আত্মহননের পথে বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি

প্রকাশ | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৫:১২

এ.বি. ওয়ালিউদ্দিন আহমেদ

ফ্যাশন! নামটি শুনলেই মানুষের কল্পনায় ভেসে উঠে স্মার্টনেস ও রুচিবোধের সমন্বয়ে আল্ট্রা মডার্ণাইজেশনের রিপ্রেজেন্টেশন। ফ্যাশন জগৎটাই খুব চকচকে মোড়কে ঘেরা চৌকোন বাক্স, যার প্রভাবে প্রভাবিত বিশেষ করে আমাদের তরুণ সমাজ। সুনাম, খ্যাতি, অর্জন, অর্থ আর স্টারডম পাওয়ার হাতছানি দেয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি।

ফ্যাশনের সংজ্ঞা বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত হলেও আমি মনে করি ফ্যাশন একটি প্রচলন যা জীবনযাপন ও মানুষের বহুমাত্রিক বোধের সাথে সম্পর্কিত। আদিম যুগ থেকেই মানুষ ফ্যাশনকে রিলেট করা শুরু করেছিল। গাছের পাতা দিয়ে মানুষ তার গাত্র ঢাকার মাধ্যমে ফ্যাশনেবল হওয়ার ট্রেন্ড শুরু করেছিল সেই ১০ লক্ষ বছর আগে। সেই ধারাবাহিকতা আজকের দুনিয়ায় ফ্যাশন এখন মাল্টি ট্রিলিয়ন ডলার ইন্ডাস্ট্রি। যুগের পর যুগ সমাজ পরিবর্তনের ধারায় পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হচ্ছে ফ্যাশন। ফ্যাশন নিয়ন্ত্রণ করে একটি সমাজের শালীনতা, রুচিবোধ, মন ও মনন। জীবনবোধের ধারা পাল্টানোর ক্ষেত্রে ফ্যাশনের প্রভাব রয়েছে। পুরো পৃথিবীতে সমাজ সচেতন মাত্রই ফ্যাশন সচেতন হিসেবে ধরা হয়।

ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি ও গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ড একে অপরের পরিপূরক। আর এই দুইয়ের যোগসূত্র তৈরী করে মডেলিং। উন্নত বিশ্বে মডেলিং একটি প্রেষ্টিজিয়াস প্রফেশন বিধায় নাম, যশ, অর্থ ও খ্যাতির চূড়ায় অবস্থান করেন মডেলরা। আর তাইতো মেরিলিন মনরো বা নাওমি ক্যাম্পবেলরা হয়েছেন জগদ্বিখ্যাত। অথচ দুঃখের সাথে বলতেই হয়, বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি তথা গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ড এক গভীর হতাশায় নিমজ্জিত। ইন্ডাস্ট্রি লীড করার মত নেই কোন যোগ্য প্রতিনিধিত্ব, নেই কোন প্রফেশনালিজম, নেই কাজের প্রতি একনিষ্ঠতা। কতটা কাঠ-খড় পুড়িয়ে একজন র‌্যাম্প মডেলকে একটা ফ্যাশন শো'র ডায়াসে উঠে প্রশংসা কুড়াতে হয় সেটা বর্তমান কালের মডেলিং পেশায় জডিত মডেলরা একেবারেই অবগত নন। এক দশক আগেও বাংলাদেশের ফ্যাশন ইণ্ডাষ্ট্রি মাতিয়ে রাখত গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের তারকা মডেলরা। বুলবুল টুম্পা, সৈয়দ রুমা, আজরা, ইমির মত কিংবদন্তীতুল্য মডেল আজ আর খুজে পাওয়া যায়না। চারিদিকে সবকিছু থাকতেও যেন ফাকা। কোন কিছুর প্রপার কেয়ার, প্রপার ডেডিকেশন ও প্রফেশনালিজম নেই। যে র‍্যাম্পে ক্যাট ওয়াক করছে, সে কাল হয়তো ইউটিউবের জন্য নাটকে অভিনয় করছে, টিভির মিউজিক্যাল প্রোগ্রামে উপস্থাপনা করছে, আবার কেউ নিজেই অনলাইন শপ খুলে লাইভে জামাকাপড় বিক্রি করছে। আমি মনে করি, বর্তমান  সময়ে মডেলিংকে কেউ আর পূর্ণাঙ্গ ক্যারিয়ার হিসেবে ভাবেনা। সবকিছুর সাথে তাল মিলিয়ে মডেলিং এখন মাইক্রো জব। যাকে ফ্রিল্যান্সিংও বলা যেতে পারে, যা আজ করলাম, কাল ছেড়ে দিলাম। ঠিক তেমনি, যার অন্য কোন কাজেই দক্ষতা নাই, সে আসে একটা শর্ট কোর্স করে ফ্যাশন ডিজাইনার হতে। একটা ডিএসএলআর যোগাড় করতে পারলেই হয়ে গেল ফটোগ্রাফার। এভাবেই নিম্নমানের হয়ে যাচ্ছে আমাদের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি। ভ্যালু ক্রিয়েট করার মত কোন দিক নির্দেশনা বা তৎপরতা নেই এই ইন্ডাস্ট্রিতে। সবচেয়ে বড় কথা অগ্রজদের মূল্যায়ন নেই। যেখানে অগ্রজদের মূল্যায়ন নেই সেখানে পথপ্রদর্শক তৈরী হবে কিভাবে?

ফ্যাশন শো ছিল এক সময় সবার কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। বিভিন্ন ফ্যাশন হাউজ প্রতি বছর তার ডিজাইন কালেকশনের জন্য বৃহৎ পরিসরে আয়োজন করত ফ্যাশন শো। নামকরা মডেলরা বিখ্যাত সব ডিজাইনারদের পোষাক পরিধান করে র‍্যাম্পে হাটত ও বাহবা কুড়াত। আর এখন র‍্যাম্পে উঠার আগেই দরদাম ঠিক হয় কত টাকায় সে ক্যাটওয়াক করবে। আগে এওয়ার্ড প্রোগ্রাম ছিল হাতেগুনা। বাচসাস, টেনিসিয়াস আর মেরিল-প্রথম আলো ছাড়া তেমন কোন প্রোগ্রামের কথা কেউ জানতইনা। আর এখন মুডি-মুড়কির মত এওয়ার্ড প্রোগ্রাম হয়। পরিচিত সেলিব্রিটিদের জমানো হয় স্পনপনসরশীপ পাওয়ার ধান্ধায়। সেখানে এখন ফ্যাশন শো হল ঐ এওয়ার্ড প্রোগ্রামের ১০ মিনিটের একটা সেগমেন্ট।

এখন একটা ব্যপার খুব দেখা যাচ্ছে। সেটা হল দশ-পনেরোটা ডিজাইন বানিয়ে একই ডিজাইন সারা বছর বিভিন্ন মডেলদের পরিয়ে র‍্যাম্পে হাটানো হচ্ছে ও ফটোশ্যূট হচ্ছে। পেশাগত দিক দিয়ে এটা যে কতটা অপেশাদারিত্বের পরিচায়ক তা ভাষায় প্রকাশ না করাই ভাল। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি হল সৃষ্টিশীলতার স্পন্দন।  কিন্তু যেখানে সৃষ্টিশীলতা উহ্য ও অবরুদ্ধ, সেখানে কৃত্রিমতার ভূত ভর করাই স্বাভাবিক। একটা দেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি এভাবে বৃদ্ধ বাইসনের মত চলতে থাকলে হালফ্যাশনের সোসাইটি হবে কদর্যপূর্ণ ও অনাধুনিক।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব (Fourth Industrial Revolution বা 4IR) কডা নাড়ছে বিশ্বময়। 4IR এর প্রভাব সবচাইতে বেশি পড়বে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে। রোবোটিক দুনিয়ায় র‍্যাম্পে হাটার মত সুদর্শন  মডেল বানিয়ে তাদেরকে অংশগ্রহণ করানো হবে চোখ ধাধানো ও মনমাতানো সব ফ্যাশন শোতে। আর মেটাভার্স তো কল্পনার জগতকে হার মানাবে। ভার্চুয়াল রিয়ালিটির মাঝে মেটাভার্সে বিশ্বের নামী-দামী সব ব্র‍্যান্ডের অংশগ্রহণে আয়োজিত হবে আন্তর্জাতিক মানের সব ভার্চুয়াল ফ্যাশন শো। এতে থ্রি-ডাইমেনশনাল নিখুঁত ডিজাইনের কাপড় পরিধান করবে সোফির মত সব ভার্চুয়াল সেলিব্রিটি সুপার মডেলরা। তখন ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির তথাকথিত মডেল ও ফ্যাশন ডিজাইনাররা টারসিয়ারি যুগের ডাইনোসরদের মতই হবে বিলুপ্ত-প্রাপ্ত।

লেখক: ফ্যাশন ডিজাইনার ও কোরিওগ্রাফার