এক দশক ধরে সাইফুল ও এনামুলের শিকলবন্দী জীবন

প্রকাশ | ১৮ আগস্ট ২০২২, ১০:৫৯

আজহারুল হক, ময়মনসিংহ
শিকলবন্দী সাইফুল ইসলাম ও এনামুল হক (ছবি: ঢাকাটাইমস)

প্রথম দেখাতে মনে হবে সুস্থ দুজন তরুণ। কিন্তু কাছে গেলেই বোঝা যায় অন্য মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবন নয় তাদের। মানসিক ভারসাম্যহীন হওয়ায় গত ১০ বছর ধরে শিকলবন্দী সাইফুল ইসলাম (১৯) ও এনামুল হক (২২) নামে দুই তরুণ। দীর্ঘ এক দশক ধরে এভাবেই কাটছে তাদের জীবন।

মানসিক ভারসাম্যহীন এনামুলের বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার রাজিবপুর ইউনিয়নের সুতিভরাট গ্রামে। ওই গ্রামের বর্গাচাষি মজিবুর রহমান ও আসমা দম্পতির চার ছেলের মধ্যে দ্বিতীয় তিনি। 

অপরদিকে সাইফুল একই ইউনিয়নের ঘাগড়া গোপালপুর গ্রামের কৃষক জাহের আলী ও রাহেনা আক্তার দম্পতির দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সবার ছোট তিনি। 

প্রতিবেশীরা জানান, এনামুল ও সাইফুল আশপাশের মানুষের ক্ষতি করে। তাই বাধ্য হয়ে পরিবারের লোকজন তাদের পায়ে শিকল পরিয়ে রাখেন। তাকে গত ১০ বছর ধরে শিকলবন্দী করে রাখা হয়েছে।

এনামুলের মা আসমা খাতুন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মানুষের ক্ষতি করলে তারা নালিশ করে, নানা কটু কথা শুনায়। ছেলেরে বাধ্য হইয়া বাইন্ধা থই (বেঁধে রাখি)।’

এনামুলের বাবা মজিবুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ছেলের বয়স যখন ১০ বছর তখন তারা বুজতে পারেন ছেলে অন্যদের মতো সুস্থ না। পরে অনেক কবিরাজি চিকিৎসা করেন। সর্বশেষ জেলার একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোমেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. শফিকুল ইসলামকে দেখান। গত ২০২০ সালের ১৮ আগস্ট ডাক্তার দেখানোর পর অর্থের অভাবে আর যেতে পারেননি। সে সময় চিকিৎসক জানিয়েছিলেন চিকিৎসা চললে সুস্থ হয়ে যাবে এনামুল।’ 
 
অপরদিকে মানসিক ভারসাম্যহীন সাইফুলকে নিয়েও তার পরিবার বিড়ম্বনায় রয়েছেন। জন্মের ছয় বছর বয়স পর্যন্ত সাইফুল ভালো থাকলেও হঠাৎ একদিন খিঁচুনি শুরু হয়। সেই থেকেই সমস্যার শুরু। খিঁচুনির পরই পাগলামি শুরু করে সাইফুল। 

পরিবার জানায়, এলাকাসীর কথায় প্রথমে কয়েক বছর বিভিন্ন কবিরাজ ও কথিত পীরের বাড়িতে গিয়ে ঝারফুক ও তাবিজ দিয়েছেন। কিন্তু কোনো পরিবর্তন না হওয়ায় ময়মনসিংহের বেশ কয়েকজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দেখান। কয়েক বছর চিকিৎসাও চলে। 

পরিবার আরো জানায়, অন্তত পাঁচ কাঠা জমি বিক্রি করতে হয়েছে সাইফুলের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে। কিন্তু গত চার বছর ধরে সকল চিকিৎসা বন্ধ করতে বাধ্য হয় পরিবার। বাবা জাহের আলী শারীরিকভাবে অসুস্থ হওয়া এবং অর্থের অভাবে আর ছেলের চিকিৎসা চালাতে পারেনি তার পরিবার। 

সাইফুলের মা রাহেনা খাতুন ঢাকাটাইমসকে জানান, ‘তার ছেলে মানুষের ঘরবাড়ি-ফসল নষ্ট করে ফেলে। একদিনে এলাকার ১৮টি টিউবয়েল নষ্ট করে ফেলে, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে আগুন দেয়। এছাড়া নিজের ঘরবাড়িও তছনছ করে ফেলে। ছেলের পাগলামির কারণে বাধ্য হয়ে পায়ে শিকল পরিয়ে রাখতে হয়। 

তিনি বলেন, ‘ছেলেকে শিকল পরাতে কষ্ট হয়। কিন্তু শিকল না পরালে সে আমাদেরকেও মারধর করে। তার চিকিৎসা করাতে গিয়ে আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। এখন আর চিকিৎসা করানো সম্ভব না।’

রাজিবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল আলী ফকির ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘পরিবারগুলো বাধ্য হয়ে শিকল পরিয়ে রেখেছে নিজেদের সন্তানের পায়ে। এদের চিকিৎসায় সরকার ও বিত্তবানদের এগিয়ে আসা উচিৎ।’  

(ঢাকাটাইমস/১৮আগস্ট/এসএম)