রাজধানীর গণপরিবহনে নৈরাজ্য

প্রতিদিন ১৮২ কোটি টাকা বাড়তি আদায়, এক বছরে ১৪ যাত্রীকে হত্যা

যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৪:৫৫ | প্রকাশিত : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৪:০৯

রাজধানীতে গণপরিবহনগুলো প্রতিদিন যাত্রীদের কাছ থেকে ১৮২ কোটি ৪২ লাখ টাকা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে বলে যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। এছাড়া গত এক বছরে গণপরিবহনে ২৫টি যাত্রী লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটে। বাস থেকে ফেলে হত্যা করা হয় ১৪ জনকে।

মঙ্গলবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে চতুর্থ যাত্রী অধিকার দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি আয়োজিত ‘অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য বন্ধের কার্যকর পদক্ষেপ চাই’ শীর্ষক আলোচনা সভায় যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী এ তথ্য তুলে ধরেন।

আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, রাজধানীর বিভিন্ন শ্রেণির গণপরিবহনে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে তিন কোটি ট্রিপে যাত্রী সাধারণের কাছ থেকে ১৮২ কোটি ৪২ লাখ টাকা অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য চলছে। এই ভাড়া নৈরাজ্যের কারণে সামাজিক অস্থিরতা বেড়েছে, পণ্যমূল্য বেড়েছে, সামাজিক অপরাধ বাড়ছে।

সভায় যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘গত এক বছরে দুইবার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয় গণপরিবহন ভাড়া। এতে অস্থির হয়ে উঠে গণপরিবহন খাত। বর্তমানে নগরীর কোনো পরিবহনে সরকার নির্ধারিত ভাড়া কার্যকর নেই। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য চলছে। এই সময়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের প্রতিবাদ করায় তর্কের জেরে গণপরিবহনগুলোতে ২৫টি যাত্রী লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটে। এতে বাস থেকে ফেলে ১৪ যাত্রীকে হত্যা করা হয়েছে। গুরুতর আহত হয়েছেন ১০ জন যাত্রী।’

এতে গণপরিবহন ব্যবহারে যাত্রী সাধারণের মাঝে ভীতি সঞ্চার হয়েছে উল্লেখ করে মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা বাড়তে থাকায় বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির গণপরিবহনে ভাড়া নৈরাজ্য পর্যবেক্ষণ উপ-কমিটির ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল গত ২০ আগস্ট থেকে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন শ্রেণির গণপরিবহনে ভাড়া নৈরাজ্য পর্যবেক্ষণ করে। জাইকার সমীক্ষানুযায়ী রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন শ্রেণির গণপরিবহনে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে তিন কোটি ট্রিপ যাত্রীর যাতায়াত হয়। গত এক বছরে দুই দফা জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির পরে গণপরিবহনে অস্বাভাবিক হারে ভাড়া নৈরাজ্য শুরু হয়। সরকার নানাভাবে চেষ্টা করেও এই ভাড়া নৈরাজ্য থামাতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। কোনো কোনো পরিবহনে দ্বিগুণ-তিনগুণ বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।’

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব জানান, পর্যবেক্ষণকালে বিভিন্ন যানবাহনের চালক, সহকারী ও ভাড়া আদায়কারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মালিকের দৈনিক জমা, জ্বালানির উচ্চ মূল্য, সড়কে চাঁদাবাজি, গাড়ির মেরামত খরচ ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে তারা এহেন ভাড়া নৈরাজ্য চালাতে বাধ্য হচ্ছে।’ বিভিন্ন শ্রেণির গণপরিবহনগুলো রাজধানীতে যাত্রী সাধারণের যাতায়াতের ক্ষেত্রে প্রতিদিন গড়ে ১৮২ কোটি ৪২ লাখ টাকার বেশি অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে বলে যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।

পর্যবেক্ষণে রাজধানীর পাঁচ হাজার বাস-মিনিবাসে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০ লাখ ট্রিপ যাত্রীর যাতায়াত হয়। লক্কড়-ঝক্কড় এসব সিটি সার্ভিসের শতভাগ বাসে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এসব বাস-মিনিবাসে যাতায়াতে যাত্রীপ্রতি গড়ে ১৭ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া দিতে হয়। এতে ৫০ লাখ ট্রিপ যাত্রী দৈনিক গড়ে সাড়ে আট কোটি টাকা বাড়তি ভাড়া পরিশোধ করতে বাধ্য হচ্ছে।

এছাড়াও রাজধানীতে ১৫ হাজার বৈধ অটোরিকশার পাশাপাশি আরো ১৫ হাজার ঢাকা ও আশপাশের জেলায় নিবন্ধিত অটোরিকশা অবৈধভাবে চলাচল করে। ৩০ হাজার অটোরিকশা দৈনিক গড়ে ১২ ট্রিপ হিসেবে তিন লাখ ৬০ হাজার ট্রিপ যাত্রী বহন করে। এসব অটোরিকশায় প্রতি ট্রিপে গড়ে ১৪৫ টাকা বাড়তি ভাড়া আদায় হয়। এতে দৈনিক তিন লাখ ৬০ হাজার ট্রিপ যাত্রীকে অটোরিকশা খাতে কেবল বাড়তি ভাড়া দিতে হচ্ছে পাঁচ কোটি ২২ লাখ টাকা।

যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, হিউম্যান হলারের ভাড়া নির্ধারণের আইন থাকলেও সরকার ভাড়া নির্ধারণ না করায় এখানে বরাবরই দ্বিগুণ-তিনগুণ বাড়তি ভাড়ায় যাতায়াত করতে হচ্ছে নিম্নআয়ের যাত্রী সাধারণকে। ১২ হাজার বৈধ হিউম্যান হলারের পাশাপাশি মেয়াদোত্তীর্ণ, লক্কড়-ঝক্কড়, স্থানীয় গ্যারেজে তৈরি আরো প্রায় ১৮ হাজার হিউম্যান হলারসহ ৪০ হাজার হিউম্যান হলার রাজধানীতে দৈনিক গড়ে ৮০ লাখ ট্রিপ যাত্রী বহন করে। প্রতি ট্রিপে যাত্রীপ্রতি গড়ে আট টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া দিতে বাধ্য হয়। এতে ছয় কোটি ৪০ লাখ টাকা কেবল হিউম্যান হলারের যাত্রীদের বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে।

পাঁচ লাখ রাইডশেয়ারিং মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, ট্যাক্সিক্যাবে দৈনিক গড়ে দুই কোটি ১৬ লাখ ৪০ হাজার ট্রিপ যাত্রী বহন করছে। এসব যানবাহনে যাত্রীপ্রতি গড়ে ৭৫ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এসব যানবাহনে প্রতিদিন গড়ে ১৬২ কোটি ৩০ লাখ টাকা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এহেন ভাড়া নৈরাজ্যের কারণে সামাজিক অস্থিরতা বেড়েছে, পণ্যমূল্য বেড়েছে, সামাজিক অপরাধ বাড়ছে।

এসব ভাড়া নৈরাজ্য প্রতিরোধে যাত্রী অধিকার দিবসে কয়েকটি দাবি তুলে ধরে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। অন্যতম দাবিগুলো হলো- ১. পরিবহন খাত আমূল সংস্কার করতে হবে। পরিবহনে চাঁদাবাজি, অনৈতিক লেনদেন ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য বন্ধে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভাড়া আদায় নিশ্চিত করতে হবে। নগদ লেনদেন বন্ধ করতে হবে।

২. ভাড়া নির্ধারণে মালিক সমিতি একচ্ছত্র আধিপত্য বন্ধে অভিজ্ঞ, বিশেষজ্ঞ, বুয়েটের কারিগরি জ্ঞান সমৃদ্ধ লোকজন নিয়ে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে বাসভাড়া নির্ধারণ কমিটি পুনর্গঠন করতে হবে।

৩. ব্যয় বিশ্লেষণের নামে মালিক সমিতির প্রেসক্রিপশনকে সঠিক ধরে ভাড়া নির্ধারণ করা যাবে না। ভাড়া নির্ধারণে ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটির তালিকা মাঠ পর্যায়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতি ও ক্যাবের প্রতিনিধি নিয়ে যাচাই বাছাই করে চূড়ান্ত করে ভাড়া নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

৪. বাসভাড়ার তালিকা সংস্কার করতে হবে। যাত্রী সাধারণ শিক্ষিত, অশিক্ষিত সকলে বুঝে, এমন ভাড়ার তালিকা বড় হরফে ডিজিটাল ব্যানারে বাসের ভিতর সাঁটানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

৫. পজ মেশিনের মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে টিকিট প্রদান করে ভাড়া আদায় নিশ্চিত করতে হবে।

৬. ওয়েবিলের নামে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায়, সিটিং সার্ভিস, গেইটলক সার্ভিস বন্ধ করতে হবে।

৭. গণপরিবহনের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, আসন যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্যে বসার উপযোগী রাখতে হবে।

৮. গণপরিবহনের বাহ্যিক পরিবেশ উন্নত করতে হবে। সার্বক্ষণিক পাখা চালু রাখতে হবে।

৯. গণপরিবহনে যাত্রী সেবা প্রদান, যাত্রী সেবার মানোন্নয়নসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যাত্রী প্রতিনিধির মতামত নিতে হবে।

১০. অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে জরিমানার ক্ষেত্রে একক মালিকানার বাসে ২০ হাজার টাকা কোম্পানির ক্ষেত্রে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান আইনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন সাংবাদিক মাসুদ কামাল, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি আবু জাফর সূর্য, এসোসিয়েশন অব বাস কোম্পানিজের চেয়ারম্যান রফিকুল হোসেন কাজল, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সভাপতি হানিফ খোকন, বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার সাবেক উপদেষ্টা ও অপরাধ বিজ্ঞানী মোজাহেরুল হক, যাত্রী অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক কেফায়েত শাকিল, এসএমই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আলী জামান, যাত্রী কল্যাণ সমিতির সহ-সভাপতি তাওহিদুল হক লিটন, যুগ্ম-মহাসচিব এম. মনিরুল হক প্রমুখ।

(ঢাকাটাইমস/১৩ সেপ্টেম্বর/এএ/এফএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

জাতীয় এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :