ঢাকা টাইমসকে আলোচিত সেই জজ মিয়া

ম্যাজিস্ট্রেট বলল সই করলে রাজসাক্ষী না করলে ফাঁসি

প্রকাশ | ২১ আগস্ট ২০২২, ০৯:৩৮ | আপডেট: ২১ আগস্ট ২০২২, ১১:৪৪

রুদ্র রাসেল, ঢাকাটাইমস

‘সাজানো জবানবন্দি নেয়া শেষে একটি কাগজ দেখিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে বলেন, “তুই সই কর। সই করলে তোকে রাজসাক্ষী করা হবে। না করলে তোর ফাঁসি হবে।” ভয়ে আমি সই করি। এরপর ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে বিরিয়ানি খাই। সেখান থেকে আমাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়া হয়। পরের দিন নেয়া হয় কাশিমপুর কারাগারে।’   

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় গ্রেপ্তারের পর আদালতে কথিত জবানবন্দি দেওয়ার আগের সেই আতঙ্কময় স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন জজ মিয়া। ২০০৫ সালের ২৬ জুন কথিত এই জবানবন্দি গ্রহণ করেন ঢাকার তৎকালীন মহানগর হাকিম জাহাঙ্গীর আলম।

শুক্রবার রাতে ঢাকাটাইমস-এর সঙ্গে কথা হয় বিনা দোষে পাঁচ বছর জেলের ঘানি টানা আলোচিত সেই জজ মিয়ার। তার আসল নাম মো. জালাল। নোয়াখালীর সেনবাগের বীরকোট গ্রামের এই জালালকে জজ মিয়া নাম দিয়ে সাজানো হয় ‘২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার জজ মিয়া নাটক’।
নাটকের শুরুটা সেনবাগে। বাড়ি থেকে থানায় ডেকে নিয়ে তাকে একটি মাদকের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর ঢাকার সিআইডিতে এনে নির্যাতন করে শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়।  
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে ওই বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ নিহত হন ২৪ জন। আহত হন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাসহ তিন শতাধিক নেতাকর্মী।

জজ মিয়া ঢাকা টাইমসকে বলেন, তিনি ভালো নেই। আর্থিক টানাটানিতে বিষিয়ে উঠেছে তার জীবন। কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন তার মা। গত বছর অসুস্থ হয়ে মারা গেছে তার শিশু ছেলেটিও। চিকিৎসা করাতে পারেননি। এখন স্ত্রী, এক মেয়ে ও বোনসহ চার সদস্যের পরিবার নিয়ে নারায়ণগঞ্জে বাস করছেন তিনি।

হাসপাতালসহ বিভিন্ন কারখানার ওয়েস্টেজ জিনিসপত্র ক্রয়কারী একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে যুক্ত রয়েছেন জজ মিয়া। ওই প্রতিষ্ঠানের কাজ থাকলে মাঝেমধ্যে জজ মিয়ার ডাক পড়ে। তখন কিছু উপার্জন হয়। তার বোন একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। এভাবে দুই ভাইবোনের আয়ে কোনোমতে চলছে জজ মিয়ার সংসার।

শরীরে নির্যাতনের পুরনো চিহ্ন এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন জজ মিয়া। স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য তাকে সিআইডি অফিসে সিলিংফ্যানে ঝুলিয়ে পায়ের তালুতে পেটানো হয়। জজ মিয়া বলেন, তাকে গ্রেপ্তারের পর ২১ দিনের রিমান্ডসহ মোট ২৭ দিন সিআইডি অফিসে রাখা হয়। এ সময় নির্যাতন করে সাজানো জবানবন্দি মুখস্থ করানো হয়। হামলাস্থলের ভিডিও দেখানো হয়। ভয় দেখানো হয় ক্রসফায়ারের, যেন তিনি সিআইডির সাজানো জবানবন্দি আদালতে স্বীকার করেন।
জজ মিয়া ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমিও তো ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত। ৫ বছর জেল খাটলাম। মুক্তি পাওয়ার পর আমাকে এ মামলার সাক্ষী বানানো হলো। একসময় যারা দেশ চালাত, সেই তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবরের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছি। অথচ এখনো আমি একটি চাকরির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। সরকারের কোনো সাহায্য পেলাম না।’

