হাসির শব্দ শোনেন কান্না কেন দেখেন না?

প্রকাশ | ১৮ আগস্ট ২০২২, ১০:৩৮ | আপডেট: ১৮ আগস্ট ২০২২, ১২:৪৪

আরিফুর রহমান দোলন

কী আশ্চর্য!

তিনি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। অতি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর দায়িত্ব সামলানোই যার কাজ। আর তিনিই কি-না সহজ ভুল করলেন?

পাটিগণিতের ক্লাসে ধর্মচর্চা?

কিভাবে হিসাব মেলাবেন অভিজ্ঞ ড. আবদুল মোমেন? অঙ্ক মেলেওনি। আর তাইতো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা, নিন্দা চলছে।

কতটা বিব্রত আবদুল মোমেন? জানা নেই। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ যে অস্বস্তিতে বুঝতে বাকি নেই। সাধে কি আর সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বুঝেশুনে নেতা ও মন্ত্রীদের মুখ খোলার পরামর্শ দেন!

অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছে। এ কী বললেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী! কেন বললেন? কিভাবে বললেন? তাঁর এই বক্তব্য কোনো সমস্যার সমাধান দিল? না-কি সমস্যাকে আরও উসকে দিল।

মানুষের দুঃখ, কষ্ট, বেদনা নিয়ে উপহাস করা কি সাজে? সরকারের চালিকাশক্তি যারা, তারা কিভাবে বিতর্ককে সামনে নিয়ে আসেন? দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে যেখানে দেশের সিংহভাগ মানুষ হাঁসফাঁস করছেন, সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘বেহেশত তত্ত্ব’ কি পরিহাস নয়?

বিরোধীদের কথা বাদই দিলাম। আওয়ামী লীগের নেতা, কর্মী, সমর্থকরাও কি আবদুল মোমেনের কথা গ্রহণ করেছে? প্রচারের আলো হয়তো নিজের দিকে টানতে পেরেছেন এই ‘টেকনোক্র্যাট রাজনীতিবিদ’। কিন্তু সাধারণ মানুষের সেন্টিমেন্ট যে বিপরীতমুখী অবস্থানে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন তা সামাল দেওয়ার দক্ষতা, রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা ও নেতৃত্ব দেওয়ার অবস্থান কি আদৌ তাঁর আছে?

ইদানীং সরকারের ‘অফিসিয়াল নীতিনির্ধারক’ কোনো কোনো মন্ত্রী খুব বেশি আনন্দ দেখতে পাচ্ছেন দেশের নাগরিকদের। কারণে ও অকারণে নিজের বিষয়বস্তুর বাইরে গিয়ে কোনো কোনো মন্ত্রীর অতিকথন হাস্যরস সৃষ্টি করছে। সাধারণ মানুষের অসন্তুষ্টির কারণ হচ্ছে। ক্ষোভ ও সরকার সম্পর্কে অনীহা সৃষ্টির সুযোগও সৃষ্টি করে দিচ্ছে ক্ষেত্র বিশেষ। সবচেয়ে বড় কথা, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো পর্যাপ্ত ইস্যু পাচ্ছে। সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলে এই প্রথম জনগণের প্রকাশ্যে, অপ্রকাশ্যে সমর্থন পাওয়ার জায়গা তৈরি হয়েছে বিরোধীদের।

