দুর্নীতির পর পদোন্নতি! প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের এমডির দায়িত্বে ইঞ্জিনিয়ার আক্তার

হাশেম তালুকদার, চট্টগ্রাম
| আপডেট : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১:৩৬ | প্রকাশিত : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৯:১৫

সরকারি ক্রয়বিধি (পিপিআর-২০০৮) লঙ্ঘন করে গাজী ওয়্যারস লিমিটেডের ৪৫ কোটি টাকার মেশিনারিজ ক্রয়ে অনিয়ম ধরা পড়ার পরেও নেয়া হয়নি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।

উল্টো পদোন্নতি দিয়ে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক করা হয়েছে প্রকল্প পরিচালক আক্তার হোসেনকে। এই ঘটনাকে ‘দুর্নীতির পুরস্কার’ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট অনেকেই। কেনাকাটাসহ নানা অনিয়ম নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন সিবিএ সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা। তিনি বলেন, ৪২ বছর এ কোম্পানিতে কাজ করি। সততার সঙ্গে কাজ করে বুঝতে পারলাম দুর্নীতিবাজদেরই জয়জয়কার।

২০১৮ সাল পর্যন্ত বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, মোটর ইত্যাদির কয়েল তৈরি বা রি-উইন্ডিং কাজে ব্যবহৃত এনামেল কপার ওয়্যারের মোট চাহিদার ২০ শতাংশ পূরণ করত চট্টগ্রামের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠান গাজী ওয়্যারস লিমিটেড (গাওলি)। দেশের মোট চাহিদার ৫০ শতাংশ মেটানোর লক্ষ্যে ৪৫ কোটি টাকার মেশিনারিজ স্থাপনের জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।

এই প্রকল্পের আওতায় নয়টি মেশিনারিজ কেনার সিদ্ধান্ত হয় ২০১৮ সালে। বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, মোটর তৈরি বা রিউইন্ডিং কাজে ব্যবহৃত সুপার এনামেল কপার ওয়্যার তৈরির এসব মেশিনারিজ জাপান থেকে কেনার কথা থাকলেও নয়টি মেশিনারিজের মধ্যে ছয়টিই আনা হয়েছে তাইওয়ান থেকে। বাকি তিনটি কোথা থেকে আনা হয়েছে তা উল্লেখ করা হয়নি। এসব মেশিনারিজ জাপানের পরিবর্তে তাইওয়ান থেকে এনে বিপুল অঙ্কের টাকা লোপাট করা হয়েছে বলে সন্দেহ হয় সংশ্লিষ্টদের।

চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয়ের অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস অফিসার লোকমান আকতার চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতেও সন্দেহের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। অডিট কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, জাপানের পরিবর্তে তাইওয়ানে প্রস্তুতকৃত মেশিনারি এবং ইকুইপমেন্ট ক্রয় করায় অনিয়মের মাধ্যমে ব্যয় করা হয়েছে ৪৫ কোটি ৪০ লাখ ৯০ হাজার ৮৭৯ টাকা। ক্রয় আদেশে ম্যানুফেকচারার মেসার্স পরুকুয়া বুশন কোং লিমিটেড জাপান এবং হোকেয়েটসু ইন্ডা: কো: লি:, জাপান এর স্থলে কান্ট্রি অব অরিজিন হিসেবে জাপান ও তাইওয়ান উল্লেখ করায় এই অনিয়ম হয়েছে বলেও অডিট প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

অডিট আপত্তিতে বলা হয়েছে-কারিগরি সাব-মূল্যায়ন কমিটি, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশ ও কোম্পানির বোর্ড সভায় অনুমোদন দেয়া হয়েছে মেসার্স ডায়মন্ড প্রজেক্ট কো. লি., জাপান, ম্যানুফেকচারার মেসার্স পরুকুয়া বুশন কোং লি. জাপান এবং হোকেয়েটসু ইন্ডা: কো: লি:, জাপানকে। কিন্তু ক্রয়কারীর ক্রয় আদেশের ২নং শর্তে কান্ট্রি অব অরিজিন হিসেবে জাপান ও তাইওয়ান উল্লেখ করা হয়েছে।

এসব কেনাকাটায় অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি। তবে খোদ তদন্ত কমিটিই নিশ্চিত হতে পারেননি সরবরাহকৃত মেশিনারিজের কান্ট্রি অব অরিজিন। কারখানাটি দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার ৫০ শতাংশ সুপার এনামেল কপার ওয়্যার সরবরাহের লক্ষ্যে এসব মেশিনারিজ ক্রয় করলেও গুরু তর অনিয়মের মাধ্যমে স্থাপনকৃত মেশিনগুলো অভ্যন্তরীণ চাহিদার মাত্র ২৫ ভাগ সরবরাহ করতে পারছে। গুরু তর অনিয়মের কারণে লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি বর্তমান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অদক্ষতা ও কর্মকৌশলের অভাবে দিন দিন বাজার হারাচ্ছে এবং ত্বরিত ব্যবস্থা না নিলে অচিরেই এটি রূগ্ন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি ক্রয়কৃত মেশিনারিজের প্রকৃত তৈরিস্থল, কোম্পানি, দেশ ইত্যাদি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান ও পারদর্শী বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে অধিকতর যাচাইয়ের ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

মেশিনারিজ ক্রয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে শিল্প মন্ত্রণালয় তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জাফর উল্লাহর নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটির সদস্যসচিব করা হয় শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোখলেছুর রহমান আকন্দকে। কমিটির অপর সদস্য বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের পরিচালক (পরিকল্পনা) মনিরুল ইসলাম। তদন্ত কমিটি সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক ও বর্তমান শীর্ষ কর্মকর্তা, প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের জবানবন্দী নেয়। ইতোমধ্যে কমিটি তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন।

এ দিকে শিল্প মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যদের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে- ইতোপূর্বে প্রতিষ্ঠানটিতে বিদ্যমান জাপানি মেশিনের গায়ে খোদাই করা কোম্পানির নাম থাকলেও দুটি প্যাকেজের আওতায় সরবরাহকৃত নয়টি মেশিনের গায়ে খোদাই করা কোনো কোম্পানির নাম পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া তাইওয়ান ও জাপান দুই দেশ থেকে মেশিনগুলো সরবাহের উল্লেখ থাকলেও সবগুলো মেশিনের গায়ে জাপানের স্টিকার লাগানো। ফলে কমিটির সদস্যরা মেশিনগুলোর কান্ট্রি অব অরিজিন সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেননি। মেশিনগুলোর জাহাজীকরণের কাগজপত্রেও গরমিল খুঁজে পেয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। গাজী ওয়্যারস লিমিটেডকে (গাওলি) শক্তিশালী ও আধুনিকীকরণ শীর্ষক বৃহৎ এই প্রকল্প চলাকালেই ২০১৮ সালে কোটি টাকার যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে, যা যৌক্তিক মনে করেন না তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

তদন্ত প্রতিবেদনে গুরুতর এই অনিয়মের জন্য দায়ী করা হয়েছে গাজী ওয়্যারস লিমিটিডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কোম্পানি পরিচালনা পর্ষদের সদস্যসচিব এবং প্রকল্পটির দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি ডা. গোলাম কবির, সাবেক প্রকল্প পরিচালক আক্তার হোসেন, প্রকল্পের উপপরিচালক ও প্রকল্পের কারিগরি সাব কমিটির সভাপতি এবং দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্যসচিব তাজুল ইসলাম এবং কোম্পানির বোর্ড সচিব ও উক্ত প্রকল্পের সাত সদস্যবিশিষ্ট দরপত্র মূল্যায়ন কমিটিকে।

আলোচিত এই প্রকল্পের দুর্নীতির বিষয়ে কথা বলতে প্রকল্প পরিচালক ও বর্তমানে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. আক্তার হোসেনকে মোবাইলফোনে কল ও বার্তা দিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে গাজী ওয়্যারস লিমিটেডের সিবিএ সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘সরকারি এই প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বাড়াতে একনেক থেকে দেওয়া প্রায় ৭০ কোটি টাকার কেনাকাটায় অনিয়মের মাধ্যমে হরিলুট চালিয়েছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।’

তিনি বলেন, ‘এর ফলে আমদানি করা মেশিনগুলো আশানুরূপ প্রোডাকশন দিতে পারছে না। ক্ষতির মুখে পড়ছে প্রতিষ্ঠানটি। আমরা যেহেতু প্রোডাকশনের কাজ করি তাই নিজেদের দায়বদ্ধতা থেকে দুদকসহ সংশ্লিষ্টদের লিখিতভাবে বিষয়টি জানিয়েছি।’

গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘অডিট রিপোর্ট ও মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটিও অনিয়মের তথ্য প্রমাণ পেয়েছে। কিন্তু এমন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো পদোন্নতি দিয়ে পুরস্কৃত করায় আমরা হতাশ হয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা চাই অপরাধী যেই হোক তার যেন শাস্তি হয় আর ভালো অফিসারদের পদোন্নতি হোক। তা না হলে জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে আমরা অনেক পিছিয়ে থাকব।’

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান শহীদুল হক ভূঁইয়া ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে হাতে পাইনি। পাশাপাশি করপোরেশনের পক্ষ থেকেও একটি তদন্ত কমিটি কাজ করছে। উভয় কমিটির রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।’

(ঢাকাটাইমস/০৬সেপ্টেম্বর/কেএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

অপরাধ ও দুর্নীতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

অপরাধ ও দুর্নীতি এর সর্বশেষ

ইউটিউবে জাল টাকা তৈরি শেখা, রাজমিস্ত্রি-জেলেকে নিয়ে গড়ে তোলা হয় চক্র

দুর্নীতি মামলায় মেজর মান্নান কারাগারে

ভুয়া নিয়োগপত্রে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ

শিশু বিক্রির অর্ডার নিয়ে অপহরণ করতেন তারা

দুর্নীতির অভিযোগে রুয়েটের সাবেক ভিসি ও রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা ​​​​

যাবজ্জীবন সাজা থেকে বাঁচতে ২২ বছর ধরে তরমুজ ও ওষুধ বিক্রেতা, অতঃপর...

বিমানবন্দরে ডলার কারসাজি, ১৯ ব্যাংকারসহ ২১ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

ঢাবি ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীকে মারধর করে ছিনতাইয়ের অভিযোগ

ধানক্ষেতে বিদ্যুতের ফাঁদ পেতে ‘হত্যা’: তিন আসামি গ্রেপ্তার

রাজধানীতে নাশকতা মামলার আসামি গ্রেপ্তার

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :