, প্রেমিক তার প্রেমিকাকে বলছে, ‘তোমায় পেলেই যেন আমি পেয়ে যাব স্বর্গ।’ এখানেও গীতিকার রূপক অর্থে সুখের অনুভূতিকে স্বর্গ পাওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন।

বাস্তবতা কি তাই? আদৌ কি পৃথিবীতে স্বর্গ পাওয়ার কোনো সুযোগ আছে? ধর্ম বিশারদরা হয়তো একটা ব্যাখ্যা দেবেন। কিন্তু আমাদের একাধিক মন্ত্রী যখন স্বর্গ, নরক বা দোজখ-বেহেশত নিয়ে কথা বলেন, তখন বিষয়টি আলোচনার ভিন্ন মাত্রা পায়।

শুরুটা করেছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। ‘অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছে’, তার মুখ থেকে কথাটা পড়তে বাকি, সঙ্গে সঙ্গে তা সবার কানে পৌঁছে যায়। গণমাধ্যম ছাড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘হা হা’ রিয়্যাক্টসহ মানুষের মনে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

মানুষ যখন এক দুর্বিষহ সময়ের ওপর দিয়ে যাচ্ছে, ব্যক্তি, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন এক অনিশ্চিত শঙ্কার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখন ‘দেশের মানুষ বেহেশতে আছে’ বক্তব্য কষ্টে থাকা মানুষের কাছে আগুনে ঘি ঢালার মতো।

মন্ত্রী সাহেব বাজারে যান না। সাধারণ মানুষের কাছে যান না। তার বাজার করতে হয় না। উজির-নাজির সব তার আশপাশে থাকে। ফলে তার জীবন প্রতীকী অর্থে অনেকটা স্বর্গের মতো হলেও দেশের আপামর মানুষের জীবন তা নয়। বৈশ্বিক পরিস্থিতি, করোনার ধাক্কা, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং এর পরপরই জ্বালানি তেলের বিশাল মূল্যবৃদ্ধিসহ জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ দিশেহারা। মানুষ বেঁচে থাকা এবং টিকে থাকার লড়াই করে যাচ্ছে। তারা যে বাস্তবতা ‘ফেস’ করছে, সেই বাস্তবতায় বেহেশত নেই, স্বর্গ নেই। আছে শঙ্কা, অনিশ্চয়তা, দুর্ভোগ, কষ্ট।

ফলে মানুষের কাছে হাসির পাত্রে পরিণত হন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহাশয়। বিষয়টা তার কান পর্যন্ত পৌঁছালে বোধোদয় হয় বলেই আমরা বুঝতে পারি। পরবর্তী সময়ে তিনি সাংবাদিকদের তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বলেছেন, ‘আমি তো ওই সেন্সে বেহেশত বলিনি। কিন্তু আপনারা সবাই আমারে খায়া ফেললেন।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় মানুষের মন যখন কিছুটা প্রশমিত, যখন তারা মেনে নিয়েছেন ওটা উনি হয়তো সরল মনেই বলেছেন, তখনই আরেক বোমা ফাটান প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা সভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর জন্য ‘জাহান্নাম’ কামনা করেন। যদিও ‘জাহান্নাম’ বলার পরপরই তিনি দুঃখ প্রকাশ করে তিনবার ‘জান্নাত’ কামনা করেছেন।

কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। ফোনে ফোনে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবার কানে কানে চলে গেছে জাহান্নাম চাওয়ার বার্তা। ক্ষোভে ফেটে পড়েন বঙ্গবন্ধু প্রেমিক আপামর জনতা। বঙ্গবন্ধুর শত্রুও কখনো এভাবে প্রকাশ্যে জাহান্নাম কামনা করেননি। অথচ তার আদর্শের একজন দায়িত্বশীল প্রতিমন্ত্রী এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন কথা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করবেন, তা ভাবনারও বাইরে। সবাই ছি ছি দেয় মন্ত্রীকে। অনেকে তার পারসোনালিটি, তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

এমন বাস্তবতায় প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন গণমাধ্যমের কাছে তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেন। মুখ ফসকে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ‘জাহান্নাম’ কথাটি উল্লেখ করেন বলে জানান। তিনি ‘জাহান্নাম’ বলার পর জিহ্বায় কামড় দিয়ে তিনবার ‘জান্নাত’ কামনা করেন।

কিন্তু তার আগেই মন্ত্রীর বলা জাহান্নাম শব্দটিই প্রচার পেয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। দলের নেতাদের মাঝে বঙ্গবন্ধুর প্রতি কতটুকু ভালোবাসা রয়েছে, সে প্রশ্ন তোলেন তারা।

শুধু আজকের প্রেক্ষাপটেই নয়, ১৯৭৫ সালের সেই নিষ্ঠুরতম ঘটনার পরও বঙ্গবন্ধুর সুবিধাভোগী অনেক মন্ত্রী মোশতাক সরকারের সুবিধা নেন। বঙ্গবন্ধু ওই সব সুবিধাবাদী নেতাকে ‘চাটার দল’ বলে অভিহিত করেছিলেন। আজকের প্রেক্ষাপটেও কিছু চাটুকার দালালের আবির্ভাব ঘটেছে। তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকার পরামর্শ বঙ্গবন্ধু আগেই দিয়ে গেছেন।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক ঢাকা টাইমস, ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকম।