সর্বহারা দলের সদস্য হয়ে সাইফুলের ৩৪ বছর কাটল পালিয়ে

প্রকাশ | ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৯:৫২ | আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৯:৫৬

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

সর্বহারা দলের সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। সর্বহারাদের সব কার্যক্রমে তিনি নিয়মিত অংশ নিতেন। ত্রাস সৃষ্টি, লুটপাট ও চাঁদাবাজির অর্থ দিয়েই জীবিকা নির্বাহ করতেন। সেটা ৩৪ বছর আগের কথা। তখন থানায় হামলা চালিয়ে অস্ত্র লুট, পুলিশ কনস্টেবলকে খুন করে এক চরমপন্থীকে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় মামলায় আটক হন মানিক নামের এই চরমপন্থী। এরপর জামিনে বেরিয়ে ৩০ বছর ধরে পলাতক একাধিক ছদ্মনামে।

 

মানিক ২০১৮ সালে নাম পরিবর্তন করে রাখেন সাইফুল প্রধান। সেই নামে তৈরি করেন জাতীয় পরিচয়পত্র। সম্প্রতি রূপগঞ্জ এলাকায় ছাত্তার নামে শ্রমিক সরদার হিসেবে কাজ করছিলেন।

 

গতকাল শুক্রবার রাতে রূপগঞ্জ এলাকায় অভিযান চালিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ‘ছাত্তার’ নামে আত্মগোপন করা সাইফুল ইসলাম ওরফে মানিককে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-৩।

শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ এসব কথা জানান।

 

গুরুদাসপুর থানা লুট ও পুলিশ কনস্টেবলকে খুনের ঘটনাটি ৩৪ বছর আগে ১৯৮৭ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারির।

 

ওদিনের ঘটনা সম্পর্কে র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, সেদিন বেলা ১১টার দিকে একদল চরমপন্থি ছদ্মবেশে লুঙ্গি, গামছা পরা অবস্থায় হাতে পোটলা নিয়ে হাটে অবস্থান নেয়। পোটলার মধ্যে ছিল তাদের অস্ত্র। তাদের মধ্যে কয়েকজন অস্ত্র প্রদর্শন করে টেলিফোন অফিস নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সেন্ট্রাল কমান্ড বিকল করে দেয় এবং কয়েকজন থানায় প্রবেশ করে অস্ত্রের মুখে থানা নিয়ন্ত্রণে নেয়।

 

এ সময় কনস্টেবল হাবিবুর রহমান বাধা দিলে চরমপন্থিরা তাকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর থানার অস্ত্রাগার লুট করে দুটি এসএমজি, চারটি এসএলআর, ১৮টি ৩.৩ রাইফেল ও গোলাবারুদ লুট করে। থানার লকআপে বন্দি এক চরমপন্থি আসামিকে ছিনিয়ে নিয়ে যান। তারপর আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য তারা একযোগে টেলিফোন অফিস ও থানা কম্পাউন্ডে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়।

 

এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে গুরুদাসপুর থানায় ১৯৮৭ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা হয়। তদন্ত শেষে সিআইডি ২০ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার আসামিদের জবানবন্দির ভিত্তিতে ৪৯ জনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে সংস্থাটি। বিচার প্রক্রিয়া শেষে ২০০৭ সালে মামলার রায় ঘোষণা করেন আদালত।

 

মানিকের বরাত দিয়ে র‌্যাবের এ কর্মকর্তা জানান, মানিক ১৯৮৪ সালে চরমপন্থি নেতা তারেকের মাধ্যমে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। সক্রিয়ভাবে চরমপন্থিদের সঙ্গে হত্যা, লুটপাট, ত্রাস সৃষ্টি ও অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির মতো কাজে অংশ নিতে থাকেন তিনি। চরমপন্থিদের সঙ্গে যোগ দেয়ায় এলাকায় সবাই তাকে সমীহ করতেন। যাদের সঙ্গে তার বিরোধিতা ছিল, সবাই আপসে চলে আসেন।

 

লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, চরমপন্থি নেতা তারেক দুই মাস আগে থেকে গুরুদাসপুর থানা লুট করার পরিকল্পনা করেন। এজন্য তিনি ঝিনাইদহ, সিরাজগঞ্জ, রাজবাড়ি, কুষ্টিয়া, পাবনা, টাঙ্গাইল এলাকা থেকে চরমপন্থি দলের সদস্যদের আহ্বান জানিয়ে একত্র করেন। ঘটনার দিন তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ৬০ জন নাটোরের ধামাইর মাঠে এসে জড়ো হয়। এরপর পরিকল্পনা অনুযায়ী ছদ্মবেশে লুঙ্গি, গামছা পরিহিত অবস্থায় পোটলার মধ্যে অস্ত্র লুকিয়ে গুরুদাসপুর থানা ও টেলিফোন অফিসের আশপাশ এলাকায় ও হাটে অবস্থান নেন।

 

মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের দলের সদস্যরা ভিড়ের মধ্যে ছদ্মবেশে লুকিয়ে ছিলেন। এরপর একযোগে হামলা চালায় থানা ও টেলিফোন অফিসে।

 

লুণ্ঠনকৃত অস্ত্র তারেক, সুলতান, মজিদ ও ইয়াকুব তাদের হেফাজতে নিয়ে চাটমোহর, চলনবিল এলাকায় লুকিয়ে রাখেন। ঘটনার পর মানিক বাড়িতে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে থাকেন। ১৯৮৮ সালে তারেকের নেতৃত্বে চাটমোহর থানার খোতবাড়ি এলাকার মাঠে রাতের বেলা নকশাল ও সর্বহারাদের মধ্যে সম্মুখযুদ্ধ হয়। এতে নকশালপন্থী ১২ জন নিহত হন।

 

ভোরে পুলিশ ১২টি লাশ উদ্ধার করে। এ মামলায় মানিক গ্রেপ্তার হন। জিজ্ঞাসাবাদে গুরুদাসপুর থানার অস্ত্র লুটের সত্যতা বেরিয়ে আসে।

 

১৯৮৯ সালে জামিনে মুক্ত হয়ে মানিক আত্মগোপনে চলে যান। থানা লুট ও ১২ জনকে হত্যা মামলাসহ মানিকের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা রয়েছে।

 

মানিকের পলাতক জীবন

১২ জন হত্যা মামলার পর তারেকসহ চরমপন্থি দলের সদস্যরা চাটমোহর থেকে আত্মগোপন করে সিরাজগঞ্জে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে তারা তাদের দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। ১৯৮৯ সালের নভেম্বর মাসে তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে মানিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন।

 

জামিনে মুক্ত হয়ে তিনি তারেকের সঙ্গে যোগাযোগ করে চরমপন্থি দলের সঙ্গে আবারও হত্যা, লুটপাট, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, অস্ত্র প্রদর্শন করে ত্রাস সৃষ্টি, অস্ত্র নিয়ে এলাকায় মহড়া দেওয়া, অর্থের বিনিময়ে জমি দখল, পারিবারিক বিরোধ মীমাংসার কাজে লিপ্ত হয়ে পড়েন।

 

র‌্যাব কর্মকর্তা আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, গ্রেপ্তার তারেকের সঙ্গে নৌকায় বিলের মধ্যে অবস্থান করতেন। দলের কার্যক্রম শেষে তারা আবারও সশস্ত্র অবস্থায় বিভিন্ন এলাকায় নৌকার মধ্যেই জীবন-যাপন করতেন।

 

২০০৪ সালে চরমপন্থিদের বিরুদ্ধে র‌্যাবের সাঁড়াশি অভিযান শুরু হলে তারেকের নির্দেশে চরমপন্থিরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েন। তখন মানিক রাজধানীতে এসে কিছুদিন বাসের হেলপারি করে্ন। ট্রাকে মালামাল লোড-আনলোডের শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। এরপর নারায়ণগঞ্জে তার এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেন। এখানে গার্মেন্টস কারখানায় চাকরি নেন ছাত্তার নামে।

 

ধীরে ধীরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান স্তিমিত হলে তারা আবার মাঝে মাঝে এলাকায় গিয়ে সর্বহারা দলের কার্যক্রম চালাতে থাকেল। ৭-৮ বছর আগে চরমপন্থি দলের অন্তর্দ্বন্দ্বে তারেক নিহত হলে মানিক সর্বহারা দলের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দেন। তিনি এনআইডি পরিবর্তন করে রূপগঞ্জ এলাকার ভোটার হিসেবে নিজেকে ছাত্তার নামে প্রতিষ্ঠিত করে নিজের স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন।

(ঢাকাটাইমস/১০সেপ্টম্বর/এএইচ/মোআ)