ক্যাসিনোকাণ্ড: তিন বছরেও অন্ধকার ঘোচাতে পারেনি ক্লাবগুলো

প্রকাশ | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৮:৩২ | আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৯:৫৩

আব্দুল হামিদ, ঢাকাটাইমস

রাজধানীর ফকিরাপুল, গুলিস্তান ও ধানমন্ডিসহ বিভিন্ন এলাকার ক্লাব পাড়ার লাল-নীল ও হলুদ বাতির সঙ্গে সাদা বাতির মিশ্রণে এক অন্য আলোর ঝলকানি। এসব রঙের রশ্মি নিভে যাওয়ার তিন বছর পূর্ণ হলো আজ। এই তিন বছরেও বন্ধ ক্লাবের অন্ধকার ঘোচেনি।  

২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বিকাল গড়াতেই ক্লাবগুলোর আকাশ কালো হতে থাকে। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ঘুটঘটে অন্ধকারে ছেয়ে যায় পুরো এলাকা, যেখানে গত তিন বছরে আলোর ছটা পড়েনি। এই ক্লাব ঘিরে যাদের জীবনচক্র ঘুরত আজ তারাও খোঁজ রাখে না। অনেকেই এলাকা থেকে চলেও গেছেন।

শনিবার দুপুরের পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ফকিরাপুল ইয়ংমেনস, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ, দিলকুশা স্পোটিং ক্লাব ও গুলিস্তানে মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব ঘুরে এক ভূতুরে পরিবেশ দেখা গেছে। ক্লাবগুলোর বন্ধ দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখা যায়, ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আর বাতাসে ভেসে আসছে আসবাবপত্র পচা গন্ধ। এছাড়া এটি যে একটা ক্লাব, তা বোঝারই উপায় নেই এখন। আগে যারা ক্লাবগুলোতে ঘুরত দুমুঠো খাবারের জন্য। তারা আজ উঁকি মেরেও দেখে না কী অবস্থায় আছে ক্লাবগুলো।

এই ক্লাব ঘুরে যারা বাঁচত তারা আসে কিনা জানতে চাইলে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের দারোয়ান বলেন, ‘এই ক্লাবে আসা তো দূরের কথা। এর দিকে কেউ তাকালেও সমস্যায় পড়ার ভয় করে।’

আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ ক্লাবের পাশে এক হোটেল মালিকের ঢাকাটাইমসের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয়। হোটেল মালিক বলেন, ‘গত তিন বছর আগের কথা। পুরোটা বিষয় মনে থাকার কথা নয়। তবে যেটুকু মনে পড়ে তাতেই গায়ের পশম কাটা দিয়ে উঠে। পুরো এলাকা ছিল কালো পোশাক পরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর (র‌্যাব) সদস্যে ঠাসা।

 তিনি বলেন, এই ঘটনা ঘটার কয়দিন আগ থেকেই অপরিচিত মানুষের আনাগোনা বেড়ে গিয়েছিল। ঘটনার দিন সকাল থেকেই অপরিচিত মুখের সংখ্যা বেড়ে যায়। আর বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে তাদের সংখ্যা। কিন্তু দুপুরের পরে পরিস্থিতি পালটাতে থাকে।

কারণ দুপুরের পরে ক্লাবগুলোতে আসতে থাকে ক্যাসিনো বোর্ডের ক্যাশিয়ার, ওয়েটার, মদের পেয়ালা ভর্তি করে ক্যাসিনো বোর্ডে সরবরাহ করা তরুণ-তরুণীরাও। সন্ধ্যায় পুরো এলাকা থাকত মুখর, যা চলত প্রায় ভোর রাত পর্যন্ত। এসময় সা, সা মোটরসাইকেল আর প্রাইভেটকারের শব্দ আর হৈচৈয়ে বিরাম পাওয়া যেত না।

এই ব্যক্তি বলেন, ‘দুপুর গড়াতেই সিটি সেন্টারের পাশ দিয়ে হুইশেল বাজাতে বাজাতে আট-দশটা র‌্যাবের গাড়ি এসে হাজির। ধুপধাপ করে গাড়ি থেকে নেমে ক্লাবগুলোর মুখে অবস্থান নেয় র‌্যাবের সদস্যরা। আর অফিসাররা ক্লাবের মধ্যে প্রবেশ করে যে যেখানে, যে অবস্থায় আছে বসতে বলেন। পাশ থেকে এক অফিসার কর্কশ ভাষায় বলছেন, কেউ কোনো নড়াচড়া করার চেষ্টা করবেন না। এরই মধ্যে থেমে গেছে, সাউন্ড বক্সে বাজাতে থাকা গান আর নাচের তাল।’

‘কিছুক্ষণ পরে আসতে থাকেন মিডিয়ার গাড়ি আর সাংবাদিকরা। অল্প সময়ের মধ্যে পুরো এলাকা শ্মশানের মতো স্তব্ধ হয়ে যায়। প্রথমে ইয়ংমেনস ক্লাবে। পরে একে একে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ ও দিলকুশা স্পোটিং ক্লাব হানা দেয় র‌্যাব। একই গলিতে হওয়ায় বেশি বেগ পেতে হয়নি র‌্যাবের। এ যেন এক ঢিলে চার পাখি শিকার’ বলেন ওই হোটেল মালিক।

এই হোটেল মালিক আরও বলেন, ‘ওই ঘটনার পর থেকে এই এলাকায় আর কেউ আসে না তেমন। এছাড়া এখন এই গলির ব্যবসার অবস্থাও ভালো না। আগের তুলনায় এখন এক-তৃতীয় অংশ কেনাবেচা হয়।’

তবে সম্রাটের জামিনের পরে এই এলাকায় দেখেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সম্রাটকে এমনিতেই এলাকায় কম দেখেছি। আর জামিনে মুক্তির পরে এলাকায় আর দেখা যায়নি তাকে।’

অবৈধ ক্যাসিনো ও মদের আসর চালানোর অভিযোগে ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বিকাল সাড়ে পাঁচটায় ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবে প্রথম অভিযান চালায় র‌্যাব। সেখান থেকে ২৫ লাখ টাকাসহ ১৪২ জনকে আটক করা হয়। জব্দ করা হয় বিপুল পরিমাণ মদের বোতল।

এরপর একে একে আরও কয়েকটি ক্লাবে অভিযান চালানো হয়। রাজধানীতে ক্লাবপাড়া বলে পরিচিত ফকিরাপুলের এক গলিতেই অবস্থান ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ, ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবসহ আরও বেশ কয়েকটি সংগঠন। এই ক্লাবগুলো অধিকাংশ গড়ে উঠেছে গত শতকে। এর বাইরে গুলিস্তানে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্লাবে চালানো হয় অভিযান। তালা পড়ে সব কটিতেই।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ফকিরাপুলের ক্লাবপাড়ায় সন্ধ্যার পর ভূতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয়। আর আবর্জনায় ভরে উঠেছে অনেক ক্লাবের আঙিনা। জং ধরা ফটক ভেঙে পড়ছে কোনো কোনোটির। জং ধরেছে ফটকের তালায়। আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে তালাবদ্ধ এসব ক্লাব। কবে তালা খুলবে সে কথা বলতে পারছে না কেউ। ইতিমধ্যে দরজা-জানালা ভেঙে চুরি হয়ে গেছে অনেক মূল্যবান আসবাবপত্র।

ক্লাবগুলোর বর্তমান অবস্থান জানতে সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়েছিলেন এই প্রতিবেদক। মতিঝিলের ৩৮ তলা সিটি সেন্টারের পেছনে আরামবাগের একই গলিতে আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ, ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাবসহ পরপর চারটি ক্লাব। ফটকের সামনে দেখা গেছে ময়লা আবর্জনাসহ ভাংড়ি গাড়ি। ক্লাবগুলোর প্রধান ফটকে ঝুলছে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক পোস্টার, বাসা ভাড়ার টু-লেট। বদ্ধ ফটকে ঝুলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লাগানো তালা। মরিচা পড়ে গেছে অনেক তালায়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, ‘ক্লাবের ভেতরে এখন আর কিছুই নেই। সবই চুরি হয়ে গেছে। চুরির ব্যাপারে অভিযোগও করা হয় মতিঝিল থানায়।’

খেলাধুলার স্বাভাবিক কার্যক্রম ফিরিয়ে আনতে বন্ধ ক্লাবগুলো খুলে দেয়ার জন্য বেশ কয়েকবার মতিঝিল থানায় আবেদন করা হয়েছে বলে জানান ক্লাবের কমিটিতে থাকা কয়েকজন নেতা। তবে ওপর মহলের নির্দেশ এলেই কেবল ক্লাব খোলা হবে- বলছে পুলিশ।

মতিঝিল জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) এনামুল হক মিঠু ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ক্লাব কর্তৃপক্ষ পুলিশের কাছে আবেদন করে কোনো কিছুই হবে না। ক্লাব খুলে দেয়ার ক্ষমতা রাখে আদালত। আদালত থেকে নির্দেশনা এলে পুলিশ গিয়ে সেটা খুলে দিতে পারবে, তার আগে কিছু করার নেই।’

যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল বলেন, ‘ক্লাবগুলো আইনগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খুলতে হবে। কারণ সেটা আইনগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সিলগালা করা হয়েছে। ক্লাবগুলোসহ ফেডারেশনকে এ ব্যাপারে আরও উদ্যোগ নেয়া দরকার। পাশাপাশি যেখানে যেখানে বলা দরকার সেখানে আমাদের কাজে লাগাতে পারে তারা।’

এদিকে মাঠে গড়ানো কয়েকটি ফুটবল টুর্নামেন্টের ফিকশ্চারে নাম আছে ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, আবাহনী, মোহামেডান স্পোর্টিং ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের।

বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) খেলছে আবাহনী, মোহামেডান, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র। আর বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে খেলছে ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব। বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশনের ২য় বিভাগে কাবাডি লিগ-২০২১ এর ফিকশ্চারে দেখা য়ায় দিলকুশা স্পোটিং ক্লাবের নাম।

বন্ধ ক্লাবগুলোর কয়েকজন নীতি-নির্ধারক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বর্তমানে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ক্লাব-মেস ভাড়া নিয়ে যেভাবে চলছি, এভাবে একটা ক্লাবের খেলা চালানো কষ্টকর।’

(ঢাকাটাইমস/১৮সেপ্টেম্বর/এএইচ/এফএ)