বিদ্যুৎ উৎপাদনে সর্বাধিক গুরুত্ব

প্রকাশ | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৮:১৫ | আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৮:৪২

ওমর ফারুক, ঢাকাটাইমস

সভ্যতার উন্নয়নের অন্যতম নিয়ামক বিদ্যুৎ। সেই বিদ্যুতে এখন অনেকটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। সময়ের সঙ্গে দেশের বিদ্যুৎ খাতকে সমৃদ্ধ করতে নানামুখী প্রকল্প এবং উদ্যোগ গ্রহণ করে সরকার। বাংলাদেশে স্বাধীনতা অর্জনের পরবিদ্যুৎ খাতের সার্বিক উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে গতি প্রদান করতে ১৯৭২ বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) এবং পল্লী অঞ্চলের বিদ্যুতায়নকে ত্বরান্বিত করতে ১৯৭৭ সালেবাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি)স্থাপন করা হয়।

ক্রমাগত চাহিদার ভিত্তিতে দেশের বিদ্যুৎখাতে নানামুখী প্রকল্প যুক্ত হয়েছে। কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ থেকে শুরু করে  গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, এলএনজি, তরল জ্বালানি, ডুয়েল-ফুয়েল, পরমাণু বিদ্যুৎ এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ করেছে সরকার।

প্রাকৃতিক গ্যাসের বিকল্প হিসেবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার পায়রা, মহেশখালী ও মাতারবাড়ি এলাকাকে পাওয়ার হাব হিসেবে চিহ্নিত করে একাধিক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: রামপাল ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট মৈত্রী সুপার থার্মাল প্রজেক্ট, মাতারবাড়ি ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কোল প্রজেক্ট এবং পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রকল্প।

এর মধ্যে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পের সামগ্রিক কাজ ৬০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। এ বিষয়ে প্রকল্পের প্রধান পরিচালক আবুল কালাম আজাদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতির কাজ ৬২ ভাগ এবং পোর্ট ও পাওয়ার প্ল্যান্ট কাজের ভৌত অগ্রগতির কাজ ৮০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। আশা করি ২০২৪ সালের মধ্যেই আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেতে পারবো।

তাছাড়া যৌথ বিনিয়োগে মহেশখালী হাবে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়াও রাশিয়ার কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় রূপপুরে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের উদ্যোগে পায়রা ২ হাজার ৬৬০ মেগাওয়াট থার্মাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইউনিট-১ (৬২২ মেগাওয়াট) এবং ইউনিট-২ (৬২২ মেগাওয়াট)-এর বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়েছে।

২০২৪ সালের মধ্যে কয়লা ব্যবহার করে দেশে প্রায় ১২,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ সরকার। এছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট ও ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণকল্পে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
দেশের বিদ্যুৎ খাত ইতোমধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে।২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ১৮ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। ফলে বিদ্যুতের সুবিধাভোগী গ্রাহকের সংখ্যা ৪৭ থেকে উন্নীত হয়েছে ৯৯ ভাগে।

বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে নানাবিধ পরিকল্পনা

দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি এবং সরবরাহ নিশ্চিত করতে সরকার বেশ কয়েকটি প্রকল্প গ্রহণ করে। যা দেশের বিদ্যুৎ খাতকে অনেকাংশেই এগিয়ে নিয়ে গেছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেশ কয়েক ধরনের শক্তি ব্যবহার করা হয়। পাওয়ার সিস্টেম মাষ্টার প্ল্যান ২০১০ অনুসারে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে কয়লাকে মূল জ্বালানি হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। এই পরিকল্পনা অনুসারে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৫০ শতাংশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে কয়লা ব্যবহার করে। অপরদিকে ২০২৪ সালের মধ্যে কয়লা ব্যবহার করে দেশে প্রায় ১২,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ সরকার।

বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে কয়লা ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা শুরু হয় বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার হামিদপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহারকৃত কয়লার মূল উৎস বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি। বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিটি ১৯৯৪ সালে উদ্বোধন করা হয়। এ খনির উৎপাদিত কয়লা দিয়ে দেশের প্রথম ২৭৫ মেগাওয়াট ধারণ ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল।

২০০৩ সালের ২৩শে এপ্রিল দেশে প্রথম তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপিত হয়ে ২০০৫ সালে কেন্দ্রটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ২টি স্থাপিত হওয়ার পর উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় বিদ্যুতের চাহিদার একটি বড় অংশ এখান থেকে পূরণ করা হচ্ছে। ২৮২ একর জমির উপর নির্মিত ৩টি ইউনিটে  প্রতি বছর প্রায় ৮ লাখ ৪০ হাজার টন কয়লা ব্যবহার হচ্ছে।

২০১৪ সালে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের তৃতীয় ইউনিট নির্মাণ করা হয়। ২০১৭ সালের ২৬ডিসেম্বর তৃতীয় ইউনিটটি পরীক্ষামূলক চালু হয়। চালুর পর থেকে তৃতীয় ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ চলছে। ২০২০ সালে কোভিডের মাঝেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে পর্যায়ক্রমে ৩টি  ইউনিট থেকে দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় কৃষি ও শিল্প কলকারখানার উৎপাদন বৃদ্ধিতে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৫২৫ মেগাওয়াট।

পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র

পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার ধানখালী ইউনিয়নে অবস্থিত। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত প্রকল্পটির ১ম ধাপের ৯৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়। বাংলাদেশের নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার কোম্পানি ও চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশনের (সিএমসি) মধ্যে যৌথ উদ্যোগে নির্মিত হয়েছে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি।
পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহারকৃত কয়লার মূল উৎস হলো ইন্দোনেশিয়া, চীন ও অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করা কয়লা। ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ২০১৯ থেকে উৎপাদন শুরু করেছে।পরীক্ষামূলক চালানোর পর ২০২০ সালের ১৫ই মে প্রথম কেন্দ্রটি পুরোপুরি উৎপাদনে আসে। আর দ্বিতীয় ইউনিট বাণিজ্যিকভাবে কাজ শুরু করে সেই বছরের ডিসেম্বর মাসে। তবে সঞ্চালন লাইন পুরোপুরি নির্মাণ শেষ না হওয়ার কারণে সেই বিদ্যুৎ ব্যবহার করা যায়নি।

এখন পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত, আমিনবাজার-মাওয়া-গোপালগঞ্জ-মোংলা পর্যন্ত সঞ্চালন লাইন তৈরি করা হয়েছে। ১২ হাজার টন কয়লা পুড়িয়ে বর্তমানে এই প্ল্যান্টে ৭০০ থেকে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে।

রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে সাম্প্রতিক সময়ের সবচাইতে আলোচিত ও সমালোচিত তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্প হল রামপাল তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্প। ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি খুলনা বিভাগের বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলায় অবস্থিত। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে নির্মিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহারকৃত কয়লার মূল উৎস হবে ভারত থেকে আমদানি করা কয়লা।

গত ৬ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র যৌথভাবে উদ্বোধন করেন।

২০১০ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) এবং ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জাতীয় তাপবিদ্যুৎ কর্পোরেশন (এনটিপিসি) এর মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে সংস্থা দুটি ২০১৬ সালের মধ্যে রামপাল তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্পের বাস্তবায়ন করতে সম্মত হয়। বাংলাদেশ ও ভারত সমানভাবে এই প্রকল্পের মূলধনের ৩০ শতাংশ বহন করছে।

সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কয়লা পরিবহন করা হবে সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে। ফলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু হলে তা বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের পরিবেশ এবং জীব বৈচিত্র্যের জন্য গুরুতর ক্ষতি সৃষ্টি করতে পারে। এর জন্য ২০১৬ সালে ইউনেস্কো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কথা উল্লেখ করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ করার জন্য অনুরোধ জানায়।
তবে বাংলাদেশের বিভিন্ন পরিবেশ সংরক্ষন সংগঠন, তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি ও বিভিন্ন বাম-দল এই প্রকল্প বন্ধ করার জন্য আন্দোলন চালাচ্ছে। যদিও বাংলাদেশ সরকার এই প্রকল্প বাস্তবায়নে অনড় অবস্থানে রয়েছে।

কয়লাভিত্তিক অন্যান্য প্রকল্পগুলো হলো: ১২০০ মেগাওয়াটের মাতারবাড়ী আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কোল পাওয়ার প্রজেক্ট; ১২০০ মেগাওয়াটের পেকুয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র; ১৩২০ মেগাওয়াটের মহেশখালী বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প; ৭০০ মেগাওয়াটের বাংলাদেশ-সিঙ্গাপুরের যৌথ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র; দক্ষিন কোরিয়ার সঙ্গে জিটুজি ভিত্তিতে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন,বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্ন্য়ন বোর্ড (বিউবো) ও চায়নার সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ৩৫০ মেগাওয়াটের মুন্সীগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্র।

নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ খাত

দেশে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও টেকসই জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে ২০ শতাংশ জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের একক জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে ক্রমান্বয়ে জ্বালানি বহুমুখীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করছে।

এছাড়া বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার ও এর উন্নয়ন নিশ্চিত জন্য করতে ২০০৮ সালের ১৮ই ডিসেম্বর থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি কার্যকর করা হয়। টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ - স্রেডা এক্ট-২০১২ প্রনয়ন করে বাংলাদেশ সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস হিসাবে সৌরশক্তি, বায়ু শক্তি, জলবিদ্যুৎ, বায়োমাস, বায়ো ফুয়েল, জিওথার্মাল, নদীর স্রোত, সমুদ্রের ঢেউ ইত্যাদিকে শনাক্ত করেছে। এই কার্যক্রমের আওতায় বাংলাদেশ সরকার ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে ব্যবহৃত জ্বালানির ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র

রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলায় কাপ্তাই বাঁধ তৈরি করা হয়। পাকিস্তান সরকার ১৯৫৬ সালে আমেরিকার অর্থায়নে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। ১৯৬২ সালে এর নির্মাণ শেষ হয়।এ বাঁধের পাশে ১৬টি জলকপাট সংযুক্ত ৭৪৫ ফুট দীর্ঘ একটি পানি নির্গমন পথ বা স্প্রিলওয়ে রাখা হয়েছে। এ স্প্রিলওয়ে প্রতি সেকেন্ডে ৫ লাখ ২৫ হাজার কিউসেক ফিট পানি নির্গমন করতে পারে।

১৯৬২ সালে এটির নির্মাণ সমাপ্ত হওয়ার পর এতে দুটি ৪০ মেগাওয়াটের জেনারেটর স্থাপন করা হয়। ১৯৬৯ সালের ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ৩ নম্বর ইউনিটের কাজ শুরু হয়। ৩ নম্বর ইউনিটের কাজ ১৯৮২ সালে শেষ হয়। ৪র্থ ও ৫ম ইউনিটের কাজ শেষ হয় ১৯৮৮ সালে। বর্তমানে মোট পাঁচটি ইউনিট চালু আছে যার মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৩০ মেগাওয়াট।

মুহুরী প্রজেক্ট বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র

দেশের প্রথম বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপিত হয় ফেনীর সমুদ্র উপকূলীয় সোনাগাজীতে অবস্থিত মুহুরী প্রজেক্টে। মুহুরী প্রজেক্ট হল বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্প। ফেনীর মুহুরী নদীর তীর ঘেঁষে খোয়াজের লামছি মৌজায় ছয় একর জমির উপর স্থাপিত এটি। মুহুরী প্রজেক্ট বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র ২০০৫ সালে বাংলাদেশের প্রথম বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র একটি পাইলট প্রকল্প হিসেবে চালু হয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে অবস্থিত ৪টি ২২৫ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন টারবাইন দিয়ে প্রায় এক মেগাওয়াট (০.৯) বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।

কুতুবদিয়া বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র

২০১৭ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়ায় চালু হয় ১ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন বায়ু চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে প্রায় ২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি তৈরি করা হয়েছে।

বর্তমানে ২০ কিলোওয়াট ক্ষমতার ৫০টি টারবাইন দ্বারা ১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি জাতীয় গ্রীডের সাথে সংযুক্ত নয়। তবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ আশে পাশের প্রায় ৫৫০ গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে।

সৌর শক্তি

বাংলাদেশের সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর অধিকাংশ জাতীয় গ্রীডের সাথে সংযুক্ত নয়। ২০১৭ সাল পর্যন্ত উৎপাদনে যাওয়া ২১১.৪৬ মেগাওয়াটের সৌর বিদ্যুতের মধ্যে ২০১.৪ মেগাওয়াট বিদ্যুতই জাতীয় গ্রীডের বাইরে। এর মধ্যে রয়েছে ৪৫ লক্ষ সোলার হোম সিস্টেম যার পরিমাণ প্রায় ১৭৮.৮৬ মেগাওয়াট। আরো রয়েছে প্রায় ৫০০টি সোলার পাম্প যাতে ব্যবহৃত হচ্ছে ৬.৪৩ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ।
 
পারমাণবিক বিদ্যুৎ

পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ইতিহাস খুব বেশিদিনের নয়। পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন একাধারে যেমন সাশ্রয়ী আবার একই সাথে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন অত্যন্ত ব্যয় বহুল। এছাড়া পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সৃষ্ট তেজস্ক্রিয় রাসায়নিক বর্জ্য জীব বৈচিত্র্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক। বর্তমানে বিশ্বের ৩১টি দেশে ৬৭টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। বাংলাদেশেও স্থাপিত হয়েছে প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।

রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র

বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপিত হয়েছ পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার অন্তর্গত পাকশী ইউনিয়নের রূপপুর গ্রামে।
২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর রুশ ফেডারেশনের রোসাটম স্টেট এনার্জি করপোরেশন রোসাটমের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট এবং বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের মধ্যে এ কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি বা জেনারেল কন্ট্রাক্ট সই হয়। চুক্তি অনুযায়ী রূপপুর পারমাণবিক বিদুৎ কেন্দ্র স্থাপনে ব্যয় ধরা হয় ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা। যার নব্বই শতাংশ রুশ ফেডারেশন ঋণ হিসাবে দিচ্ছে। বাকি দশ শতাংশ বাংলাদেশ অর্থায়ন করবে। নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুর তিনগুণের বেশি বাজেটের এ প্রকল্প বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ প্রকল্প।
২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াটের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করবে রুশ ফেডারেশন। নির্মাণ শুরু সাত বছরের মাথায়-২০২৩ সালে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের ভিভিইআর-১২০০ মডেলের (জেনারেশন থ্রি-প্লাস) প্রথম রি-অ্যাক্টরটি উৎপাদনে আসবে। তার এক বছর পর, ২০২৪ সালে উৎপাদনে আসবে দ্বিতীয় রি-অ্যাক্টরটি। দ্বিতীয়টির উৎপাদন ক্ষমতাও ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ ২০২৪ সাল নাগাদ আমাদের জাতীয় গ্রিডে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎ যোগ হবে।

দেশে বিদ্যুতের যে চাহিদা রয়েছে, তার অন্তত দশ ভাগ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পূরণ করতে সক্ষম হবে। এ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ৬০ বছর ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। এটি শুধু বিনিয়োগের দিক থেকে নয়, একই সঙ্গে উচ্চতর ও সংবেদনশীল সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মিশেলে দেশের একমাত্র প্রকল্প। এটি আবার বাংলাদেশের জন্য প্রথমও।

অন্যান্য পরিকল্পনা

বিদ্যুৎ উৎপাদনের দীর্ঘমেয়াদী মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা কার্যক্রমের আওতায় ২০৪১ সালের মধ্যে পাশের দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিবেশি দেশ ভারত থেকে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানির লক্ষ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর আওতায় দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে জিএমআরের নির্মিতব্য জল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।

তাছাড়া ১৪ হাজার ১১৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প নির্মাণাধীন রয়েছেএবং ৬৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের দরপত্র প্রক্রিয়াধীন রয়েছে । ২ হাজার ৯৬১ মেগাওয়াট ক্ষমতার ২০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি স্বাক্ষর প্রক্রিয়াধীন রয়েছে যেগুলো খুব শিগগিরই কার্যক্রম শুরু করবে।

অদূর ভবিষ্যতে আরও ১৫ হাজার ১৯ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। পুরাতন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সংরক্ষণ, মেরামত বৃদ্ধির মাধ্যমে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়ে বাংলাদেশ, ভুটান এবং ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক চূড়ান্ত পর্যায়ে স্বাক্ষরের অপেক্ষায় আছে। জয়েন্ট স্টিয়ারিং কমিটি (জেএসসি) সভার সিদ্ধান্তের আলোকে দেশসমূহের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করবে।
এছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যে সৌরবিদ্যুৎ ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর অধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এ লক্ষ্যে দালানের ছাদে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন জনপ্রিয় করার জন্য ‘নেট মিটারিং গাইডলাইন’ প্রণয়ন করা হয়েছে এবং প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাদে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

গত একযুগে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করার ফলে বর্তমানে মোট সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ১২ হাজার ৬৯২ সার্কিট কিলোমিটার এবং বিতরণ লাইনের পরিমাণ ৬ লাখ ৩ হাজার কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। বিদ্যুতের সামগ্রিক সিস্টেম লস ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ১৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ থেকে প্রায় ৫ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ১১ দশমিক ২৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

২০৩০ সালের মধ্যে মোট সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার সার্কিট কিলোমিটার এবং বিতরণ লাইনের পরিমাণ ৬ লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটারে উন্নীত করার পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। তাছাড়া আগামী এক বছরের মধ্যে দেশের সব উপজেলায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ চলমান রয়েছে।

(ঢাকাটাইমস/২৩সেপ্টেম্বর/ডিএম)