প্রিন্সেস রোজালিনা

প্রকাশ | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১২:৫১

নেয়ামত ভূঁইয়া

হপ্তাখানেক ধরেই শহর জুড়ে চলছে মাইকিং। দেয়ালে দেয়ালে সাঁটানো হয়েছে চাররঙা পোস্টার। লোকাল ক্যাবল নেটওয়ার্ক, ফেসবুকসহ নানান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে ব্যাপক প্রচারণা। কুমিল্লা শহর আর শহরতলির ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে সেই খবর। ইয়থ ক্লাবের ফান্ড কালেকশনের জন্য আয়োজন করা হয়েছে এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। এর বিশেষ আকর্ষণ প্রিন্সেস রোজালিনা। মন মাতানো, মঞ্চ কাঁপানো, উদ্দাম নৃত্যের ডানাকাটা পরিরানি। হালের ক্রেজ। যুবক শ্রেণির হৃদয়ের ধড়কন।

ইতোমধ্যে টিকেট বেচাবিক্রি শেষ। এখন ব্ল্যাকে পাওয়া যায় দ্বিগুণ দামে। রাজন সাহেব আমার বন্ধু রুম্মানের মামা। সুতরাং টিকেট সংগ্রহে আমার তেমন বেগ পেতে হয়নি। একেবারে ভিআইপি সিট। মামার জোর বলে কথা। মামা ক্লাবের প্রভাবশালী সদস্য। ঢাকার নামজাদা ব্যবসায়ী। তারচে বড় কথা, প্রিন্সেসের সঙ্গে তার রয়েছে ক্লোসড কানেকশন। তিনিই তো পাকা করেছেন প্রিন্সেসের এই সিডিউল। এমন প্রেক্ষাপটে আমার টিকেট ঠেকায়, জগতে কার সাধ্য?

অনুষ্ঠান শুরু হয় খানিকটা দেরিতেই। কারণ, সাজগোজ আর মেক-আপ নিতে গ্রিনরুমে অনেকটা বেশি সময় নিয়েছেন প্রিন্সেস। প্রথমে নিম্নমানের শিল্পীদের নাচগান। এরপর মধ্যম সারির পরিবেশনা। সবশেষে সেই বহু প্রতীক্ষিত প্রিন্সেসের রাজকীয় আবির্ভাব ঘটে ঝকমকে মঞ্চে। দর্শকদের বেপরোয়া হাততালিতে হলরুমের ছাদ উড়ে যাবার জোগাড়। বেজে ওঠে কানফাটা কনসার্ট।

অর্কেস্ট্রার তালে তালে মঞ্চে প্রিন্সেসের এন্ট্রি ঘটে অভিনব কায়দায়- দুটো বাঘের উপর ভর করে নৃত্যের পোজে। বাঘ মানে নকল বাঘ। দুজন সুঠামদেহী মানুষের গায়ে বাঘের চামড়ার ডিজাইনের পোশাক মুড়িয়ে বানানো হয়ছে মেকি শার্দূল। প্রিন্সেসের গায়ে জমকালো ঝিকিমিকি পোশাক। তবে সংক্ষিপ্ত। আলোর বর্ণালি আভায় ঝলমল করছে তার ঝকমকে কস্টিউম। মানে দুটো কাটপিস। যতটুকু কাপড় পরনে থাকলে কাউকে অন্তত নগ্ন বলা যায় না, তারচে বেশি অনাবশ্যক কাপড় গায়ে নেই প্রিন্সেস রোজালিনার।

শুরু হয় প্রিন্সেসের মনমাতানো পারফরম্যান্স। বেজে ওঠে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক-- ‘জ্বলে জ্বলে জ্বলে জ্বলে জ্বলে রে আগুন/ জল ঢালিলে নিভে না সে জ্বলে রে দিগুণ’। গানের তালে তালে চলছে নৃত্যের ঝংকার। প্রিন্সেস আর ব্যাক-আপ ডান্সারদের উত্তাল নাচের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যুবকরাও শুরু করে বাঁধভাঙা নাচ। দর্শক সারিতে তখন কেবল একটাই ধ্বনি, ‘ওয়ান মোর, ওয়ান মোর’।

আমি এক দৃষ্টিতে প্রিন্সেসের দিকে তাকিয়ে থাকি। কে এই প্রিন্সেস! বড্ড চেনা-চেনা লাগছে। কোথায় দেখেছি ওকে? ভাবছি তো ভাবছি। কিন্তু কূল-কিনারা পাচ্ছি না। আমি যখন ভাবনার সাগরে ডুবে আছি, এরি মাঝে পারফরম্যান্স প্রায় শেষের দিকে। প্রিন্সেস মঞ্চে এসে ফ্লাইং কিস দিয়ে সকলকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানায়। একজন সহশিল্পী এসে প্রিন্সেসের গলায় ঝুলিয়ে দেয় একটা স্কার্ফ। ঘোষণা আসে, পরের নৃত্যটির মধ্য দিয়ে প্রিন্সেসের পরিবেশনার সমাপ্তি ঘটবে। যারা আগেও প্রিন্সেসের পারফরম্যান্স দেখেছে, তাদের এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা রয়েছে। গলায় স্কার্ফ বেঁধে ধবধবে শাদা শার্ট গায়ে নাচার মানেই হলো সেটাই প্রিন্সেসের শেষ নিবেদন।

নাচের সঙ্গে গান বেজে ওঠে, ‘আজ তুমি পাশে নেই, ফুলের সুবাসে নেই, দখিনা বাতাসে নেই, নেই নেই নেই নেই, কোনখানে তুমি নেই’। স্কার্ফ আর শার্টটাকে দেখেই আমার ভাবনার বৃত্ত বিন্দুতে পরিণত হয়। মন চলে যায় ছয়-সাত মাস আগের দৃশ্যে। দৃশ্যপট কমলাপুর রেলস্টেশন।

গাজীপুরের মৌচাকে আয়োজিত জাতীয় স্কাউট জাম্বুরি শেষ হয়েছে আগের দিন। পরদিন ফেরত আসবো কুমিল্লায়। স্টেশনে এসেই শুনি, ট্রেন তিন ঘণ্টা লেট। সেই মুখস্থ কাহিনি-- যান্ত্রিক গোলযোগ। অনুসন্ধানে গিয়ে কনফার্ম হলাম। মহানগর প্রভাতী সাতটা পঁয়তাল্লিশের পরিবর্তে এগারোটায় ছাড়বে। স্টেশনে লোক গিজগিজ করছে। কমলাপুর না হয়ে এর নাম হওয়া উচিত ছিল ঝামেলাপুর। দু-তিনটা ট্রেনের প্যাসেঞ্জার অপেক্ষায় আছে। একটা ট্রেনের সিডিউলে গণ্ডগোল হলে আরও কয়েকটার উপর সেই আছর তো পড়বেই। এ আর নতুন কী ঘটনা! এমনটা তো হরহামেশাই ঘটছে। আর আমাদেরও এমন গঞ্জনা গা-সওয়া হয়ে গেছে।

ওয়েটিং রুমে গিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য। তিল ধারণের ঠাঁই নেই। অগত্যা স্টেশন মাস্টারের রুমে যাই। সেখানের অবস্থা আরও বেহাল। যেন বরুড়ার শনিবারের হাট। একবার ভাবলাম, মামার বাসায় ফিরে যাই। ঘণ্টা দুয়েক বাদে আবার না হয় আসব। কিন্তু রাস্তার যানজটের তো কোনো মা-বাপ নেই। মিরপুর যাওয়া-আসায় জ্যামে পড়লে, আম-ছালা দুইই যাবে। অগত্যা যাত্রীদের ভিড় ঠেলে গেলাম প্লাটফর্মের দিকে- যদি ভাগ্যগুণে কোনো বেঞ্চিতে বসবার খানিকটা জায়গা মিলে!

ট্রলিব্যাগটা টানতে টানতে ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে যাই। প্লাটফর্ম তো নয় যেন যাত্রীর জঙ্গল। বসবার জায়গা তো দূরের কথা, পা টেকানোই দুষ্কর। মনে হয়, ঢাকার সব লোক জমায়েত হয়েছে স্টেশনের কোনো জনসভায়। বোধ করি এটা আমার এক ধরনের রোগ। হাসপাতালের ভিড় দেখে আমার মনে হয়, এদেশের সব লোকই অসুস্থ। এয়ারপোর্টে গেলে মনে হয়, দেশের সব লোকই বোধ করি বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। রেস্টুরেন্টের ভিড় দেখে ভাবি, কোনো বাড়িতেই বোধ করি চুলা জ্বলে না। সব্বাই পরের চুলায় খায়। আদালতপাড়ায় গেলে মনে হয়, এ দেশের সব লোকই বুঝি মামলায় জড়িত। সুপারমার্কেট, বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাট যেখানেই যাই, সবখানেই আমার প্রতিক্রিয়া একই রকমের।

আনমনে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই প্লাটফর্মের শেষ প্রান্তে। একটা বেঞ্চির এক পাশে বসে আছে একটি মেয়ে। বেঞ্চিতে বসে তালে তালে তার চুলের দুই বেণি আর পা-দুটো দুলিয়ে চলছে অবিরাম। একটা গুডজ-ট্রেন স্টেশন ছেড়ে যাচ্ছে। আর সেই ট্রেনের কু-ঝিকঝিক, কু-ঝিকঝিকই মেয়েটার পা-দোলানোর তাল-লয় জোগান দিচ্ছে। বেঞ্চির অন্য পাশটা খালি। অবাক কাণ্ড! দেখে তো আমি মহাখুশি। যাক, শেষ পর্যন্ত বসবার একটু জায়গা পাওয়া গেল।

বেঞ্চির কাছে যেতেই মেয়েটা মুচকি হাসে। উদ্দেশ্যমূলক হলেও নির্দোষ হাসি। বয়েস ষোলো-সতেরো হবে। শ্যাম বর্ণ। মুখমণ্ডলের আকৃতি লম্বাটে। দেহের গড়ন সুঠাম। ভরা যৌবনকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত হয়ে আছে ওর দেহ-মন। ইমিটেশনের ঝুমকা, গলার হার, নাকফুলে ভালোই মানিয়েছে ওকে। ঠোঁটে চমকা-লাল লিপস্টিক। লাল-সবুজের জরিন ফিতায় বাঁধা লম্বা-কুচকুচে কালো চুলের বেণি। দুই হাতে ডজন খানেক বেলোয়ারি চুড়ি। অনাবশ্যক রিনিঝিনি বাজিয়ে চলছে।

এ বয়েসে যেমন অসংলগ্ন উচ্ছলতা থাকে, মেয়েটাও তার ব্যতিক্রম নয়। পোশাক-আষাকে দারিদ্র্যের ছাপ থাকলেও পরিচ্ছন্ন। আচরণে কোনোই জড়তা নেই। সাধারণ এ মেয়েটার অসাধারণ হলো ওর চোখ। ডাগর ডাগর চোখ দুটি গভীর কাজল-দিঘি। ওর ঘায়েলি নজর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে পারে গোটা ট্রয় নগরী। মোট কথা, আভিজাত্য না থাক, গ্ল্যামার আছে। সম্মোহনী কেমন একটা মায়া-মায়া ভাব ধূমকেতুর পুচ্ছের দ্যোতির আভায় মুড়িয়ে রেখেছে ওকে।

বললাম, এখানে কেউ আছে?

  • না, কেউ বসে নাই। আপনে বইতে চান? তয় বইবেন ক্যামনে? এহানে তো কাছরা।

আরও খানিকটা কাছে গিয়ে দেখি ওখানে শুকনো এক দলা কাকের বিষ্ঠা। তখনি ব্যাপারটা দুধ-কা দুধ, পানি-কা পানি হয়ে গেলো। অ! তাহলে এই ব্যাপার! সে জন্যেই এ জায়গা খালি! বুঝলাম, কখনো কখনো মলও অনেক মূল্যবান।

মেয়েটা আরও খানিকটা লাজ কাটিয়ে আমার দিকে সাহসী নজরে তাকায়। এই নজরকে ‘দেখা’ না বলে ‘পড়া’ বলাই ভালো। মনে হলো, আমি যেন পশুপাখির রঙ-বেরঙের ছবি আঁকা খোকা-খুকুদের একটা প্রথম পাঠের বই। ও সেই বইয়ের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টিয়ে পুরো বইটাই এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলে। শেরে বাংলা বালকবেলায় কোনো বই একবার পড়েই নাকি গোটা বই মুখস্থ করে ফেলতন। এরপর সেই বই ছুড়ে ফেলে দিতেন। পার্থক্য এই যে, মেয়েটা আমাকে ছুড়ে ফেলে দেয়নি।

ওর হাতে একটা বাদামের ঠোঙা। শেষ কয়েকটা বাদাম ব্যস্ত হাতে বেঞ্চির উপর ঢেলে রাখে। আর ঠোঙার কাগজটা দিয়ে বেঞ্চির কাছরা মুছে ফেলে। ওড়নার আঁচলা দিয়ে সাফ-ছুতরার ফাইনাল টাচ দিয়ে বলে, ‘লেন সাব, বহেন। অহন আর কাছরা নাই।’

আমার খানিকটা ঘেন্না-ঘেন্না লাগছে। কিন্তু উপায় কী! দাঁড়িয়ে থাকবার এক রত্তি জোর নেই পায়ে।

পকেট থেকে দুটো ফ্যাসিয়াল টিস্যু পেপার বের করি। বেঞ্চির উপর বিছিয়ে দি আলতো হাতে। ‘ইয়া আল্লাহ্‌’ বলে যেই-না বসতে যাবো, অমনি টিস্যু পেপার দুটো হাওয়ায় উড়ে গিয়ে পড়ে যায় পাশের নর্দমায়। আর ততক্ষণে আমি ধপাস করে বসে পড়ি বেঞ্চিতে। ঘটনার নাটকীয়তায় আমি হতবিহ্বল। আমার করুণদশা দেখে মেয়েটা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়ে আমার উপর ঢলে পড়ে। একবার ওর মাথা আমার কাঁধে এসে আছড়ে পড়ে। আবার আমার বাহুতে ওর বাহু এসে ধাক্কা খায়।

প্রথমে খানিকটা বিব্রত হই। পরে ওকে এমন করে হাসতে দেখে আমিও হু-হু করে হেসে উঠি। কারণ, ব্যাধির মতো হাসিও সংক্রামক। হাসির তোড়ে উভয়ের মানসিক দূরত্বের বাঁধ ভেঙে যায়। খেই হারিয়ে ও আমার ডান হাতটা চেপে ধরে বলে, ‘এইডা কী অইলো সাব! বাতাস বেডায়ও আপনের লগে বাইছলামি কইল্লো!’

আমি ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি। এমন নির্মল, নির্দোষ হাসির নির্ঝর কতোদিন কারো মুখ থেকে ঝরতে দেখিনি। মুখশ্রীতে ফুটে আছে অমরাবতীর আদুরে ভাব। অঙ্গ যেন মায়ার খনি, মমতার অমর্ত্য।

তক্ষনি একটা বাজখাই শাসনের গলা বেজে ওঠে, ‘অই রোজেনা, তুই এহানে কী করছ? জানছনা, টেরেন লেইট আছে চাইর ঘণ্টা। অহন ঘরে যা-গা। আর এই সাবের লগে কিয়ের এতো ঢলাঢলি? বেদ্দপ মাইয়্যা কোনাইনের। যা, অহনই ঘরে যা।’

ঢলাঢলি শব্দটা খুবই আপত্তিজনক শব্দ। একবার চাইলাম, প্রতিবাদ করি। পরে রাগ কমিয়ে ফেলি। কারণ দুটো। খালাসির সঙ্গে ঝগড়ায় জড়ানো শোভন হবে না। দ্বিতীয়টার গুরুত্ব আরও বেশি। ওর চাচার সঙ্গে এখানে তর্কাতর্কিতে জড়ালে রোজেনার মনটা যে খারাপ হয়ে যাবে, তা শতভাগ নিশ্চিত। সেই রিস্কটা নিতে চাইনি। ব্যাপারটাকে তাই আমল দিলাম না তেমন। তবে আমার চেহারা লাল হয়ে যায়, চোখ জ্বলতে থাকে এ রকম অপ্রত্যাশিত অপমানে।      

আমার ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থা দেখে রোজেনার মুখটাও মলিন হয়ে যায়। ওর দুচোখ পানিতে টলটল করছে। তরতাজা একটা গাছে হঠাৎ বাজ পড়লে পাতাগুলো জ্বলে-পুড়ে যেমন খাক হয়ে যায়, রোজেনার হালও সে রকম। আমার সঙ্গে প্রথম দেখায় ওর চেহারাতে খুশির যে বিজলি চমকাতে দেখেছি, হয়তো এখনকার ঘটনাটা এই বজ্রপাতেরই পূর্বাভাস বা অগ্রবর্তী সংকেত ছিল।

রোজেনা একেবারে কুঁচকে যায়। অপ্রস্তুত হয়ে আমতা আমতা করতে থাকে। বলে, ‘হ চাচা, অহনই যাইতাছি।’

রোজেনা ওর কাপড়-চোপড়ের পলিব্যাগটা কোলে তুলে নেয়। ব্যাগের উপর দুই কনুই রেখে দুই গালে হাত রেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, ‘বাপ-মায়েরে ডেঙ্গুয়ে খাইছে। নানির কাছে বড় অইছি। অহন চাচাই মা-বাপ। তেনার কতা তো হুননই লাগবো সাব। আমার জন্মের পরে নাকি নানি আমারে কোলে লইয়া কইছে, আমার নাতিন ফুলের লাহান সুন্দর। ওরে আমি ‘ফুলি’ কইয়া ডাকুম। ‘হায় রে নসিব! নানির ‘ফুলি’র হাল অহন ‘কুলি’র থাইক্কাও বেহাল’ বলে হন-হন করে হাঁটতে থাকে রোজেনা।   

একটা লম্বা দৌড়ে মোটা পিলারটার পেছনের বস্তির দিকে যেতে থাকে। উঁকি-ঝুঁকি মেরেও ওর কোনো আলাজিলাই দেখতে পাই না। নিমেষেই হাওয়া। আমি ফাটা-বেলুনের মতো হঠাৎ চুপসে যাই। মানুষের মন বড় বিচিত্র। কখন কার জন্যে মন পোড়ে, মন নিজেই কি সে খবর জানে?

উদাস দৃষ্টিতে রোজেনার পথের দিকে তাকিয়ে থাকি কিছুটা সময়। ওদিকটায় লম্বাদৃষ্টি মেলে রাখি। না, এক্কেবারে লাপাত্তা। কিন্তু মনে কেমন একটা আশা জাগানিয়া ভাব জেগে আছে। ও আবার ফিরবে। তাই আমার ব্যাগটাকে বেঞ্চির উপর তুলে রাখি। মানে, সিট দখল। কেউ বসতে চাইলে বলব, লোক আছে। ওয়াশ রুমে গেছে।

পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সময় দেখি। কাগজ-কলম-ক্যামেরার মতো ঘড়িকেও গিলে খেয়েছে সেলফোন। এখন এটা মালটি-পারপাস ডিভাইস।

দেখি, ট্রেন ছাড়তে এখনও দুই ঘণ্টা বাকি। মনে হল, সময় ভারি হয়ে বুকের উপর চেপে আছে পাথর হয়ে। ঝুলে আছে ত্রিশূল হয়ে।

খচ-খচ করছে মনের ভেতরটা। আনচান ভাবটা কাটছেই না। বড্ড বউর্ড হচ্ছি। রোজেনার সঙ্গে কাটানো সময়টা স্মৃতি হয়ে আমাকে সঙ্গ দেয়। ধীরে ধীরে কাটতে থাকে একাকিত্ব। ভাবছি, মানুষ কত সবল প্রাণি! অথচ  ক্ষণিকের তুচ্ছ একটা বিষয় মানুষকে কতটা নাকাল করে দিতে পারে, তা মানুষের বোধের বাইরে। যত ভাবছি, ততই কাতর হচ্ছি।

রোজেনার ক্ষীণ ছায়া আমার মননের উপর যে দীঘল রেখাপাত করেছে, একে কী বলা যায়! সব ভাবনা ছাপিয়ে আমার মনের পর্দায় ভাসতে থাকে রোজেনার মায়াভরা চোখজোড়া, উদ্বিগ্ন মুখমণ্ডল। কানে বাজতে থাকে ওর বাঁধভাঙা খিলখিল হাসি। স্টেশনের কোলাহল আমার কানে বাজে না। হাজার লোকের ভিড় আমার চোখে পড়ে না। ট্রেন কখন ছাড়বে, সেই ভাবনাও আমাকে ভাবায় না। আনমনে কবিতার কলি আওড়াতে থাকি, ‘হাজার লোকের ভিড়ে কোন কোন মুখ/ অন্তরে ফেলে ছায়া ভুলিয়ে ভূলোক।’

উদাস হয়ে বসে থাকি কিছুটা সময়। বলা যায় ব্ল্যাংক লুক। দৃষ্টিতে সবই পড়ে, কিন্তু কিছুই যেন দেখতে পাই না। সেই মোটা পিলারটার দিকে নজর পড়ে। মনে হলো পিলারের আড়ালে কেউ একজন আছে। ডোরাকাটা একটা ওড়নার আঁচল হালকা বাতাসে দুলছে। হুঁ, তাই তো! এটা তো জরিনারই ওড়না। আমি উঁচু গলায় ডাকলাম, ‘জরিনা, ও-জরিনা।’ আড়াল থেকে মুখের খানিকটা বের করে মুখে আঙুল দিয়ে ও আমাকে চুপ থাকার সংকেত দেয়। যাক, আশ্বস্ত হলাম। মিথ্যে কুহকও যদি অন্তরে পুলক জাগায় সেই রোমাঞ্চও নিতান্ত মূল্যহীন নয়। আমার ভাবটা তখন ফুরফুরে।

খানিক বাদে রোজেনা হেলতে-দুলতে এসে হাজির হয়। আমার মেঘাচ্ছন্ন মন এখন পূর্ণিমা আলোয় ফকফকা। ব্যাগটা বেঞ্চি থেকে নামিয়ে রাখি। রোজেনা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ‘উফ বাবা’ বলে বসতে বসতে রাগ ঝাড়ে, ‘যন্ত্রণা আর ভাল্লাগে না। কোন সময়ে যে ছাইড়বো এই ছাতার টেরেন।’

  • রোজেনা, তুমি কি চিটাগাং যাবে?
  • না, সাব। কুলাউরা।
  • তোমাদের বাড়ি কি ওখানে?
  • না, ওখানে আমার নানার বাড়ি।

হাতের আঙুলে ওড়নার আঁচলের এক কোণ প্যাঁচাতে-প্যাঁচাতে আদিখ্যেতার সুরে বলে, ‘আমার বিয়া অইবো। পোলার বাড়ির লোগ আমারে দ্যাখতে আইবো। অই যে দ্যাখলেন না আমার চাচা। ইস্টিশনের খালাসি। তেনার লগে খালাসির কাম করে খালিক্কা। নানাগো গেরামের পোলা। হের লগেই বিয়ার কতাবার্তা অইতাছে।

  • অ আচ্ছা! বিয়ে হবে! সেটা তো ভালো খবর।
  • গজব কন সাব, গজব। এইডারে ভালো খবর কইয়েন না। একটা খালাসির কয় ট্যাঁহা কামাই, কন দেহি! হে কী খাইব, আমারেই বা কী খাওয়াইব? আর মাইয়াগো কত সাধ-আল্লাদ থাহে। সোনু-পাইডার, আলতা-লিপিস্টিক, টিপ-কাজল, শাড়ি-বেলাউজ, জেওর-গহনা, কায়ন-বালা, সাবান-খুশবো, ফিতা-কিলিফ। হে ক্যামনে বউ পালবো, কন দেহি?
  • তুমিও একটা কিছু করবে। দুজনের আয় দিয়ে সংসার ভালোই চালাতে পারবে।
  • আমি আর কী চাকরি করুম, সাব? লেহাপড়া তো ঠন-ঠনা-ঠন-ঠন। টাইন্না-টুইন্না কেলাস ফাইভ। তয় কইলাম সাব, খালিক্কারে বিয়া আমি করুমই না। নসিবে যা আছে অইব। নানিরে একনজর দেইখ্যা পলাইয়া চইলা আমু। রাজন সাবের কাছে কাইন্দা-কাইট্টা কমু। উনি ভালা মানুষ। মন গলাইতে পারলে ওনার গার্মেন্টসে একটা কাম পাইয়া যাইতে পারি।
  • রাজন সাহেব কে? বাড়ি কোথায়?
  • বাড়ি-টারি জানি না। উনি আমাগো বস্তির ইস্কুলে অনেক সাহায্য করেন। এইবার বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে ইস্কুলে আইছিলো। আমার নাচ-গানে খুশি অইয়া আমারে এক হাজার ট্যাঁহা পুরুস্কারও দিছে।

একটা ট্রেন এমন বিকট হুইসেল বাজিয়ে স্টেশনে ঢুকলো যে, রোজেনার শেষ কোথাগুলো ওই আওয়াজের নিচে চাপা পড়ে যায়।

  • এই চা, চা লাগবে, গরম চা আছে’ হাঁকতে হাঁকতে এক ছোকরা কাছে এসে দাঁড়ায়।
  • চা খাবে, রোজেনা?
  • না, সাব। আপনে খান।

আমি জোর করলাম। ওর মুখটা কেমন শুকনো শুকনো দেখাচ্ছে। ক্ষিধে পেলে মুখের ভাঁজে যেমন ভূখের আকুতি লেপ্টে থাকে। বললাম, ‘অসুবিধা কি, খাও না। ট্রেন ছাড়তে এখনও তো ঘণ্টাখানেক দেরি।’

  • আচ্ছা ঠিক আছে। না খাইলে আপনে মন খারাপ করবেন। তয় লন।

ওয়ান টাইম দুটি প্লাস্টিক গ্লাসে ছেলেটা দুজনের হাতে চা তুলে দিতে দিতে বলে, ‘বিস্কুট লিবেন, স্যার’?

রোজেনা বলে, ‘না, না, আমার লাগব না। সাবে খাইলে ওনারে দে।’

  • তুমিও খাও। খালি পেটে চা খেলে এসিডিটি হয়।
  • আপনে এত কতা জানেন ক্যামনে? আপনে কি ডাক্তর-কবিরাজ?
  • হ্যাঁ। আমি ডাক্তার। এই বছরই পাশ করেছি।
  • ডাক্তর? বুজছি, বুজছি। চিন্তা কইরেন না, সাব। নয়া অইলে কি অইবো। একদিন আপনেরেও আল্লায় আমাগো গেরামের উপেন কবিরাজের মতো বানাইব।’

গ্লাসটা হাতে নিয়ে রোজেনা ‘ছুউ...’ করে এমন জোরে চায়ে এক লম্বা চুমুক দেয় যেন ট্রেনের হুইসেল বাজছে। সেই ‘ছুউ’ আমার কানে উপদ্রবের মতো এসে ঠেকে। সো ইরিটেটিং। আমি ধৈর্য হারিয়ে খানিকটা রূঢ় কণ্ঠেই বলি, ‘আরে আস্তে। কী মুশকিল! এমন করে কেউ চা খায় নাকি?’ চাপা গলায় বলি, ‘স্টুপিড’।

আমার মেজাজের কোনো পাত্তা না দিয়েই রোজেনা বলে, ‘আওয়াজ দিয়া চা খাওনের মজাই অন্য রকম, সাব। ভদ্দলোকেরা বুইজবেন ক্যামনে? আপনেরা পুত-পুত কইরা চা খাইয়া যে কী মজা পান, কে জানে! চা-অলা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তয় আমারে একটা লোফ দে-রে পিচ্ছি’।

বেঞ্চির উপরে দুই পা উঠিয়ে আরাম করে বসে রোজেনা। চায়ের গ্লাসটা ওড়নায় প্যাঁচিয়ে দুই হাঁটুর ফাঁকে সাবধানে রাখে। লোফটা চায়ে চুবিয়ে যেই-না মুখের কাছে আনে, অমনি লোফের ভেজা অংশটা ধপ করে গ্লাসে পড়ে যায়। আর চা ছিটকে আমার গায়ে এসে পড়ে। চায়ের ছটায় ছোপছোপ দাগ পড়ে যায় আমার শার্টের সামনের দিকটায়।

‘হায়, হায়! তওবা, তওবা। এইডা কী অইলো!’ বলেই রোজেনা ওর ওড়নার আঁচল দিয়ে আমার শার্টে ছিটকে পড়া চায়ের ছটা মুছতে শুরু করে। আর অমনি ওর চায়ের গ্লাস আর লোফ নিচে পড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছত্রখান। চা গোল্লায় যাক। আমার শার্ট সাফ-ছুতরা করাই যেন এখন ওর একমাত্র মহান কর্তব্য। ওড়না দিয়ে ঘষতে ঘষতে আমার শার্টের খাল তুলে ফেলার অবস্থা।

ড্রেনের পাশেই একটা পানির ট্যাপ থেকে ফোঁটা-ফোঁটা পানি চুইয়ে পড়ছে। এক দৌড়ে গিয়ে ওড়নার এক পাশ ভিজিয়ে নিয়ে আসে রোজেনা। দ্রুতহাতে আবার শুরু করে পুরানো কসরত। ওর অতি দরদের মোছা-মুছিতে আমার শাদা শার্টের রঙ এখন পাণ্ডুবর্ণ। কোনো বাধা-নিষেধই কাজে আসেনি। কারণ, মহৎ কর্মে সব বাধাই নিষ্ফল। তখন আমার কাছে শার্টের চেয়ে রোজেনার উদ্বেগটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। শার্টের মায়ার চেয়ে ওর মনের টান আমাকে ওর দিকে টানতে থাকে। মনের অজান্তেই এক মন আরেক মনকে কোন রাজ্যে টেনে নিয়ে যায়, কে জানে! শার্টের ময়লা সাফ করার কাজে রোজেনা যখন মহাব্যস্ত, আমি তখন ওর চোখ দুটির সৌন্দর্যের অতলে ডুবে আছি।

আকাশ কাঁপিয়ে একটা গুডস ট্রেনের হুইসেল বেজে ওঠে। আমার ঘোর কেটে যায়। বললাম, ‘হয়েছে রোজেনা। রাখো। আর লাগবে না। ব্যাগে আরো শার্ট আছে। ট্রেনে উঠে বদলে নেবো।’

কিন্তু রোজেনার মুখটা মলিন। আগের সেই পুলক কোথায় যেন উবে গেছে।

স্টেশনের লাউড স্পিকারে অ্যানাউন্সমেন্ট শুনতে পেলাম। আমাদের ট্রেন তিরিশ মিনিটের মধ্যে ছাড়বে। আমি বললাম, ‘চলো রোজেনা। আমাদের প্লাটফর্মের দিকে এগোই।’

রোজেনা স্থবির। মনে হয় ওর পা চলছে না। যাবার যেন তেমন কোনো তাগিদই নেই। ওর পলিব্যাগটা এমনভাবে হাতে তুলে নিলো, মনে হলো সেটাতে কাপড়-চোপড় না, রয়েছে ইট-পাথর। এমনিতেই ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ের আয়োজন চলছে। উপরন্তু, শার্ট ময়লা করে আমার মন খারাপ করে দিয়েছে। সব মিলিয়ে ও-যেন একটা বিধ্বস্ত মানুষ।

আমি ওর মন ভালো করার চেষ্টা করি। মাথায় হাত বুলিয়ে দি। আঙুল দিয়ে চুলে খানিকটা বিলি কাটি। বেণি দুটোকে দুদিকে দুলিয়ে দি দোলনার মতো। খানিকটা কাছে টেনে বলি, ‘আরে, তুমি এখনও মন খারাপ করে আছো! বোকা মেয়ে। ভুলে যাও ওসব। হাসো, হাসো দেখি। গোমড়া মুখে তোমাকে প্যাঁচির মতো লাগে।’

প্যাঁচি শব্দটা শুনেই রোজেনা ফিক করে হেসে ফেলে।

আমি বললাম, ‘এই তো গুড গার্ল। তুমি আসলেই খুব ভালো মেয়ে। চলো, পা চালাও। তোমার টিকেট কোন ক্লাসের?’

  • টিকিট ? আমাগো আবার টিকিট-ফিকিট কী? আমার চাচা খালাসি। গোডা টেরেনই তো আমাগো। চিপা-চাপায় বইয়া চইল্লা যামু। চিন্তা কইরেন না, সাব। আমরা তো এমনেই যাই। কতো গেছি!
  • বলো কী! টিকেট করোনি! কী সাংঘাতিক কথা! টিটিই টিকেট চাইলে কী বলবে?
  • কমু, আমি কালু খালাসির ভাইতজি। নইলে দরজার তলে, বাথরুমে, দুই বগির মাইজে পলাইয়া থাকুম।
  • তোমারে জরিমানা করবে। জেলও হতে পারে।
  • জেল? আচ্ছা সাব, জেল কি বস্তিত্তুন গান্দা জাগা? খাওন ফিরি, থাওন ফিরি। আরামই আরাম। বলে হি-হি করে হাসতে থাকে।
  • হয়েছে, হয়েছে। এতো আরামের দরকার নাই। আর কথা না। তাড়াতাড়ি হাঁটো। ট্রেন মিস করলে আর রক্ষা নাই।

আমার টিকেট এসি চেয়ার কোচের। আমি কোচের পাশে এসে দাঁড়াই। ওয়ালেট থেকে পাঁচ শ টাকার একটা নোট বের করে বলি, ‘এই শোনো। এই টাকাটা রাখো। ট্রেনে টিটিই থেকে একটা ‘শোভন’ সিটের টিকেট কাটিয়ে নিও। বিনা টিকেটে একদম যাবে না কিন্তু, বুঝলে?’

‘না, না। ট্যাঁহা লাইগব না, সাব। আমার লগে ট্যাঁহা আছে’ বলেই রোজেনা ওর স্যালোয়ারের খোঁট থেকে টাকা বের করে আমাকে দেখায়। কিন্তু টাকার পুটুলির আকার দেখে মনে হলো না যে, ওখানে খুব বেশি টাকা আছে। তাই আমি আরও জোর করি। ও আমার হাতটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সামনের দিকে দৌড়াতে শুরু করে। আমি পেছন থেকে ডাকতে থাকি। পেছনের দিকে তাকিয়ে  ‘ট্যাঁহা লাগব না সাব’ বলে পা বাড়াতেই অমনি পা পিছলে ধফাস করে চিৎ হয়ে পড়ে যায়।

আমি তো হতভম্ব। কী হলো এটা! আমার কলজেটা মোচড় দিয়ে ওঠে। তখন প্লাটফর্মে পেসিঞ্জারের দৌড়াদৌড়ি, ছোটাছুটি। কে কার দিকে তাকায়! দু-তিনজন ওকে পায়ে দলে চলে গেলো। আতঙ্কিত হয়ে আমি ছুটে যাই রোজেনার কাছে। মাথার নিচে হাত দিয়ে ওকে টেনে তুলি। পাশে পড়ে থাকা পলিব্যাগটাও হাতে তুলে নেই। মাথার পেছনের দিকটা বেশ ফুলে গেছে। মিনারেল ওয়াটার বোতল থেকে দুই কোশ পানি নিয়ে ওর মাথার পেছনটা ভিজিয়ে দেই। মাথাটা-যে ফাটেনি, সেটাই শত জন্মের ভাগ্য। পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতেও পারছে না ভালো করে। ওর একপাশ লেপ্টে ধরে আমি আমার কোচের দিকে এগুতে থাকি। ওর ব্যাগটা আমার ট্রলিব্যাগের উপর রেখে বাঁ হাতে টেনে চলি। রোজেনা আমার ডান বাহুর উপর মাথা ফেলে উহ-আহ করতে থাকে। মুখে এখন খই না ফুটে ঝরছে কষ্টের ক্লেশ।

‘আচ্ছা, তুমি কি পাগল নাকি? মানুষের পায়ে পিষ্ট হয়ে তুমি তো আজ মারাই যেতে। কী সাংঘাতিক! ভয়ে আমার গা কাঁপছে।’

রোজেনা কোঁকাতে কোঁকাতে মুখে কষ্টের মুচকি হাসির রেখা টেনে আমার কথার জবাব দেয়, ‘মরলে তো খালিক্কার হাতেত্তুন বাঁইচ্চা যাইতাম। আমনে ডরাইয়েন্না সাব। চোট বেশি লাগে নাই। তয় আপনে না তুইল্লা আনলে আইজ খবর আচিলো। মাইনসের লাত্থি খাইতে খাইতেই দোম যাইতো। পরানডা আইজ আপনের লাইগ্যাই বাঁইচ্চা গেল, সাব। থ্যাংকু।’

ওর ‘থ্যাংকু’  শুনে আমার বেজায় হাসি পায়। হাসি চেপে বললাম, ‘আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে। এখন চুপ করে চলো আমার সঙ্গে।’

আর তখনি স্টেশনের ঘণ্টা বেজে ওঠে, গাড়ি ছাড়ার ঘণ্টা। ট্রেনের হুইসেল ওর যাত্রা-সূচনার সংকেত দেয়। আমার আর ভাবনা-চিন্তার সময় নেই। রোজেনাকে আমার কোচে রীতিমতো টেনে তুলি। অপ্রস্তুত হয়ে রোজেনা বলে, ‘কী করেন, সাব! কী করেন! এইডা তো ভদ্দলোকদের বগি।’

রোজেনার কথায় আমি কান দিলাম না।

আমার পাশের সিট ছাড়াও কোচের এখানে-ওখানে কিছু সিট খালি। ভাবছি যা হয় হবে, অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা।

ব্যাগ দুটো উপরে রেখে চোখ নামিয়ে দেখি, রোজেনা জুবু-থুবু হয়ে ফ্লোরে বসে আছে।

‘আরে করো কী? সিটের উপর বসো’ বলেই ওর কোনো বাধাকে পাত্তা না দিয়ে ওকে বসিয়ে দেই আমার পাশের খালি সিটে।

ট্রেন চলতে শুরু করে। আমি স্বস্তির শ্বাস ফেলি। ভাবি, ভাগ্যটা ভালো। পাশের সিটে নিশ্চয়ই কোনো প্যাসিঞ্জার নেই। থাকলে এতক্ষণে এসে যেত। যাক, আরামেই যেতে পারবে রোজেনা। সামনের সিটের পেছন দিকটায় মাথা ঠেকিয়ে ও চুপচাপ বসে থাকে।

দরজার দিক থেকে একটা খেদের গলা বেজে ওঠে। ‘এটা একটা দেশ হলো! ওরে বাপরে বাপ! ধানমন্ডি থেকে কমলাপুর আসতে দুই ঘণ্টা লেগে গেলো। আর এক মিনিট দেরি হলে তো ট্রেনটাই মিস করতাম। ও মাই গুডনেস!’

পেছন ফিরে দেখি, মধ্য বয়েসী এক ভদ্রলোক। হন্তদন্ত হয়ে ষোলো নম্বর সিট খুঁজছেন। রোজেনার কাছাকাছি এসে বললেন, ‘এটা আমার সিট, সিস্টার’।

ট্রেন তখন পুরোদমে চলতে শুরু করেছে। আমি বললাম, ‘মেয়েটা অসুস্থ। হোঁচট খেয়ে পড়ে ব্যথা পেয়েছে। আপনি যদি সামনের খালি সিটটাতে বসেন, খুব কি অসুবিধা হবে?’

উনি বললেন, ‘নো প্রোবলেম। দ্যাটস ওকে।’

ট্রেন ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন পার হয়। নতুন কোনো যাত্রী ওঠেনি। আমার টেনশন মোটামুটি কেটে যায়।

খানিক বাদে টিটিই আসে। রোজেনার টিকেট চাইতেই আমি বললাম, ‘ও টিকেট করতে পারেনি। পা পিছলে প্লাটফর্মে পড়ে গিয়ে খুব ব্যথা পেয়েছে। কুলাউড়া পর্যন্ত ওর টিকেট করে দিন, প্লিজ।’

টিকেট কাটতে কাটতে উনি তার চশমার উপর দিয়ে একবার আমার দিকে, আর একবার রোজেনার দিকে তাকান। হিসেব মেলাচ্ছেন। তবে হিসেবটা কি টিকেটের টাকার, নাকি আমার সঙ্গে মেয়েটার সম্পর্কের- সেটাই প্রশ্ন।

হাতে টিকেট নিয়ে দেখি এতে নানান কাটাকুটি। বললাম, ‘এত ওভাররাইটিং কেন ভাই? টাকার ফিগারটা কত, তাও তো ঠিকঠাক বুঝতে পারছি না।’

উনি বললেন, ‘হিসাব করতে গিয়ে একটু গরমিল হয়ে গেছিল।’

আমি মুখে একটা হাসির রেখা টেনে নিচু স্বরে বললাম, ‘দুই হিসাব একসঙ্গে মিলাতে গেলে গরমিল তো কিছু হবেই।’

টাকাটা গুনতে গুনতে টিটিই সাহেবও মুখে উদ্দেশ্যমূলক হাসি ঠোঁটে চেপে ধরে আমার হাতে টিকেট তুলে দিয়ে ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলে এগিয়ে গেলেন।

টিকেটটা হাতে নিয়ে আমি ডাকলাম, ‘রোজেনা, এই নাও তোমার টিকেট।’

রোজেনা তখনও ঝিমুচ্ছে। আমার ডাক শুনে মাথা তোলে। চোখ মেলে এদিক-ওদিক তাকায়। শরীরের আড়মোড় ভাঙে। বলে, ‘কী হইছে, সাব?’

  • কিছু হয়নি। তোমার টিকেট কেটেছি। এই নাও। আচ্ছা,পায়ের ব্যথাটা কি কমেছে?
  • এই বিষ-ব্যথায় আমাগো কিচ্ছু অয় না, সাব। একবার জানেন কী অইছিলো! আমাগো বস্তিত নাচ-গানের আসর জমাইছিলো বস্তির বড় ভাই। বাঁশের উপরে জলুই দিয়া তক্তা লাগাইয়া বানাইছে ইয়া বড় ইস্টিজ। গান বাইজা ওঠে, ‘আউলা বাতাস বইছে আমার বাউলা বদনে/ বন্ধের সনে হইব দেখা কোন সে ফাগুনে।’ আর আমার শয়তান বান্ধবি সবডিনে মিল্লা আমারে টাইন্না-টুইন্না ইস্টিজে তুইল্লা দেয়। নাইচতে নাইচতে হগলের হুঁশ হারাইয়া গেছিল সাব।
  • তুমি গাইতে পারো, নাচতেও পারো? দারুণ তো!
  • আরে হোনেন সাব, শেষে কী অইল। একটা জলুই আমার পায়ে বিন্দা রক্ত ঝইরা ইস্টিজ ভিজ্জা গেলো। বান্ধবীরা আমার ক্ষতে হলদির বাডা লাগাইয়া দেয়। আর বিষ-ব্যথা সব হাওয়া হইয়া উইড়া গেল।
  • তাইলে আমাকেও একটা গান শোনাও দেখি।
  • আরে কী কন, সাব? এত্তো মাইনসের সামনে? কি শরমের কতা!
  • স্টেইজে-যে তুমি এত্তো লোকের সামনে নাচ-গান করলে, তখন লজ্জা পাওনি?
  • হ্যারা তো আমাগো নিজেগো লোগ।
  • আমিও তো তোমার নিজের লোক।

‘আপনে আমার নিজের লোগ’ বলে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে রোজেনা। ‘ভালাই কইছেন’ বলে গুন গুন করে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে গাইতে শুরু করে, ‘তুমি কত রঙের রংগিলা রে তোমায় চেনা দায়/ তুমি ভাসাও, তুমি ডোবাও তরী যমুনায়।’

আমি হাততালি দিয়ে এপ্রিশিয়েট করি। রোজেনা লজ্জায় লাল হয়ে যায়। ওড়না টেনে লাজরাঙা মুখ ঢাকে।

কথায় কথায় সময় গড়ায়। এরই মধ্যে ট্রেন নরসিংদ পৌঁছায়। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। পাওরুটি, কলা, চা নিলাম।

রোজেনাকে বললাম, ‘এই নাও, খাও’।

   ‘আমি খামু না সাব’ বলেই মুখ ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু মানা করার মধ্যে তেমন জোর নেই। পেটে খিদে, মুখে লাজ।

‘আরে খাও, তোমার ক্ষুধা লেগেছে’ বলতেই রোজেনা আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, ‘আচ্ছা সাব, আপনে কি গণক? ক্যামনে বুইজলেন আমার ভূক লাগছে? দেন, দেন। পেট শান্তি তো দুনিয়া শান্তি।’

চা খাওয়া শেষ। আর অমনি মাথাটা জানলায় হেলান দিয়ে বিড়বিড় করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। মনে হলো, হবু বরের চৌদ্দপুরুষ উদ্ধারের মন্ত্র জপ করছে।

এরি নাম কি স্লিপিং বিউটি? ঘুমন্ত সৌন্দর্য কাকে বলে জীবনে প্রথম দেখলাম। ওর চেহারায় ক্লান্তির ছাপ, তবে জ্যোতির কমতি নেই। মাথার সামনের পাতলা চুলগুলো হালকা বাতাসে কপালের উপর আনন্দে দুলছে। নারীত্বের মুকুল যে-যৌবনে ফুটি-ফুটি করে, সেই কমনীয়তা অতুল্য। অপলকে আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। জীবনের এমন জীবন্ত রূপ অভূতপূর্ব। যৌবনের নামই বোধ করি জীবন।

একটানা ঘুমে কোনো ছেদ পড়ে না রোজেনার। এসির আরামে এমন শান্তির ঘুম জীবনে ঘুমায়নি সে। অগত্যা ওকে জাগাতেই হলো।

বললাম, ‘রোজেনা! সামনের স্টেশন আখাউড়া। তোমার নামতে হবে। গোজগাজ করে নাও।’

রোজেনা মিটিমিটি চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনে এহনো আপনের জামাডা বদলান নাই, সাব?’

-   কী দরকার? কুমিল্লা তো প্রায় এসেই গেছে।

  • আপনের বেগম সাব এই হালে দ্যাখলে আপনেরে তো কিছু কইবো না, সব কাহিনি হুইন্না কইবো, মাইয়্যাডার মাথার ইস্কুরু ঢিলা আছে।

আমি হু-হু করে হেসে উঠি। বেগম সাব! বেগম সাব কোথায় পাবো? আরে, আমি তো বিয়েই করিনি।

  • আস্তাগফিরুল্লা। তয় সাব জামাডা বদলাইলে আপনেরে আরও সাব-সাব লাগবো। দেকতে  ভাল্লাগবো। আপনের জামাডার দিগে নজর পড়লেই আমারে চোর-চোর লাগে।

হাসতে হাসতে আমি ব্যাগটা নামিয়ে সিটের উপর রাখি। ব্যাগ খুলে উপরের শার্টটা টেনে বের করি। অমনি পাশে ভাঁজ করে রাখা আমার স্কাউট স্কার্ফটা নিচে পড়ে যায়। রোজেনা ওর পায়ের কাছ থেকে সেটা তুলে নেয়। একটা ঝাড়া মেরে আমার দিকে স্কার্ফটা এগিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘বাহ, সুন্দর তো! এইডা কী সাব? আমার বেণির ফিতার মতো লাল-সবুজ ডোরা কাটা।

  • তোমার পছন্দ হয়েছে? তুমি নেবে?
  • না, না, সাব। আমি এইডা দিয়া কী করুম।
  • তুমি এটা গলায় ঝুলিয়ে নাচবে। বিন্দাস লাগবে।

রোজেনা হি-হি করে হেসে ওঠে। আমি স্কার্ফটা ভাঁজ করতে থাকি। রোজেনা স্কার্ফটার দিকে তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে। ওর নজরের ভাষা স্পষ্ট- ‘স্কার্ফটা পেলে ভালোই হতো।’

আমি স্কার্ফটা এগিয়ে দিয়ে বলি, ‘নাও, এটা তোমার কাছেই রাখো। এটা আমাদের পরিচয়ের  চিহ্ন।’

কাঁপা-কাঁপা হাতে স্কার্ফটা তুলে নেয় রোজেনা। খুশি-খুশি একটা আবেশ ছড়িয়ে ওর ব্যাগের একেবারে নিচে অতি যত্নে স্কার্ফটা রেখে দেয়। আমারও মনে হলো, প্রিয় জিনিস নিজের কাছে রাখার আনন্দের চেয়ে প্রিয়জনকে দিয়ে দেয়ার আনন্দ অনেক অনেক বেশি।

ওয়াশ রুমে গিয়ে আমি জামা বদলে আসি। রোজেনা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি-মুচকি হাসে। দুই আঙুল জুড়ে ইশারায় দেখায় দারুণ লাগছে। মনে হলো, এতো লোক না থাকলে ও হয়তো সিঁটিই বাজিয়ে বসতো।

সিটের উপরে রাখা আমার ব্যাগের ডালাটা খুলে ময়লা জামাটা অন্য কাপড়-চোপড় থেকে খানিকটা আলাদা করে কিনারা ঘেঁষে রেখে দেই। ব্যাগের চেইনটা যখন লাগাতে যাব ঠিক তখনি রোজেনা চেঁচিয়ে ওঠে, ‘হায় আল্লাহ, আপনের মোবাইল কই সাব?’

আমি প্যান্টের এ-পকেট, ও-পকেট খুঁজে দেখি, না, মোবাইল তো নেই। ভাবলাম, ওয়াশরুমে ফেলে আসিনি তো!

    দ্রুতপায়ে ছুটে যাই ওয়াশরুমের দিকে। বেসিনের উপর, এদিক-ওদিক সবখানেই খুঁজে দেখি। না, কোথাও পেলাম না। মন খারাপ করে ফিরে আসি।

    রোজেনা মুখে একটা উৎফুল্লের হাসি। আমার দিকে মোবাইলটা তুলে ধরে বলে, ‘সিটের উপরে ফেলাইয়া গেছিলেন সাব, এই লেন।’

    আমি রোজেনার মতো করে বললাম, ‘থ্যাংকু।

দুজনেই হু-হু করে হেসে উঠি।  

ব্যাগের চেইন লাগিয়ে ওটাকে উপরে রেখে আমি দাঁড়িয়ে থাকি যাতে রোজেনার নামতে সুবিধা হয়। ট্রেন আখাউড়া ছুঁই-ছুঁই। নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে ও নামবার প্রস্তুতি নেয়। আমিও ওর সঙ্গে দরজা তক এগিয়ে যাই। ওর হাঁটাচলা তখনও তেমন স্বাভাবিক হয়ে আসেনি। আমি বললাম, ‘আস্তে রোজেনা, সাবধানে নামো। দেখো, আবার পড়ে যেয়ো না। এবার কিন্তু আমি সঙ্গে নেই।’

রোজেনা প্লাটফর্মে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। খানিক বাদেই ট্রেনের হুইসেল বেজে ওঠে। চলতে শুরু করে ট্রেন। আমি হাত ইশারায় রোজেনাকে যেতে বলি। রোজেনা ট্রেনের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রথমে হাঁটে, পরে দৌড়াতে থাকে।

  • ‘ও সাব, আমারে কি আপনের পছন্দ অইছে?’
  • হ্যাঁ, রোজেনা। আমি তোমাকে খুউব পছন্দ করেছি।

হুইসেলের বিকট আওয়াজের রেশ আর ট্রেনের কু-ঝিকঝিকে চাপা পড়ে আমার কণ্ঠ রোজেনার কান অবধি পৌঁছুলো কি না, কে জানে!

রোজেনাকে আমি স্টেশনে ছেড়ে এসেছি; আর ওর কাছে ছেড়ে এসেছি আমার মন।

বাসায় ফিরে ব্যাগ খুলি। বিশেষ করে ময়লা শার্টটা লন্ড্রিতে পাঠানোর জন্যে। দেখি, শার্টটা নেই। মনে মনে ভাবলাম, শার্টটা কি ভুলে ব্যাগে ঢুকাতেই ভুলে গেছি। নাকি সিটের নিচে পড়ে গেছে!

ব্যাগের সবকিছু বের করে পই পই করে খুঁজলাম। না কোথাও নেই। ব্যাগের কোনায় সোনালি রঙের কিছু একটা পড়ে আছে। হাতে তুলে দেখি ঝুমকা। কী ব্যাপার! এই রকম ঝুমকা তো রোজেনার কানে দুলতে দেখেছি। হ্যাঁ, এটা ওরই তো ঝুমকা। আমি নিশ্চিত। কিন্তু এটা এখানে এল কেমন করে? তাহলে কি আমার ময়লা শার্টটা রোজেনা নিয়ে গেছে, আর ওর কানের ঝুমকাটা রেখে গেছে আমার জন্যে!

এ এক তাজ্জব ব্যাপার। যাকে কাছে পাবার উপায় নেই, তবুও সে কাছেই টানতে থাকে। সেই টান প্রাণের শেকড়ে গিয়ে লাগে। রোজেনার ঝুমকাটা আমার মনখারাপের সঙ্গি। ক্রিস্টাল কাসকেটে ওটাকে যত্ন করে রেখে দিয়েছি আমার চেম্বারে।

আমি যখন রোজেনার স্মৃতির অতলে ডুবে আছি, তখন হঠাৎ অনুষ্ঠানের কনসার্ট থেমে যায়। আমি ভাবি, সেদিনের রোজেনা আজ রোজালিনা। কোন কারিগরের হাতে পড়ে রোজেনার এই রূপান্তর! কোন বড়লোকের আশীর্বাদ-আনুকূল্যে রোজেনার এমন তরক্কি! কোন দরদি মানুষের সুনজরে পড়েছে সে! গলি থেকে রাজপথ! পাতাকুড়ানি থেকে মহারানি। ফুলি থেকে এক্কেবারে প্রিন্সেস।

রুম্মান আমকে ধাক্কা দিয়ে বলে, ‘ওই সায়েম, কোথায় খোআইয়া গেলি? যাবি না। সিটে কি সুপার-গ্লু লাগানো নাকি?’

আমার ঘোর কাটে। আশপাশ তাকিয়ে দেখি, সব সিট ফাঁকা।

রোজেনার সঙ্গে দেখা করার জন্য মনটা উতলা হয়ে ওঠে। আবার খানিকটা বাধো-বাধোও ঠেকছে। ভেবে-ভেবে কূলকিনারা পাই না। রুম্মানের সঙ্গে ব্যাপারটা শেয়ার করতেও মন সায় দেয় না। প্রতিটা মানুষেরই বোধ করি এমন দু-একটা একান্ত নিজস্ব কথা থাকে, যা মৃত্যু পর্যন্ত সে কারো সঙ্গে শেয়ার করে না।

তখন হলরুমের প্রবেশপথের পাশের গ্রিনরুমের দরজায় এক ধরনের চাঞ্চল্য লক্ষ করি। কৌতূহল বশত আমিও এগিয়ে যাই। প্রিন্সেস গাড়িতে উঠেছেন। স্বেচ্ছাসেবকরা গাড়ির দিকে ভিড়তে দিচ্ছেন না দর্শকদের। দেখি, রাজন ভাই প্রিন্সেসকে সি-অফ করতে যাচ্ছেন। আমিও ওনার পিছু পিছু যাই। স্বেচ্ছাসেবকরা জায়গা করে দেয়।

রাজন ভাই গাড়ির জানলার পাশে গিয়ে প্রিন্সেসকে ধন্যবাদ জানায়। কিন্তু প্রিন্সেস আনমনা। রেসপন্স নেই। ভেরি কোল্ড রিয়েকশন। ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে অবাক নজরে। রাজন ভাই ‘বাই-বাই’ বলে দুপা পিছুতেই গাড়ি চলতে শুরু করে। প্রিন্সেস গাড়ির জানালার কাচ তুলতে তুলতে বললেন, ‘নয়া ডাক্তার, ডু ইউ লাইক মি স্টিল?’