যেভাবে নায়িকা শিমুকে হত্যা করে স্বামী, পিলে চমকানো তথ্য দিল পুলিশ

প্রকাশ | ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১:০০ | আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১২:২৬

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

রাইমা ইসলাম শিমু। ১৯৯৮ সালে কাজী হায়াৎ পরিচালিত সিনেমা ‘বর্তমান’ দিয়ে অভিষেক ঘটে। একে একে অভিনয় করেছেন ৫০টিরও বেশি সিনেমায়। সিনেমার পাশাপাশি কয়েকটি টিভি নাটকে অভিনয় এবং প্রযোজনা করেছেন এই অভিনেত্রী। কিন্তু মিডিয়ায় কাজ পছন্দ করতেন না তার স্বামী সাখাওয়াত আলী নোবেল। এই নিয়ে দাম্পত্যজীবনে কলহ চলছিল।

এ বছরের ১৭ জানুয়ারি ঢাকার কেরানীগঞ্জের আলীপুর এলাকায় রাস্তার পাশ থেকে শিমুর বস্তাবন্দি খণ্ডিত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তবে তার পরিচয় মিলছিল না। পরে ওইদিন রাতে তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে নাম-পরিচয় শনাক্ত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এ ঘটনায় শিমুর স্বামী নোবেল ও তার বাল্যবন্ধু এস এম ফরহাদের সংশ্লিষ্টতা পায় পুলিশ। দীর্ঘ সাত মাস তদন্ত শেষে গেল ২৭ আগস্ট অভিযুক্ত দুইজনের নামে আদালতে প্রতিবেদন দেয় পুলিশ। এর আগে ২০ জানুয়ারি আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দেন নোবেল ও ফরহাদ।

কেরানীগঞ্জ মডেল থানার পরিদর্শক শহিদুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সম্প্রতি ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চিত্রনায়িকা রাইমা ইসলাম শিমু হত্যার ঘটনায় স্বামী ও তার বাল্যবন্ধুর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে অভিযুক্তরা কারাগারে রয়েছেন।’

তদন্ত কর্মকর্তা জানান, অভিনেত্রী শিমু মোবাইল ফোনে কার সঙ্গে কথা বলেন বা কোথায় যান এসব নিয়ে প্রতিনিয়ত সন্দেহ করতেন স্বামী সাখাওয়াত আলীম নোবেল। ঘটনার দিন সকালে হঠাৎ স্ত্রীর ফোন দেখতে চান নোবেল। এ নিয়েই ঝগড়া-হাতাহাতি থেকে শেষ পর্যন্ত গলা চেপে ধরলে মারা যান শিমু।

আদালতে জমা দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, বাবা-মাকে নিয়ে একসঙ্গে থাকতেন নায়িকা শিমু। তাদের বাসার পাশে ছিল নোবেলের বাসা। ফলে নিয়মিত দেখা হতো। এক সময় তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। পরে বাবা-মায়ের অমতে শিমুকে বিয়ে করেন নোবেল। এর পর নোবেলের বাবা-মা আলাদাভাবে বসবাস করতে থাকেন। রাজধানীর গ্রিন রোডে স্ত্রী-সন্তানসহ বসবাস করতেন নোবেল।

বিয়ের পর বিভিন্ন বিষয়ে মনোমালিন্য দেখা দেয় দুজনের মধ্যে। এর মধ্যে নোবেল শিমুকে সিনেমায় অভিনয় করতে নিষেধ করেন। তার কথামতো সিনেমা ছেড়ে বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলে চাকরি নেন শিমু। এ চাকরিটাও ভালোভাবে নেননি নোবেল। এ নিয়ে নোবেল ও শিমুর সংসারে চলছিল কলহ। এ কলহের কথা নোবেল তার বাল্যবন্ধু ফরহাদের সঙ্গে শেয়ার করতেন।

শিমু সিনেমায় আত্মপ্রকাশ করেছিলেন ১৯৯৮ সালে। ২০০৪ সাল পর্যন্ত নিয়মিত বড় পর্দায় দেখা যায় তাকে। প্রথম সারির পরিচালকদের সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন শিমু। কয়েক বছর ধরে তিনি নাটকের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।

যেভাবে হত্যা ও মরদেহ গুম

চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি সকাল সোয়া ৮টায় নোবেলের বাসায় যান ফরহাদ। এ সময় ফরহাদকে ড্রইংরুমে বসতে দিয়ে নোবেলকে জানান শিমু। নোবেল গিয়ে ফরহাদের সঙ্গে দেখা করে রান্নাঘরে চা বানাতে যান।

এ সময় বেডরুমে বসে মোবাইল দেখছিলেন শিমু। তখন নোবেল সেই মোবাইল দেখতে চান। কিন্তু শিমু দেখাতে অস্বীকৃতি জানান। এ নিয়ে তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি ও ধস্তাধস্তি হয়। হইচই শুনে ফরহাদ উঠে শিমুর রুমে যান। তখন নোবেল ফরহাদকে বলেন, ‘শিমুকে ধর, ওকে আজ মেরেই ফেলব’।

কথামতো ফরহাদ ধরতে গেলে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন শিমু। নোবেল প্রথমে শিমুর গলা ধরতে গেলে তাকেও ধাক্কা মেরে ফেলে দেন। এরপর ফরহাদকে শিমুর গলা ধরার জন্য বলেন নোবেল। ফরহাদ গলা আর নোবেল দুই হাত চেপে ধরেন। একপর্যায়ে নিচে পড়ে যান শিমু। নোবেল শিমুর গলার ওপর পা দিয়ে দাঁড়ান। এতে প্রস্রাব করে দেন শিমু। একসময় শিমু নিস্তেজ হয়ে পড়েন।

এ সময় নোবেল ফরহাদকে দেখতে বলেন শিমু বেঁচে আছে কি না। ফরহাদ শিমুর হাতের রক্তনালি পরীক্ষা করে বলেন, বেঁচে নেই। তখন তারা দুজনে মিলে মরদেহ লুকানোর পরিকল্পনা করতে থাকেন।

একপর্যায়ে নোবেল রান্নাঘর থেকে দুটি পাটের বস্তা এবং ফ্রিজের ওপর থেকে মিষ্টির প্যাকেট বাঁধার প্লাস্টিকের রশি আনেন। ফরহাদ শিমুর মাথা উঁচু করে ধরেন। আর নোবেল একটি বস্তার ভেতর শিমুর মাথার অংশ এবং আরেকটি বস্তায় পায়ের অংশ ভরেন।

এরপর প্লাস্টিকের রশি দিয়ে দুটি বস্তা একসঙ্গে সেলাই করে দেন নোবেল। বাড়ির দারোয়ানকে নাশতা আনতে বাইরে পাঠিয়ে নিজের ব্যক্তিগত গাড়ির পেছনের আসনে শিমুর লাশ নিয়ে বেরিয়ে যান দুইজন।

নোবেল ও ফরহাদ প্রথমে মিরপুরের দিকে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে লাশ গুমের অনুকূল অবস্থা না পেয়ে তারা আবার বাসায় ফেরেন। সন্ধ্যায় আবার লাশ গুম করতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, বছিলা ব্রিজ হয়ে কেরানীগঞ্জের দিকে যান। আনুমানিক রাত সাড়ে ৯টায় মডেল থানার হযরতপুর ইউনিয়নের কদমতলী এলাকার আলীপুর ব্রিজের ৩০০ গজ দূরে সড়কের পাশে ঝোপের ভেতর লাশটি ফেলে চলে যান তারা।

মরদেহের পরিচয় পেয়েই রাইমা ইসলাম শিমুর কলাবাগানের বাসায় যায় পুলিশ। নোবেল সে সময় বাসাতেই ছিলেন। পুলিশের প্রশ্নের জবাবে নোবেল বলেন, বাসা থেকে বের হওয়ার সময় শিমু বলেছিলেন, তিনি মাওয়া যাচ্ছেন। স্বামীর এ বক্তব্যে খটকা লাগে পুলিশের। কারণ, শিমুর পরনে ছিল সালোয়ার-কামিজ। ব্যক্তিজীবনে পরিপাটি হয়ে বাইরে যেতেন তিনি। তাই বেড়াতে গেলে তার এমন পোশাক পরার কথা নয়।

যে সুতার সূত্রে স্বামীকে সন্দেহে নেয় পুলিশ:

নোবেলকে জিজ্ঞাসাবাদের পর পুলিশ তাদের ব্যক্তিগত গাড়িটি দেখতে যায়। গাড়ির পেছনে থাকা সুতার বান্ডেল দেখে স্বামীর জড়িত থাকার বিষয়ে সন্দেহ জোরালো হয় পুলিশের। শিমুকে বস্তায় ভরে যে সুতা দিয়ে সেলাই করা হয়েছিল, গাড়ির পেছনে পাওয়া যায় একই সুতা। গাড়িটি সেদিনই ধোয়া হয়েছিল। গাড়ির ভেতরের দুর্গন্ধ দূর করতে ছিটানো হয়েছিল ব্লিচিং পাউডার।

ঘটনার পর রাতেই কলাবাগান থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। জিডিতে বলা হয়, স্বামী ও দুই সন্তানকে নিয়ে রাজধানীর কলাবাগান এলাকার বাসায় থাকতেন শিমু। ১৬ জানুয়ারি সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে তিনি আর ফেরেননি। তার মোবাইলও বন্ধ পাওয়া যায়। পরদিন ১৭ জানুয়ারি আলীপুর এলাকার রাস্তার পাশ থেকে শিমুর বস্তাবন্দি খণ্ডিত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

এরপর ১৮ জানুয়ারি কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় নোবেল ও তার বাল্যবন্ধুর বিরুদ্ধে মামলা করেন শিমুর ভাই হারুনুর রশীদ। এ ছাড়া মামলায় বেশ কয়েকজনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়।

এদিকে সিনেমায় আত্মপ্রকাশের পর ২০০৪ সাল পর্যন্ত নিয়মিত বড় পর্দায় দেখা যায় শিমুকে। প্রথম সারির পরিচালকদের সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন তিনি। কয়েক বছর ধরে তিনি নাটকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দুই দশকেরও বেশি সময় অভিনেত্রী হিসেবে দেশের খ্যাতনামা পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করেছিলেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছেন- প্রয়াত চাষী নজরুল ইসলাম, পরিচালক দেলোয়ার জাহান ঝন্টু, এ জে রানা, শরিফুদ্দিন খান দীপু, এনায়েত করিম ও শবনম পারভীন।

তাছাড়া দেশের প্রথম সারির অভিনেতা শাকিব খান, রিয়াজ, অমিত হাসান, বাপ্পারাজ, জাহিদ হাসান ও মোশাররফ করিমসহ অনেকের বিপরীতে শিমু অভিনয় করেছেন। প্রযোজক হিসেবেও দেখা গেছে তাকে। পাশাপাশি একটি টিভি চ্যানেলের মার্কেটিং বিভাগে কর্মরত ছিলেন।

(ঢাকাটাইমস/১১সেপ্টেম্বর/এসএস/এফএ)