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় নিজের ক্ষতি পূরণের জন্য জজ মিয়া কিছুদিন আগে ১০ কোটি টাকা দাবি করে হাইকোর্টে রিট করেন। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘যদি সরকার দৃষ্টি দেয়, তাহলে ক্ষতিপূরণ পাব। এই কথাটাই একটু পত্রিকায় তুলে ধরবেন।’

সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম জজ মিয়াকে গাড়িচালকের একটি চাকরি দিয়েছিলেন। মোহাম্মদ নাসিমের সঙ্গে জজ মিয়ার পরিচয় হয় কারাগারে। তিনি মারা যাওয়ার পর চাকরিটিও চলে যায় জজ মিয়ার।

জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর একবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেখা পেয়েছিলেন জজ মিয়া। পুনর্বাসনের জন্য একটি আবেদন জমা দিতে এক আওয়ামী লীগ নেতাকে দায়িত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ওই নেতা আর কোনো ব্যবস্থা নেননি।

এরপর ১৩ বছর ধরে জজ মিয়া ঘুরছেন আরেকবার প্রধানমন্ত্রীর দেখা পেতে। গত বছর ১৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে একটি চিঠি জমা দিয়ে এসেছেন জজ মিয়া। চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় বিএনপি-জামায়াত কর্তৃক সাজানো নাটকের বানানো নায়ক কালের সাক্ষী আমি মো. জালাল (জজ মিয়া) এখন সহায়-সম্বলহীন জীবন-যাপন করছি।’

এই মামলার পর কোনো হুমকি পাচ্ছেন কি না, জানতে চাইলে জজ মিয়া বলেন, ‘ভয়ে-আতঙ্কে আছি। যাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছি, যাদের কাছে ক্ষতিপূরণ চেয়েছি, তারা তো একসময় দেশ চালাত। জীবনের নিরাপত্তা নেই। এখনো লুকিয়ে থাকি। তবু বর্তমান সরকারের কাছ থেকে কোনো আর্থিক সাহায্য পাইনি। আমার প্রতি কেন এত অবিচার?’

২০০৫ সালের ৯ জুন জজ মিয়াকে আটক করে নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে ঢাকায় আনেন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আবদুর রশিদ।

জজ মিয়া বলেন, ‘গ্রামের বাড়িতে চায়ের দোকানের টিভিতে হামলার বিষয়ে জানতে পারি। এর কিছুদিন পর হঠাৎ চৌকিদার এসে জানায়, থানায় যেতে হবে। আমি তার সঙ্গে থানায় যাই। পুলিশ বলে, মাদক মামলা হয়েছে। এরপর আমাকে ঢাকায় সিআইডি অফিসে আনা হয়। এসে শুনলাম গ্রেনেড হামলায় আমি জড়িত। চাপ দেয়া হয় স্বীকারোক্তি দেয়ার জন্য। নির্যাতন চালানো হয়।’
স্বীকারোক্তি দিতে রাজি হওয়ার পর জজ মিয়ার জন্য সিআইডি অফিসে নতুন লেপ-তোশক কেনা হয়। ভালো খাবার দেয়া হয় তাকে। জজ মিয়া বলেন, ‘প্রতি মাসে আমার পরিবারকে টাকা দেয়া হয়। কয়েক দিন পরপর এসপি রুহুল আমিনের কক্ষে পরীক্ষা নেয়া হয়, জবানবন্দি ঠিকভাবে মুখস্থ হয়েছে কি না।’
২০০৫ সালের ২৬ জুন আদালতে দেওয়া ওই কথিত স্বীকারোক্তিতে জজ মিয়া বলেছিলেন, পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে বড় ভাইদের নির্দেশে তিনি অন্যদের সঙ্গে গ্রেনেড হামলায় অংশ নেন। ওই বড় ভাইয়েরা হচ্ছেন শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, জয়, মোল্লা মাসুদ, মুকুল প্রমুখ।

জজ মিয়া বলেন, ‘এদের একজন সন্ত্রাসী জেলে আমাকে চিনে ফেলে। আমাকে বলে, কিরে জজ মিয়া আমার নামে এসব কথা বললি কেন। আমি তাকে বুঝিয়ে বলি।’

২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে এই গ্রেনেড হামলা মামলার নতুন করে তদন্ত শুরু করলে ২০০৮ সালের ১১ জুন জজ মিয়াকে বাদ দিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। এরপর মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে ২০০৯ সালের ২৭ জুলাই কারামুক্ত হন জজ মিয়া।

(ঢাকাটাইমস/২১আগস্ট/মোআ)