সরকারের চালিকাশক্তি হিসেবে মন্ত্রী নিশ্চয়ই নিজেদের ইতিবাচক কাজের কথা বলবেন। অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রচার করবেন, বিরোধীদের অপপ্রচারের জবাবও দেবেন। তাই বলে অপ্রাসঙ্গিকভাবে অন্য বিষয় তুলে আনবেন না। যা অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করে, সরকারকে বিপাকে ফেলে এবং সস্তা ‘এন্টি এস্টাব্লিসমেন্ট’ তৈরির সহায়ক হয়।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি দেশের অধিকাংশ মানুষকে কঠিন চাপে ফেলে দিয়েছে। আয় বাড়েনি, কিন্তু ব্যয় বেড়েছে প্রায় শতভাগ নাগরিকেরই। এমনই এক অসহনীয় পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রায় সব মহল। বিশ্ববাজারে যেখানে দাম কমেছে, সেখানে আমাদের এখানে বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, এটাই স্বাভাবিক। এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া হবে, সমালোচনা হবে, মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়া-পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক চলবে। না-কি সেটিও করা যাবে না? যখন এসব নিয়েই কথাবার্তা তখন কিছু মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী মেজাজ হারাচ্ছেন। দিশাহীন হয়ে অযৌক্তিক উদাহরণ টেনে মানুষের ভালো থাকার বর্ণনা করছেন। কেন? এতে লাভ কিছু হচ্ছে? না-কি ভেতরে ভেতরে মানুষের ক্ষোভ, কষ্ট জমাট বাঁধার সুযোগ তৈরি হচ্ছে?

এসব মন্ত্রী শুধুই আনন্দ দেখছেন। মানুষের খুশি দেখছেন। ভালো থাকার মুহূর্ত মনে করাচ্ছেন। তাঁরা মানুষের হাসি যদি দেখেন তাহলে কান্না কেন শুনতে পাচ্ছেন না?

যদিও বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী বোল্ড আউট করে দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে। জীবিত অবস্থায় বেহেশত হয় না। কেউ এমন বলছেন না-কি?

ভুল বলেছেন। এই সহজ, সরল স্বীকারোক্তি সাধারণ মানুষের মধ্যে বাণিজ্যমন্ত্রীর গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে।

রিকশায় উঠেছিলাম সম্প্রতি। নানা আলাপের ফাঁকে রিকশাচালককে সরাসরি প্রশ্ন, রিজার্ভ বোঝেন? জানেন আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কত? ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রিকশাচালকের উত্তর, ‘মামা, আমি প্যাটে ভাত আছে কি নাই এইডা বুঝি।’ নিশ্চুপ হয়ে যাই এ কথায়। কিন্তু সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কী বললেন? এখন রিকশাওয়ালারাও রিজার্ভ নিয়ে আলোচনা করেন। রিজার্ভ বোঝেন। দেশের মানুষ কতখানি স্বস্তিতে আছে বোঝাতেই এ কথা বলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক। বাস্তবতা কি আসলেই তাই? মানুষের কষ্ট নিয়ে কৌতুক করা আদৌ সমীচীন কি-না এই হিসাব মেলাতে হয়তো আরও অপেক্ষা করতে হবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায়ই আসি। তিনি সত্য কথা বলেছেন। কী বলেছেন? ‘আমার ইনফ্লেশন রেট (মূল্যস্ফীতি) ৭ পার্সেন্ট। আমেরিকায় ৯ দশমিক ৫ পার্সেন্ট, টার্কিতে ৬০ পার্সেন্ট, পাকিস্তানে ৩৭ পার্সেন্ট।’ দীর্ঘ সময় শিক্ষকতা করা আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খুবই সহজ, সরলভাবে কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, ‘আমি এটাও বলেছি, আমি খুব তাজ্জব হয়েছি যে ১ লিটার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ল ৪০ টাকা। আর প্রতি কেজি বেগুনের দাম বাড়িয়ে দিল ২০ টাকা। এই ১ কেজি বেগুন পরিবহন করতে কত লিটার তেল লাগে? এটা কয়েক পয়সা কিংবা ১ টাকা, ২ টাকার বেশি বাড়া উচিত নয়। কিন্তু বাড়িয়ে দিল ২০ টাকা। এ কী ঢং?’

জানি না। ঢং কি-না। কিন্তু বিজ্ঞ পররাষ্ট্রমন্ত্রী যদি বলতেন আমেরিকার মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কত তাহলে ভালো হতো। তুরস্কের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আমাদের চেয়ে বেশি- এটি জানান দিলে তুলনাটা যুৎসই হতো। অসম্পূর্ণ তথ্য দিলে আমাদের তো বুঝতে একটু অসুবিধে হয় বৈ-কি!

শরীরে জামাকাপড় আছে। অতএব আপনি ভালো আছেন।এলজিআরডি মন্ত্রীর এই ‘ভালো থাকা’ তত্ত্বের সাথে আপনি কি একমত? ফিবছর জাকাতের কাপড় বিলি হওয়া নিয়ে যে হৈ-চৈ হয় তা কি আসলে ভালো থাকারই নমুনা? জাকাতের শাড়ি, লুঙ্গি পরে যারা নিজেদের ইজ্জত ঢাকেন এই বক্তব্য তাদের জন্য উপহাস কি-না? এসব মানুষের কান্না কেন শুনতে পাবেন না পল্লী উন্নয়নের দায়িত্ব যেসব নীতিনির্ধারকেরা পেয়েছেন?

না খেয়ে কেউ মারা যায়নি, অতএব সবাই ভালো আছেন। পরিকল্পনামন্ত্রীর এই উক্তিই বা কতটা যথার্থ? তিন বেলা খেতে পাওয়াকেই ভালো থাকা কেন মানতে হবে? যদি প্রশ্ন করি, এই মানুষগুলো মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে তো? এদের শিক্ষা সুবিধা নিশ্চিত আছে তো? শতভাগ মানুষের নিজস্ব আবাসের জন্য এখনো কেন দৌড়ঝাঁপ করতে হয়? কেন চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ন্যূনতম ৩০০ টাকা করার দাবিতে দিনের পর দিন আন্দোলন করতে হচ্ছে? কেন আজও খেতে দিতে না পারার যন্ত্রণায় মা সন্তানকে বিক্রি করে দিতে চেয়ে পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছেন?

ধর্মপ্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান কি জানেন না যে আটার মতো চালের মূল্যও বেড়েছে? তাহলে কেন তিনি পরামর্শ দিলেন, আটার পরিবর্তে চালের রুটি খাওয়ার? যে পরামর্শ কোনো কাজে আসবে না উল্টো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে সেই কথা কি সরকারের দায়িত্বশীলদের বলা উচিত?

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জসহ সাম্প্রতিককালে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের ইস্যুগুলো নিয়ে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর কোনো বক্তব্য কি জনগণের আস্থা কুড়োতে পেরেছে? বরং তাঁর কথা বলার কায়দা নিয়ে উল্টো ঘরে-বাইরে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

সরকারের নীতিনির্ধারকরা দায়িত্বপূর্ণ, যুক্তিপূর্ণ কথা বলবেন, এটি কোনো বাড়তি প্রত্যাশা? মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী যদি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বাঁকা কথা বলেন তা কিন্তু আসলে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতোই মনে হয়। এই যন্ত্রণা মনে তীব্রভাবে গেঁথে যায়।

কে না জানে পুরো বিশ্বই এক ধরনের অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে! এই কঠিন অবস্থার আঁচ আমাদের গায়েও লাগবে এটাই স্বাভাবিক। সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে, করবে এটা স্বাভাবিক। তাই মানুষের দুঃখ, কষ্ট নিয়ে নেতিবাচক কথা বলা দায়িত্বপ্রাপ্তদের একেবারেই উচিত হবে না।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বরাবরের মতো এখানেও এগিয়ে। তিনি ঠিকই মানুষের আবেগ, অনুভূতি বোঝেন, বুঝতে পারেন। তাই তো তিনি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল কণ্ঠে সাধারণ মানুষের সমস্যাকে ‘অ্যাড্রেস’ করেছেন। কিভাবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি থেকে সাধারণ মানুষকে রেহাই দেওয়া যায় সে ব্যাপারে তাঁর চেষ্টা, উদ্যোগ আর আন্তরিকতার কথা বলেছেন। মানুষকে স্বস্তি দিতে, ভালো রাখতে তাঁর শতভাগ কমিটমেন্টের প্রতি আমাদেরও অবিচল আস্থা।

শুধু আর্জিমুখর কিছু মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী যেন নিজ বিষয়ের বাইরে অন্য কিছু বলে সাধারণ মানুষের বিরক্তির কারণ না হন। এই চাওয়া কি খুব অযৌক্তিক?

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ঢাকা টাইমস, ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকম ও সাপ্তাহিক এই সময়