বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন: একটি রাষ্ট্রদার্শনিক পর্যালোচনা

বেল্লাল আহমেদ ভূঞা (অনিক)
 | প্রকাশিত : ২০ আগস্ট ২০২২, ১৭:২৪

উন্নয়ন একটি জটিল ও বহুমাত্রিক বিষয়। সাধারণত উন্নয়ন ধারণার সাথে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু জাতীয় আয়কে পরিমাপক হিসেবে ধরা হয়। যে কোনো অবস্থার কাঙ্খিত বা ইতিবাচক পরিবর্তনই উন্নয়ন। অর্থাৎ উন্নয়ন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে একটি দেশের মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, ভৌত অবকাঠামো, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশ রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ের ইতিবাচক পরিবর্তনকে নির্দেশ করে।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুশাসন, স্বাধীনতা, পরিবেশ, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ইত্যাদি সবকিছুই উন্নয়ন দর্শনের সাথে সংশ্লিষ্ট। উন্নয়ন দর্শনে উন্নয়নকে একটি সমন্বিত পদ্ধতি হিসেবে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করে। উন্নয়নকে বৈশ্বিক ও স্থায়ীত্বশীলতার দৃষ্টিতে দেখে উন্নয়নের মানবিকীকরণ করতে হবে। আত্মকেন্দ্রিকতার পরিবর্তে যদি উন্নয়ন দর্শনে সামগ্রিক কল্যাণ সাধনের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় তবে পৃথিবীটা আরো মানবিক হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনদর্শন ও রাজনৈতিক দর্শনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে উন্নয়ন দর্শন। বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন, রাজনৈতিক দর্শন এবং উন্নয়ন দর্শন পরস্পর পরিপূরক। বঙ্গবন্ধুর পলিটিক্যাল ফিলসফি বা রাষ্ট্রদর্শনের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে মানবতাবাদী অসাম্প্রদায়িক চেতনায় শোষণমুক্ত- বৈষম্যহীন উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে- “আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।” সংবিধানের শীর্ষে সংযুক্ত প্রস্তাবনার এই গুরুত্বপূর্ণ অংশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উন্নয়ন দর্শনের মৌলিক উপাদানগুলো পাওয়া যায়।

বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনের বিভিন্ন উৎস পাওয়া যায় ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত বিভিন্ন ভাষণ, আওয়ামী লীগের ঘোষিত কর্মসূচি, ১৯৭০ এর নির্বাচনী ইশতেহার, ১৯৭২ এর মূল সংবিধান, ১৯৭২-১৯৭৫ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁর গৃহীত পদক্ষেপ, তাঁর গ্রন্থ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ‘কারাগারের রোজনামচা’ ‘আমার দেখা নয়া চীন’ গ্রন্থসহ বিভিন্ন গবেষণাধর্মী পত্রিকা ও নানা কর্মকান্ডের মাধ্যমে তাঁর উন্নয়ন দর্শন সম্পর্কিত চিন্তা-চেতনা, পরিকল্পনা ও প্রায়োগিক দিকগুলো ফুটে ওঠে।

বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনে ছিলো মানবিক উন্নয়ন, যেখানে মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে সম্পদের সুষম বন্টন ও বৈষম্যহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে গণমানুষের সর্বোচ্চ কল্যাণ নিশ্চিত করা। জাতি-ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ, বয়স-পেশা নির্বিশেষে সব মানুষের সুযোগের সমতা নিশ্চিত করার কথা তিনি উন্নয়ন দর্শনে বলেছেন। বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন ভাবনায় ছিল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মানুষের জীবনমানের পরিবর্তন, দারিদ্র্য দূরীকরণ, শিল্পের বিকাশ, কৃষির আধুনিকায়ন, উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠ ব্যবহার, স্বাস্থ্য সেবার মান বৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন, সমাজের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূলধারায় যুক্ত করা, দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি, সুশাসন প্রতিষ্ঠা সর্বোপরি বাঙালি জাতিকে কিভাবে আত্মনির্ভরশীল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যায় সেই চিন্তা ও পরিকল্পনা।

বঙ্গবন্ধুর আজীবন লালিত স্বপ্ন ছিল বাংলার স্বাধীনতা এবং গণমানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি। স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক মুক্তি পরস্পর পরিপূরক। বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বলেন: “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। বঙ্গবন্ধু এখানে মুক্তি বলতে অর্থনৈতিক মুক্তিকে বুঝিয়েছেন। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু ভাষণে বলেন-“ রাজনৈতিক স্বাধীনতা যদি ব্যর্থ হয়ে যায়, যদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না আসে। যদি দু:খী মানুষ পেট ভরে ভাত খেতে না পারে, কাপড় পরতে না পারে, বেকার সমস্যা দূর না হয়, তাহলে মানুষের জীবনে শান্তি ফিরে আসতে পারে না।” আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রতিশ্রুতি ছিল বৈষম্য হ্রাস, মানব মুক্তি, সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং সর্বস্তরে গণমানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা।

এক্ষেত্রে আমরা বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক ভাবনার সাথে নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের সাদৃশ্য পাই। কল্যাণমুখী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন মনে করেন স্বাধীনতা হচ্ছে উন্নয়নের মাধ্যম ও লক্ষ্য। স্বাধীনতা নিশ্চিত করলেই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে। তিনি বলেছেন, উন্নয়নের প্রধান উপায় হচ্ছে মানুষের স্বাধীনতা। উন্নয়নের যে পাঁচটি আবশ্যিক শর্তের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন সেগুলো হচ্ছে- সামাজিক সুযোগ, রাজনৈতিক সুযোগ, বাজারের সুযোগ, পদ্ধতিগত সুযোগ এবং অসহায় শ্রেণীর সুরক্ষার স্বাধীনতা। ড. সেন তাঁর ‘ডেভেলপমেন্ট এজ ফ্রিডম’ গ্রন্থে এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন মানবতাবাদ ও মানবিক উন্নয়ন বাদ দিয়ে অর্থনৈতিক চর্চা মানবকল্যাণ সাধন করে না। তিনি মনে করেন মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধি ছাড়া কোন উন্নয়ন হতে পারে না।

বঙ্গবন্ধু জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্যবাদে বিশ্বাসী। ১৯৭৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত চতুর্থ জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে জাতির পিতা শেখ মুজিব বিশ্বের নিপীড়িত, লাঞ্ছিত, দু:খী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বলেন: “বিশ্ব দু’ভাগে বিভক্ত, শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের দলে।” তিনি চেয়েছেন শোষিতের গণতন্ত্র। বঙ্গবন্ধু সমতাভিত্তিক বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। ব্যক্তির মৌলিক ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষম বন্টনের কথা বলেছেন।

বাঙ্গালির আর্থসামাজিক মুক্তি তথা সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করেছেন। রাষ্ট্রদার্শনিক শেখ মুজিব যুদ্ধবিদ্ধস্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে নতুন স্বপ্ন, নব উদ্যমে, দৃঢ় সংকল্প ও প্রত্যয়ে স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবার পর (১৯৭২-১৯৭৫) মাত্র সাড়ে তিন বছর রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলেন। এ সময়ের মধ্যে কলকারখানায় কিভাবে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব, দক্ষ মানব সম্পদ সৃষ্টি এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা কেমন হবে এসব বিষয়ে মৌলিক চিন্তা ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। যার মূল লক্ষ্য ছিল দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কৃষিতে বৈপ্লবিক উন্নয়ন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতাসহ সামগ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনা।

বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনে ছিল শিল্প বিশেষ করে গ্রামীণ শিল্পের উত্থান, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে বেকারত্বের সমস্যা সমাধান করা। শ্রমজীবী মানুষ ও কৃষকদের কল্যাণে সমবায় ও অন্যান্য উদ্ভাবনী প্রক্রিয়ায় গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি পারিবারিক জমি অধিকার সীমা ব্যবস্থার প্রবর্তন করে জমির মালিকানা ব্যবস্থার সংস্কার করেছিলেন। কৃষি ও কৃষকের ভাগ্য উন্নয়নে তিনি ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করেন। ধ্বংসপ্রাপ্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষা ব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও বিনামূল্যে বই বিতরণ, পাকিস্তানীদের পরিত্যক্ত ব্যাংক, বীমা ও ৫৮০ টি শিল্প প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণসহ সুষ্ঠ পরিকল্পনা ও যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে একটি আত্মনির্ভরশীল রাষ্ট্রে উন্নীত করার দিকে এগিয়ে যান। ১৯৭৪-৭৫ সালে সামষ্টিক অর্থনীতির বার্ষিক প্রবৃদ্ধি শতকরা ৭.৮ ভাগে উঠে যায়। তিন বছর সাত মাসের শাসনকালে বঙ্গবন্ধু লন্ডভন্ড ভঙ্গুর অর্থনীতির অনুন্নত দেশকে ১৯৭৫ সালে স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদায় উন্নীত করেন। অধিক খাদ্য উৎপাদন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতি নির্মূল- এ পাঁচটি কর্মসূচী বাস্তবায়নের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার দৃঢ়সংকল্প ব্যক্ত করেছেন।

বঙ্গবন্ধু বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বাঙালি জাতিকে আত্মনির্ভরশীল করার লক্ষ্যে অর্থনৈতিক নীতিমালাকে নব উদ্যমে সাজানোর প্রয়াসী হন। স্বাবলম্বিতা অর্জনের লক্ষ্যে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামের আহবান জানান। ১৯৭৫ সালের ১৯ জুন বঙ্গভবনের দরবার হলে বঙ্গবন্ধু এক ভাষণে বলেন: “বিদেশ হতে আমদানি করা ‘ইজম’ বা ‘সিস্টেম’ নহে, দেশের মাটির সাথে সংযোগ রাখিয়াই শোষণহীন সমাজ গড়ব।” সুতরাং বঙ্গন্ধুর উন্নয়ন দর্শনটি তাঁরই নিজস্ব অভিজ্ঞতা, চিন্তা-চেতনায় উদ্ভাবিত তত্ত্ব যাকে “দেশজ উন্নয়ন দর্শন” (Home grown development philosophy) নামে অভিহিত করা যায়। এ দর্শন অনুসারে প্রকৃত উন্নয়ন হলো একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া যা মানবীকরণের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বিশ্লেষণ করে। দেশজ উন্নয়ন দর্শন বাস্তবায়নের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, বৈষম্যহীন, সমতাভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা বিনির্মাণ করতে চেয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনে ছিল একটি শোষণহীন, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করা। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে তাঁর সুযোগ্য তনয়া সফল রাষ্ট্রনায়ক দেশরত্ন শেখ হাসিনার দূরদর্শী অর্থনৈতিক দর্শন ও অসীম সাহসী গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে এক বিস্ময়ের নাম। ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে একদিন যে দেশকে অবজ্ঞা করা হয়েছে সে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের ৪১ তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ Cornell University র অধ্যাপক কৌশিক বসু তাঁর ‘Why is Bangladesh Booming’ লেখাতে বাংলাদেশের অভাবনীয় অর্জনকে ‘One of Asia’s most remarkable and unexpected success stories’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

জাতির পিতার উন্নয়ন দর্শনকে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার উন্নয়ন অভিযাত্রা কবিগুরুর ভাষায়- ‘আলোর নৌকা ভাসিয়ে দিয়েছেন আকাশ পানে চেয়ে’। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সরকার গঠন করে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার এক নবদিগন্ত উন্মোচন করেন। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, দারিদ্র্য বিমোচনে অগ্রগতি, গঙ্গার পানিচুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তি, বয়স্কভাতা চালুকরণ, যমুনা নদীর উপর বঙ্গবন্ধু সেতু উদ্ভোধন, নারীর ক্ষমতায়নসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠনে সফলতা অর্জন করেন। পরবর্তীতে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে দিনবদলের ঘোষণা দিয়ে ২০০৯ এ সরকার গঠন করে গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য শুধু উন্নয়নের রোল মডেল নয়, একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবেও অনুকরণীয়।

গত ১৩ বছরে মাথাপিছু আয় ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরের ৫৪৩ মার্কিন ডলার হতে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার, দারিদ্র্যের হার ৪১.৫ শতাংশ হতে কমে ২০.৫ শতাংশ হয়েছে, বাজেটের আকার ২০০৫-০৬ অর্থ বছরের তুলনায় এগারো গুন বৃদ্ধি পেয়েছে, শতভাগ জনগোষ্ঠী আজ বিদ্যুতের আওতায় এসেছে। ২৫ জুন ২০২২ সফল রাষ্ট্রনায়ক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসীম সাহস ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আমাদের সক্ষমতা ও আত্মসম্মানের প্রতীক ‘পদ্মা সেতু’ শুভ উদ্বোধনের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে বিশ্বে আমাদের অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেলেন। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের একুশটি জেলার জনগণের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলো ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ১৮.২ মিটার প্রস্থের পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে। এছাড়া দেশে উল্লেখযোগ্য মেগা প্রকল্প কাজ চলমান রয়েছে। মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, গভীর সমুদ্র বন্দর, পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সমাপ্ত হলে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে স্বর্ণদূয়ার উন্মোচিত হবে।

বিগত দুই বৎসরের কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব কাটিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি যখন ঘুড়ে দাড়াচ্ছিলো ঠিক সে সময়ই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। করোনা-পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেল-গ্যাসের পাশাপাশি খাদ্যদ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিশ্ব বাজারে পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে আভ্যন্তরীণ বাজারের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতিশীল রাখা। এ সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের অত্যন্ত কৌশলী হতে হবে। আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে এ দেশের গণমানুষের দৃঢ় মনোবল আর অদম্য শক্তি। সর্বোপরি আমাদের নেতৃত্বে আছেন অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের এক অবিশ্বাস্য অভিযাত্রার কান্ডারী রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি- “The bigger the challenge, the greater the opportunity for growth.”বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিগত সময়ের ন্যায় রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক দর্শন ও দূরদর্শী নেতৃত্বে সকল চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।

পরিশেষে বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন প্রগতির পথনির্দেশক। বঙ্গবন্ধু আমাদের চিরন্তন প্রেরণার উৎস। তাঁর কর্ম, নীতি, আদর্শ ও দর্শন বেঁচে থাকবে অনন্তকাল। তাঁর উন্নয়ন দর্শনকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরী। বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন বিশ্লেষণ ও গবেষণা করে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে সোনার বাংলায় কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবো শোকের মাসে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার। শেষ করবো অন্নদাশঙ্কর রায়ের কবিতার লাইন দিয়ে-

“দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা রক্তগঙ্গা বহমান

নাই নাই ভয়

হবে হবে জয়

জয় মুজিবুর রহমান।”

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ, কেন্দ্রীয় কমিটি।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :