রাষ্ট্রপতির হাওর সফর ও দীপ্ত প্রত্যাশা

রফিকুল ইসলাম
 | প্রকাশিত : ২৩ আগস্ট ২০২২, ১৬:০৭

'আমার একার আলো সে যে অন্ধকার,/ যদি না সবারে অংশ দিতে পারি তার'... রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তেমনি এক মানবসত্তার মহীপাল।

তিনি আত্মচিন্তায় আবিষ্ট হয়ে নিজের অন্তরের উদারতাকে সীমায় বন্দি না করে আলোকিত মানুষের মহান দায়িত্ব নিয়ে সবাইকে নবচেতনায় উজ্জীবিত ও জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে হাওরাঞ্চলে শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন।

বিশ্বমানবের তরে হিরণ্ময় আলো বিলিয়ে দেওয়ার মধ্যে কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার গোপদিঘী ইউনিয়নে অবস্থিত শ্যামপুর দারুল উলুম দাখিল মাদরাসাটিও অন্যথা নয়। মাদরাসাটি আড়াই মাস ধরে পাঠদান বন্ধসহ অবকাঠামোগত অস্তিত্বহীন। আর দীর্ঘ বারো বছর ধরে চলে আসছে কাগজে-কলমে।

এক্ষেত্রে কী দেখা যায়? যেখান থেকে যাত্রা শুরু করা হয়েছিল সেখান থেকে কতটা এগোল? নাকি আরও এগিয়ে যাবার কথা ছিল? 'কিশোরগঞ্জ জেলার হাওর এলাকার নির্বাচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের উন্নয়ন' প্রকল্পে স্থান না পাওয়াসহ জেলা পরিষদের প্রায় এক কোটি টাকা বরাদ্দের ভবন ফেরত যাবার বিড়ম্বিত ভাগ্যবিপর্যয়ের একমাত্র অনুবন্ধ কারণ হলো মাদরাসাটি স্থায়ী জায়গায় না থাকা। একই কারণে রাষ্ট্রপতিপুত্র এমপি প্রকৌশলী রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিকের বিল্ডিংসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন বরাদ্দও ঝুলে আছে।

মাদরাসাটি ১৯৯৯ সালে শ্যামপুর গ্রামের মো. জজ মিয়ার (বর্তমানে প্রয়াত) ১০০ শতক জমি দানে প্রতিষ্ঠা পেলেও ২০১০ সালে এমপিওভুক্তির পর মাদরাসা পরিচালনা পরিষদের অগোচরে ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে সুপার নিজ এলাকা ধলাই-বগাদিয়ায় নিয়ে গিয়ে দীর্ঘ বারো বছর পর্যন্ত কুক্ষিগত করে রেখেছেন। জায়গা বদল করেছেন তিনবার। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের চরম ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও স্থায়ী চত্বর এড়িয়ে যাচ্ছেন। এ অন্যায়ের কেউ প্রতিবাদ করলে মামলায় জড়ানো হচ্ছে।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ২২ আগস্ট থেকে চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে নিজ জন্মস্থান ও সাবেক সংসদীয় আসন কিশোরগঞ্জ-৪ অর্থাৎ ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলায় রয়েছেন। সফরকালে প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ জনপ্রতিনিধি, সুশীল সমাজের সদস্য, পেশাজীবী ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় এবং হাওর এলাকার উন্নয়নকাজ পরিদর্শন করবেন।

নিরাপত্তা প্রটোকলের কারণে এই সফরের সময় কিংবা বঙ্গভবনে গিয়ে তাঁর সাথে সর্বসাধারণের সাক্ষাৎ করা ও কথা বলার সুযোগ কম। এর জন্য এলাকার অধিকারবঞ্চিত বিপুল জনগোষ্ঠীর দুঃখ দেখাবার জায়গাও নেই।

শ্যামপুর মাদরাসার সুপার মো. আমিনুল হকের অবাধ স্বেচ্ছাচারিতায় জমিদাতা মো. জজ মিয়াদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করা ছাড়াও শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ ও অভিভাবকদের স্বপ্ন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন, যে বিষয়টি রাষ্ট্রপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

জমিদাতা ও মাদরাসা পরিচালনা পরিষদের সাবেক সভাপতি মো. জজ মিয়া ও অপরাপর সদস্যদের সাথে প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়ে দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে তা নিরসন না করে বরং জুজু বানান সুপার মো. আমিনুল হক। এতে পরিচালনা পরিষদ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই ব্যক্তিস্বার্থে ২০১১ সালের পহেলা জানুয়ারিতে রাতারাতি মাদরাসাটি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় নতুন বগাদিয়া গ্রামের মো. নূরুল হক ভূঞার ধলাই-বগাদিয়া ব্যক্তি মালিকানাধীন বাজারে। সেখানে ছোট দুটি দোচালা টিনের ঘর উঠিয়ে এবতেদায়ী হতে দাখিল পর্যন্ত- এই দশটি শ্রেণি পাঠদান কার্যক্রম চালানো হয় কাগজে-কলমে।

ধলাই-বগাদিয়া বাজারে দীর্ঘ ৯ বছর অবস্থানের পর উচ্ছেদ হয়ে ধলাই গ্রামের খালেক মীর গংদের মুশুরিয়া মৌজার গভীর হাওরে গিয়ে নতুন করে ৪০ শতক নিচু জায়গায় উঠানো হয় মাদরাসাটি। ওখানে ২০ শতক নিচু জায়গায় মাটি ফেলে ভিটা বানিয়ে একটি টিনের ছাপড়া (ছোটঘর) উঠালেও তুফানে সেই ছাপড়া ও বেঞ্চসহ মাদরাসাটির আসবাবপত্র হাওরজলে ভাসতে দেখা যায়।

এ নিয়ে টিভি চ্যানেলসহ গণমাধ্যমগুলোতে সংবাদ প্রকাশ হলে মাদরাসাটির বেঞ্চ ও আসবাবপত্র জল থেকে ডাঙায় তোলা হয়। পরে তড়িঘড়ি করে নতুন বগাদিয়া গ্রামের হারিছ বেপারির বসতভিটায় দুটি টিনের ছাপড়া উঠানো হলেও শিক্ষার্থীদের স্থানসংকুলান না হওয়ায় পাঠদান চরম ব্যাহত হওয়া ছাড়াও রাতে পরিণত হয় গোয়ালঘরে। ফলে এতদিন ধরে ছোট দুটি টিনশেড দোচালা ঘরে অফিস ও শিক্ষক মিলনায়তনসহ দশটি শ্রেণির পাঠদান কার্যক্রম কেবলই কেতাবি ব্যবস্থাপনায়।

প্রকৃতপক্ষে সুপার মাদরাসাটি ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে স্থানান্তরের এক বছর পর মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বরাবরে বিগত ২০১২ সালের পহেলা জানুয়ারি মাসে এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পাঠদানে 'অস্থায়ী অনুমতি' নেয়। এই অস্থায়ী অনুমতিই যার ভিত্তি।

এর জন্য সুপার যেসব কারণ দেখিয়ে প্রশাসনের অনুমতি ও আদালতের রায়ের দোহাই পাড়ছেন; সেসব কারণ এমপি রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক দেড় বছর আগেই মিটিয়ে দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও স্থায়ী চত্বরে যাওয়ার নাম নেই; খোঁজা হচ্ছে নতুন জায়গা।

এহেন অরাজকতায় মাদরাসাটি স্থায়ী চত্বরে ফিরে পেতে একদফা দাবি উঠলে ২০১৮ সালে শ্যামপুর গ্রামে অনুষ্ঠিত ইউনিয়নবাসীর উপস্থিতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনী জনসভায় উপজেলার শীর্ষস্থানীয় নেতারা সেদিন মাদরাসা নিজস্ব স্থানে ফিরিয়ে দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন। এ ছাড়া শ্যামপুরবাসীর ২০২০ সালের জুলাই মাসে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এমপি তৌফিক 'জায়গারটা জায়গাই আসবে' বলে মত দেন। তিনি ২০২১ সালের ১১ এপ্রিল মিঠামইন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রভাংশু সোম মহানসহ স্থানীয় শিক্ষা অধিদপ্তর, পুলিশ প্রশাসন ও ভূমি অফিসের কর্মকর্তাদের নিয়ে সরেজমিন পরিদর্শন করেন এবং মাদরাসাটি স্থায়ী চত্বরে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেন। যার মৌজা- মুশুরিয়া, খতিয়ান- ৬০, সাবেক দাগ- ৩৯৯ অর্থাৎ আরএস দাগ নং- ৮৭২ ও ৮৭৫।

মাদরাসাটি গত ১২ জুলাই ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত হয়ে আছে। অথচ মো. জজ মিয়ার দান করা এক একর জমিতে উঁচু জমির পাশাপাশি ইটের বেষ্টনীতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও সংসদ সদস্যের নির্দেশ পাত্তা দিচ্ছেন না সুপার। এমপি তৌফিকের সংস্থাপনে মাদরাসাটির স্থায়ী জায়গা প্রস্তুত ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রত্যাখ্যানে সুপারের স্পর্ধা বিস্ময়কর। এতে অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা চরম অবনতি হওয়ার সম্ভাবনাও জোরালো হচ্ছে।

এই মাদ্রাসা সুপারের অন্যায় ও সৃষ্ট অনাচারের পরিবেশ থেকে শিক্ষার্থীরাও নিজের স্বার্থপরতা ছাড়া ভালো কিছু শিখছে না। হারিয়ে ফেলছে মূল্যবোধ, নৈতিকতা আর সুকুমার বৃত্তিগুলো। ফলে আগামী কর্ণধাররা ক্ষীণচেতা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই বেড়ে উঠছে নিপাট অন্যায় ও অসত্যের মধ্যে বসবাস করে।

চার্লস ডিকেলের 'গ্রেট এক্সপেকটেশানস' উপন্যাসে পিপ নামের বালকটি বলেছিল... 'বাচ্চাদের ছোট দুনিয়াতে যেটা সবচেয়ে ভালোভাবে টের পায়, সেটা হলো অন্যায়।'

এ অন্যায় শ্যামপুর মাদরাসা ছাপিয়ে পাশের ২ নং বগাদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সত্তর বছরের বেশি সময় ধরে দখলে ও সংরক্ষণে থাকা প্রাচীন বিস্তীর্ণ খেলার মাঠটিকেও গ্রাস করেছে একদল স্বার্থান্বেষী মহল। মাঠটি বসতবাড়ি নির্মাণে গোপনে বিক্রি হয়ে গেছে কাগজের ফাঁকফোকরে। এ মর্মে প্রধান শিক্ষক গত ১৭ জানুয়ারি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ে দরখাস্ত করেও কোনো প্রতিকার মিলেনি।

অবস্থাদৃষ্টে আওয়ামী লীগের শাসনামলে সুবিধাবঞ্চিত হাওরাঞ্চল জাতীয় মহাপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্তিতে উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে হাঁটছে। আবার পাশাপাশি একটি নৈতিক-মানসিক-সামাজিক অধঃপতন ও অবক্ষয়ের মধ্যে দিয়েও যাচ্ছে।

এলাকার শান্তিশৃঙ্খলা ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে শিক্ষার ক্ষেত্রে অন্তত এ দুটি জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের হস্তক্ষেপে নিরসনের গত্যন্তর নেই।

লেখক: সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়, ঢাকা।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :