মধ্যবিত্তের চাপাকান্না!

রিফাত কান্তি সেন
 | প্রকাশিত : ১৯ আগস্ট ২০২২, ১৭:১৯

একটা পরিসংখ্যান করে দেখব কি না ভাবছিলাম। পরে আবার মনে হলো পরিসংখ্যানের কিছু নেই। চোখ বন্ধ করেই বলে দেয়া যায় এ দেশে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যা বেশি। ছোটবেলা থেকে অভাব নিয়ে বড় হয়েছি। এটা কিনলে ওটা কেনা যেত না, এটা তো বহু আগ থেকেই প্রচলিত ছিল আমাদের পরিবারের। তবে তিন বেলা খাবার খাওয়ার পর কিছু টাকা সঞ্চয় করা যেত। হায় কপাল বর্তমানে সঞ্চয় তো আকাশ-কুসুম কল্পনা। নুন আনতে যেখানে পান্তা ফুরায় সেখানে আবার সঞ্চয়!

বাংলাদেশ বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে টিকে থাকা একটি দেশ। এর ইতিহাস ছিল লড়াই আর লড়াই। হারের চেয়ে জিতেছে এ জাতি বেশি। কিন্তু বর্তমানে কেমন যেন হতাশায় ডুবে আছি। এত গল্প করার কী দরকার! মূল কথা হলো আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের মিল খুঁজে পাচ্ছি না। হুটহাট দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে কিছুটা বিপাকেই আছে জনগণ। তবে এর বেশির ভাগ প্রভাবটা পড়ছে মধ্যম ও নিম্ন আয়ের লোকদের ওপর।

জাতি হিসেবে আমরা বীর হলেও আমাদের মাঝে বীরত্ব বলে কিছু নেই। ‘নিজে খাও নিজে বাঁচো’ নীতিতে আছি বলেই হুটহাট করে মানুষের ওপর বোঝা চাপিয়ে দেই আমরা। এ দেশের ব্যবসায়ীরাও সুযোগসন্ধানী। সুযোগ পেলেই বাড়িয়ে দিতে জানে। বেশি মুনাফা লাভের আশায় জনগণের ভোগান্তি তৈরিতেও পারদর্শী তারা।

বিশ্ববাজারের দোহাই দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী থেকে শুরু করে কোনটার দাম বাড়েনি বলুন। হ্যাঁ, বাড়েনি মানুষের দাম। সবজির বাজারে যাওয়া যায় না, মুদি দোকানে যাওয়া যায় না। মাছের বাজারে আগুন, মাংসের কথা বাদই দিলাম।

সপ্তাহ দুয়েক আগের কথাই বলি। হুট করে তেলের দাম বাড়ানো হলো অতিমাত্রায়। পেট্রল, অকটেন, ডিজেল আর কেরোসিন এক লাফে সেঞ্চুরি করে ফেলল। ব্যবসায়ীরা খুশিতে ফিলিং স্টেশন বন্ধ করে ছুটল। ঈদের ওপর শুক্রবার! লাভ আর লাভ। আর এদিকে মধ্যবিত্তের হার্টবিট বেড়ে গিয়েছেল ততক্ষণে।

তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে বাড়ানো হলো বাস ও লঞ্চ ভাড়া। এতেই কি ক্ষান্ত নাকি! সবাই সুযোগ বুঝে নিজেদের পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিল কয়েক গুণ। আর সব বোঝা এসে পড়ল মধ্যবিত্তের ঘাড়ে। সবকিছু বাড়ে, বাড়ে না মধ্যবিত্তের রুটি-রুজি। বেতনভুক্ত মধ্যবিত্ত তো আরো যাঁতাকলে। সব বাড়ে, বাড়ে না বেতন। স্কিল যেখানে আছে সেখানেই থেমে থাকে। এদিকে মাস শেষে খরচের হিসাব মেলাতে হিমশিম খেতে গিয়ে নীরবে চাপাকান্না করে। কে বুঝবে এ কষ্ট?

ও, একটা কথা বলে রাখি। মধ্যবিত্তরা কিন্তু ভিনগ্রহের। এদের আত্মসম্মান খুব বেশি। এরা কারো কাছে ছোট হতে পারবে না, লজ্জায় নিজেদের গোপন অসহায়ত্বের কথা বলতে পারবে না। এরা বুক ফুলিয়ে বাঁচতে হবে, ঘরে ভালো খাবার নেই এটিও জনসমক্ষে বলা যাবে না, কারণ সে মধ্যবিত্ত। সমাজ তাকে ছোট হওয়ার সার্টিফিকেট দেয়নি। সে নীরবে-নীভৃতে মার খেয়ে যাবে চোখ বুঝে।

করোনার পরে দেশে অনেক কিছু বদলেছে। বেকারের সংখ্যা বেড়েছে। কর্মহীন হয়েছেন অনেকে। ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি এমন মানুষের সংখ্যাও বহুত। আবার অপর দিকে কেউ কেউ সুযোগ বুঝে বনে গেছেন কোটিপতি। কর ফাঁকি থেকে শুরু করে ঋণখেলাপি কোনটা কমেছে দেশে? প্রতিটা সেক্টরে শুধু দুর্নীতির আভাস। দিন শেষে লোকসানটা মধ্যবিত্তের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারলে খুশি কর্তৃপক্ষ।

মধ্যবিত্তের অবস্থা এখন কলুর বলদের মতো। ঘানি টানি, আর চুপসে যাই। মারছে মারুক, যা ইচ্ছা করুক, প্রতিবাদ করে লাভ কী?

মাঝে মাঝে মনে হয়, এলিয়েনদের দেশে মধ্যবিত্তদের একসময় আবাসস্থল হবে। কারণ এখানে টিকে থাকবে দুর্নীতিবাজ, দালাল, তেলমারা শ্রেণি। বাংলাদেশ মধ্যবিত্তের জন্য পারফেক্ট জায়গা নয়। এটা এখন বড়লোকের দেশ হয়ে গেছে। এখানে টিকে থাকতে হলে চোখের লজ্জা পকেটে রাখতে হবে।

এখানে সব বাড়ে, শুধু বাড়ে না মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার মান। বাড়ে না মধ্যবিত্তের বেতন, বাড়ে না মধ্যবিত্তের সম্পদ। শুধু বাড়ে নিত্যপণ্যের দাম আর এক বুক হতাশা।

লেখক: সংবাদকর্মী।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :