অব্যাহতি পাওয়া এমপি পাপুলকে নিয়ে দুদকের অনুসন্ধান, তদন্ত ও মামলার কী হলো? অগ্রগতি কতদূর?

প্রকাশ | ১৯ আগস্ট ২০২২, ০৯:৫৯

সৈয়দ ঋয়াদ, ঢাকাটাইমস

অর্থ ও মানব পাচারের অভিযোগে দণ্ডপ্রাপ্ত ও সংসদ সদস্য পদ হারানো লক্ষ্মীপুর-২ আসনের কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল এখন কুয়েতের কারাগারে সাজা খাটছেন। সংসদ সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি পাওয়া পাপুল ও তার পরিবারে সদস্যদের অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

দীর্ঘদিন ধরে পাপুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করছে দুদক। এ বিষয়ে সংস্থাটির পরিচালক (বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত-২) সৈয়দ ইকবাল হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, পাপুল ও তার পরিবারে সদস্যদের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধোনের বিষয়ে কাজ চলছে। আমরা তার সম্পদ বিবরণী দাখিলের বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কুয়েতে চিঠি পাঠিয়েছি। কিন্তু এর কোনো উত্তর এখনো পাইনি।

দুদকের এই পরিচালক বলেন, পাপুল, তার স্ত্রী, কন্যা ও শ্যালিকাসহ দুদকে হওয়া মানি লন্ডারিং মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেওয়ার জন্য নতুন নিয়ম অনুযায়ী পিপির কাছে আবেদন করতে হয়, আমরা সেটা করেছি। শিগগিরই অবৈধ সম্পদের মামলার চার্জশিট দেওয়ার বিষয়টি জানা যাবে।

পাপুলের স্ত্রী সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি সেলিনা ইসলাম ও তার মেয়ে ওয়াফা ইসলামের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করছেন দুদকের উপপরিচালক মোনায়েম হোসেন। দুদকের এই কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘তাদের সম্পদের হিসাব ও মেজারমেন্ট সংক্রান্ত কাজ চলছে। এটা শেষ পর্যায়ে।’ অনুসন্ধান কাজ শেষ হলে পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য কমিশনে আবেদন করবেন বলে জানান এই কর্মকর্তা।

২০২০ সালের ১১ নভেম্বর অবৈধ সম্পদ অর্জন ও ১৪৮ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে দুদকের উপপরিচালক মো. সালাউদ্দিন বাদী হয়ে পাপুল ও তার স্ত্রী সংসদ সদস্য সেলিনা ইসলাম, মেয়ে ওয়াফা ইসলাম ও শ্যালিকা জেসমিন প্রধানকে আসামি করে মামলা করে দুদক। এই মামলায় প্রধান আসামি করা হয় তার শ্যালিকাকে।

এছাড়া ২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বর অর্থ পাচারের অভিযোগে পাপুলসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে রাজধানীর পল্টন থানায় আরো একটি মামলা করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সিআইডির মামলায় তাদের বিরুদ্ধে ৩৮ কোটি ২২ লাখ ৪০ হাজার ৫৬৭ টাকা পাচারের অভিযোগ আনা হয়।

পাপুল ছাড়াও মামলার অপর পাঁচ আসামি হলেন- পাপুলের মেয়ে ওয়াফা ইসলাম, শ্যালিকা জেসমিন প্রধান, ভাই কাজী বদরুল আলম লিটন, ব্যক্তিগত কর্মচারী মোহাম্মদ সাদিকুর রহমান মনির এবং জব ব্যাংক ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপক গোলাম মোস্তফা। ওই মামলায় পাপুলের ভাই ও শ্যালিকার দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও এই মামলা করা হয়েছে।

অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলায় ২০২০ সালের ২৭ ডিসেম্বর ঢাকার সিএমএম আদালতে আত্মমর্পণ করে জামিন নেন সেলিনা ইসলাম ও তার মেয়ে ওয়াফা ইসলাম। এ সময় লক্ষ্মীপুরের সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্য সেলিনা ইসলামসহ চারজনের ৬১৭টি ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ এবং ৯২টি তফসিলভুক্ত স্থাবর সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দেওয়া হয়।

এদিকে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) মামলা ঝুলছে পাপুলের স্ত্রী সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য সেলিনা ইসলাম ও মেয়ে ওয়াফা ইসলামের বিরুদ্ধে। সেলিনা ইসলাম লক্ষ্মীপুর থেকে সংরক্ষিত আসনে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

পাপুল সংশ্লিষ্টতায় দুদক যাদের তলব ও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে:

লক্ষ্মীপুর-২ আসনের অপসারিত এমপি পাপুলের অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান পরভেজ তমাল ও ভাইস চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম মিয়া আরজু, ব্যাংকটির পরিচালক মোহাম্মদ আদনান ইমাম ও একেএম মোস্তাফিজুর রহমানকে গত বছরে সেপ্টেম্বরে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক।

অন্যদিকে পাপুলকে অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর পৌরসভা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক জামশেদ কবীর বাকিবিল্লাহ, লক্ষ্মীপুর জেলা যুবলীগ সভাপতি এসএম সালাহউদ্দিন টিপু, লক্ষ্মীপুর জেলা পরিষদ সদস্য শাখাওয়াত হোসেন আরিফ এবং লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি (বর্তমান সংসদ সদস্য)  নুরুদ্দিন চৌধুরী নয়নের সম্পদের হিসাব চেয়ে চিঠি পাাঠায় দুদক।

দুদকের নথিতে পাপুল:

রাজনীতিতে ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সাংসদ পাপুলকে নিয়ে কুয়েতি পত্রিকার তথ্য মতে, ১৫ থেকে ২০ হাজারের মতো লোককে কাজের জন্য কুয়েত নিয়ে যায়, যা থেকে তিনি আয় করেন প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা। প্রবাসীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি।

দুদক সূত্রে জানা যায়, এছাড়া কাজী শহিদুল ইসলাম পাপুলের বিরুদ্ধে ১৭৪ পাতার অভিযোগ জমা হয়েছে। দুদকের নথিতে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি অবৈধভাবে লোন বরাদ্দ, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ মানি লন্ডারিং করে বিদেশে পাচার এবং শত শত কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন। পাপুল এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের একজন পরিচালক। স্ত্রীর নামে একই ব্যাংকের ৩০ কোটি টাকার শেয়ার কিনে তাকে অংশীদার করেছেন তিনি।

দুদকে জমা পড়া অভিযোগে বলা হয়, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালক পাপলু ২০১৬ সালে বাংলাদেশ থেকে ২৮০ কোটি টাকা পাচার করেন হুন্ডি ও বিভিন্ন ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে। এর মধ্যে ১৩২ কোটি টাকা মার্কেন্টাইল ব্যাংকের মতিঝিল শাখার একটি হিসাবের মাধ্যমে, ৪০ কোটি টাকা প্রাইম ব্যাংকের এক কর্মকর্তার মাধ্যমে, ১০ কোটি টাকা একই ব্যাংকে ঋণ সৃষ্টি করে ও ১০ কোটি টাকা ইউসিবিএলের মাধ্যমে পাচার করা হয়।

পাপুলের যেসব সম্পত্তির তথ্য দুদকের কাছে জমা পড়েছে, এর মধ্যে রয়েছে গুলশান-১-এর ১৬ নম্বর সড়কে গাউসিয়া ডেভেলপমেন্টের প্রকল্পে মেয়ে ও স্ত্রীর নামে দুটি ফ্ল্যাট, গুলশান-২-এর পিংক সিটির পেছনে গাউসিয়া ইসলামিয়া প্রকল্পে স্ত্রীর নামে ৯০০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, স্ত্রী ও নিজের নামে লক্ষ্মীপুরের রায়পুরসহ বিভিন্ন স্থানে পাপুলের ৯১ কোটি টাকার সম্পদ আছে বলে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।

এ ছাড়া সোনালী ব্যাংকের ঢাকার ওয়েজ আর্নার্স শাখায় স্ত্রীর নামে ৫০ কোটি টাকার ওয়েজ আর্নার বন্ড ও মেয়ের নামে ২০ কোটি টাকার বন্ড আছে। শ্যালিকার নামে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে দুটি বিলাসবহুল গাড়ি কিনে নিজে ব্যবহার করছেন। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে নিজ নামে ৪০ কোটি, মেয়ের নামে ১০ কোটি ও স্ত্রীর নামে ২০ কোটি টাকার স্থায়ী আমানত রয়েছে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় স্ত্রীর নামে একটি ছয়তলা বাড়ি আছে।

কুয়েতের কারাগারে পাপুল:

২০২১ সালে ২৮ জানুয়ারি মানব ও অর্থ পাচারের দায়ে বাংলাদেশের সাংসদ কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলকে চার বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয় কুয়েতের আদালত। এর পাশাপাশি তাকে ১৯ লাখ কুয়েতি দিনার বা ৫৩ কোটি ১৯ লাখ ৬২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া মানব পাচারের অন্য একটি মামলায় তার আরো তিন বছরে সাজা ও ২০ লাখ দিনার জরিমানা করা হয়।

২০২০ সালের ৬ জুন কুয়েতের গোয়েন্দা সংস্থার হাতে গ্রেপ্তার হন প্রবাসী বাংলাদেশি এই ব্যবসায়ী। গ্রেপ্তারের পর তাকে কয়েক দফা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে বিদেশি সংস্থাটি। ওই বছরের ১৭ জুন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়।

কুয়েতে সাজা হওয়ার এক মাস পর রায়ের কপি বাংলাদেশে এলে গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি সংসদ সচিবালয় থেকে পাপুলের পদ বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। নৈতিক স্খলনজনিত কারণে সংসদ সদস্য পদ হারান পাপুল।

(ঢাকাটাইমস/১৮আগস্ট/এসআর/কেএম)